হিমুর স্রষ্টার চলে যাওয়ার দিন আজ
তিন জন হুমায়ুন আছেন আমার জীবনে। আমাদের জীবনে। বাঙালির জীবনে। আমরা একজনের বই পড়ে, একজনের অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়েছি, আরেকজন মুক্তভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে শিখিয়েছেন।
তারা হলেন—হুমায়ূন আহমেদ, হুমায়ুন ফরিদী এবং হুমায়ুন আজাদ।
জনপ্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদের আজ নবম মৃত্যুবার্ষিকী। আজ তার কথাই বলি। কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা, গীতিকার, শিক্ষক— কী ছিলেন না হুমায়ুন আহমেদ! বাংলাদেশের আর কোনো লেখক তার লেখা দিয়ে মানুষকে এতোটা প্রভাবিত করতে পেরেছেন তা নিয়ে রীতিমত গবেষণা হতে পারে। এতো সহজ ও সুন্দর করে লিখতেন তিনি! মনে হতো কোনো লেখার জাদুকর! একবার পড়া শুরু করলে শেষ করতেই হতো।
সেই ১৯৭২ সালে প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরক’ দিয়ে লেখার শুরু। এরপর মৃত্যুর আগ অবধি শুধু লিখেই গেছেন। একদিকে তৈরি করেছেন রহস্যময় হিমু, আরেকদিকে যুক্তিবাদী মিসির আলি। তার লেখায় প্রভাবিত হয়ে শুধু আমি নই, বাংলাদেশের বহু তরুণ হিমুর মতো জীবনযাপনের স্বপ্ন দেখেছে, কেউ কেউ বেরিয়ে পড়েছে জোৎস্না রাতে।
আসলে বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার গল্প হুমায়ূন আহমেদ খুব সহজ সাবলীল ভাষায় তুলে ধরতেন। পড়তে পড়তে মনে হতো এ বুঝি আমাদেরই গল্প! তার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব এই দেশে বিশাল তরুণ পাঠকসমাজ তৈরি করা। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থেকে শুরু করে সব শ্রেণীর মানুষ তার লেখা গোগ্রাসে গিলতেন। তিনি না জন্মালে হিমু, মিসির আলী কিংবা শুভ্রকে বাঙালি কোনদিনই চিনতো না।
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, আত্মজীবনী, শিশু-কিশোরদের জন্য গ্রন্থ, হিমু সিরিজ, মিসির আলী সিরিজ, শুভ্র সিরিজ, ভ্রমণকাহিনীসহ নানা বিষয়ে দুই শতাধিক গল্পগ্রন্থ ও উপন্যাস রচনা করেছেন হুমায়ূন আহমেদ
তার বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পিরোজপুর মহকুমার এসডিপিও হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং কর্তব্যরত অবস্থায় পাকবাহিনীর হাতে শহীদ হন।
হুমায়ূন আহমেদকেও ১৯৭১ সালে পাকবাহিনী ধরে নিয়ে কিছুদিন আটক করে রাখে এবং দৈহিক নির্যাতন করে। এসব কারণেই তিনি হয়তো মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্প-উপন্যাস-সিনেমায় অনেক বেশি আগ্রহী ছিলেন। তার শ্যামল ছায়া, আগুনের পরশমণি, জোছনা ও জননীর গল্প মুক্তিযুদ্ধের সেই সময়টার কথা মনে করিয়ে দেবে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার প্রতিটা লেখা, প্রতিটা কাজ চোখ ভিজিয়ে দেয় আমাদের।
শুধু লেখালেখি নয়, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ বহু নাটক ও সিনেমা বানিয়েছেন। বহুব্রীহি নাটকে তো তিনি পাখিকে দিয়েও বলিয়েছেন ‘তুই রাজাকার’। এই কারণেই হয়তো আমাদের মতো বহু কিশোর সেই শৈশবেই রাজাকারদের ঘৃণা করতে শিখেছিলাম। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময়ও তাই এই স্লোগান উঠেছিল।
অবশ্য শুধু বহুব্রীহি কেন? নাটকের কথা এলে বহুব্রীহির পাশাপাশি কোথাও কেউ নেই, নক্ষত্রের রাত, অয়োময়, আজ রবিবারসহ দারুণ সব ধারাবাহিক নাটকের কথা বলা যায় যেগুলো আজও মানুষ দেখে। ছোটবেলায় বিটিভিতে আমাদের জীবন মানেই ছিল এইসব নাটক। কখনো আমরা হেসেছি, কখনো আবার বাকের ভাইয়ের ফাঁসিতে কেঁদেছি।
দারুণ সব চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকার ও পরিচালকও ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। এর মধ্যে শঙ্খনীল কারাগার বা আগুনের পরশমণির মতো জাতীয় পুরস্কার পাওয়া চলচ্চিত্র যেমন আছে, তেমনি আছে দারুচিনি দ্বীপ, শ্যামল ছায়া, শ্রাবণ মেঘের দিনসহ অন্তত ১৫টি চলচ্চিত্র।
হুমায়ূন আহমেদ শুধু লেখালেখি করেননি। তিনি ছবিও এঁকেছেন। নিজের নাটক ও চলচ্চিত্রের জন্য গান রচনা করেছেন। একুশে পদক থেকে শুরু করে নানা পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছেন তিনি।
মাঝে মধ্যেই আমার হুমায়ুন আহমেদকে হালকা মেজাজের লেখক মনে হতো। কিন্তু পড়তে পড়তে মনে হতো, এতো হালকা লেখার মধ্যেও তিনি গভীর কোনো দর্শন ঢুকিয়ে দিয়েছেন। এমন এমন উক্তি থাকে যে গভীরভাবে ভাবতে হয়। এই যেমন তার কোনো একটা লেখায় ছিল, ‘তুমি একটা খারাপ কাজ করেছো তার মানে তুমি একজন মানুষ, তুমি সেই খারাপ কাজটার জন্য অনুতপ্ত তার মানে তুমি একজন ভালো মানুষ।’ কী সহজ ভাষায় কতো গুরুত্বপূর্ণ কথা।
তবে তার চলে যাওয়াটা ছিল যেন হুট করে। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এসে জানা যায় এই দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখকের ক্যান্সার ধরা পড়েছে। পরে তাকে নিউইয়র্কের মেমোরিয়াল স্লোয়ান-কেটরিং ক্যান্সার সেন্টারে চিকিৎসা দেওয়া হয়। ১২ দফায় তাকে কেমোথেরাপি দেওয়া হয়েছিল। অস্ত্রোপচারের পর তার কিছুটা শারীরিক উন্নতি হলেও, শেষ মুহূর্তে শরীরে অজ্ঞাত ভাইরাস আক্রমণ করায় তার অবস্থার দ্রুত অবনতির দিকে যায়।
২০১২ সালের ১৯ জুলাই সবাইকে কাঁদিয়ে চলে যান বাঙালির প্রিয় এই লেখক।
আচ্ছা এই দেশে হুমায়ূন আহমেদ কী কখনো আসলেই মারা যাবেন? হুমায়ূন আহমেদের ছেলে নুহাশ হুমায়ূনের সঙ্গে একটা অনুষ্ঠানে গল্প হচ্ছিল। স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, নাটক ও বিজ্ঞাপন চিত্র বানিয়ে হাত পাকিয়েছেন নুহাশ হুমায়ূন। গল্প করতে করতে বলছিলাম, হুমায়ূন আহমেদ, তার লেখা আর তার কাজ বেঁচে থাকবেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
আসলেও তাই। হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিনে তাই দেখা যায় গুগল তাদের হোমপেজে হুমায়ূন আহমেদের গুগল ডুডল প্রদর্শন করছে। চায়ের টেবিলে বই হাতে বসে আছেন হুমায়ূন আহমেদ। তার তৈরি জনপ্রিয় চরিত্র হিমু হলুদ পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। আসলেই তাই। হিমুরা রয়ে যাবে আজীবন। ভরা জোছনায় তারা খুঁজবে জীবন।
যুক্তরাষ্ট্রে মারা গেলেও দেশে ফেরত এনে হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ নুহাশ পল্লীতে দাফন করা হয়। নিজের কবরের এপিটাফ নিজেই ঠিক করে গিয়েছিলেন কিংবদন্তী এই কথা সাহিত্যিক। যে কেউ নুহাশ পল্লীতে গেলেই দেখতে পাবেন নুহাশ পল্লীর সবুজের মধ্যে ধবধবে শ্বেতপাথরের কবর। তার গায়ে লেখা-
‘চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে
নিয়ো না, নিয়ো না সরায়ে’
শরিফুল হাসান: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
Comments