হিরণ্ময় নীরবতা
নীরবতা নিয়ে কথা বলতে গেলে ব্যবহার করতে হয় শব্দ আর সেই শব্দ ভেঙে দেয় নীরবতাকেই। নীরবতার এই ভেঙে পড়া নিয়ে অস্তিত্ববাদী দার্শনিক সোরেন কিয়ের্কেগাদ হয়তো বিচলিত ছিলেন, কারণ, তার ডায়েরির একটি ভূক্তিতে দেখা মেলে এক অদ্ভুত প্রশ্নের, কিংবা বলা যায়, উৎকণ্ঠার। প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি, ঈশ্বরকে নিয়ে একজন মানুষের কি কিছু বলার অধিকার আছে আরেক মানুষকে? কেননা তখন তো টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়বে পরমের সঙ্গে সম্পর্ক, আর সেই সম্পর্কেরই অন্য নাম নীরবতা।
পরমের সঙ্গে সম্পর্কের নাম নীরবতা? কী অপূর্ব এই ভাবনা! কিন্তু নীরবতাই যদি সম্পর্কের নাম হয় তাহলে ওই পরম সম্বন্ধে এক মানুষ অন্য মানুষকে কিছু বললেই যে শুধু সম্পর্ক ভাঙবে তা নয়, ভাঙবে একজন মানুষ আত্মমগ্ন হয়ে একা একা কথা বললেও। চির নিশ্চুপ, চির নিরুত্তর ঈশ্বর কি সেজন্যই তাঁর কাছে সমর্পিত মানুষদের কাতর ডাকেও সাড়া দেন না? ডাক এবং সাড়া দুটোতেই তো নীরবতার অবসান, সম্পর্কের সমাপ্তি! নীরবতার ওপর গড়ে ওঠা সম্পর্ক কী ভয়াবহ জটিল, ঝুঁকিপূর্ণ ও রহস্যময়, ভেবে দেখুন একবার!
পরমের সঙ্গে সম্পর্ক এবং নীরবতার ভূমিকা নিয়ে হয়তো কিয়ের্কেগাদই প্রথম ভাবেননি। খৃষ্টীয় দশম শতকের সুফি দার্শনিক আলী বিন উসমান আল-জুল্লাবি আল-হুজওয়িরির একটা লেখায়ও এই ধরনের প্রসঙ্গের দেখা মেলে। লেখাটি মনসুর বিন হাল্লাজকে নিয়ে। সুফি সাধক এবং দার্শনিক হাল্লাজকে হত্যা করা হয়েছিল মরমি সত্য প্রকাশ করার জন্য, কারণ সেগুলোকে শরিয়তবিরোধী এবং খোদাদ্রোহী কথাবার্তা বলেই চিহ্নিত করা হয়েছিল সে-সময়। যদিও হাল্লাজ নিজে সেগুলোকে মনে করতেন নিগুঢ় সত্য। তার জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর পরও তৎকালীন দার্শনিক এবং পণ্ডিতদের মধ্যে মতানৈক্য ছিল। যেমন আরেক সুফি দার্শনিক আবু বকর শিবলী মনে করতেন, 'যখন কোনো সত্যিকারের মরমি মানুষ অন্তর্দৃষ্টি লাভ করেন, তিনি তা বলার চেষ্টা করেন না, আত্মমূল্যায়নের গর্ব নিয়েও মাথা ঘামান না, তারা প্রশংসা বা অপবাদ নিয়েও ভাবেন না, স্বীকৃতি বা অবিশ্বাস নিয়ে থাকেন নির্মোহ'। বোঝা যাচ্ছে, শিবলী অন্তরের উপলব্ধ সত্য প্রকাশের পক্ষে ছিলেন না, কিংবা আরও পরিষ্কার করে বলা যায়, তিনি নীরবতার পক্ষেই ছিলেন। এমনকি হাল্লাজ নিজেও এমনটি বলেছেন যে, কথা বলা জিভ নীরব হৃদয় ধ্বংস করে।
কিন্তু আল-হুজওয়িরির মত ভিন্ন। তিনি মনে করেন, 'সত্যের মানে প্রকাশ খুবই বিপজ্জনক। মানে যদি থাকে তা প্রকাশে হারায় না আর তা যদি না-ই থাকে প্রকাশ তা অস্তিত্বমান হয় না।' আল-হুজওয়িরির উপলব্ধিতে ধরা পড়া এই সত্যকে যদি আমরা পরমের সঙ্গে সম্পর্ক হিসেবে ধরে নিই, দেখতে পাই তিনি আসলে যা বলতে চেয়েছেন, তা হলো, যদি সত্যিই সেই সম্পর্ক থেকে থাকে তাহলে তা প্রকাশ করলে নীরবতা ভাঙবে বটে কিন্তু সম্পর্কটি হারিয়ে যাবে না। আবার সম্পর্কটিই যদি না থাকে, তাহলে কথা বলে, চিৎকার-চেঁচামেচি করে সেই সম্পর্ক তৈরিও করা যাবে না। তাঁর প্রতীতি আসলে দুটো। প্রথমত, নীরবতার ভাঙনে সম্পর্ক ভাঙে না; দ্বিতীয়ত, শব্দ দিয়ে, বাক্য দিয়ে সম্পর্ক রচনা করা যায় না।
কিন্তু ওটাই শেষ কথা নয়। কিয়ের্কেগাদের ওই কথাগুলো নিয়ে ভেবেছিলেন শঙ্খ ঘোষও। তার 'নিঃশব্দের তর্জনী'তে তিনি লিখেছিলেন- 'এমনও কথা কি নেই যাতে নীরবতা গড়ে ওঠে?' পরমের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যাবার ঝুঁকির কথা বলার পরই আলাদা অনুচ্ছেদে এই একটিমাত্র বাক্য লিখেছেন শঙ্খ ঘোষ। এবং পরপরই এক নাতিদীর্ঘ আলোচনায় দেখিয়েছেন কবিতায় নৈঃশব্দ্য নির্মাণের আবশ্যকতা।
কথা বললে নীরবতা ভাঙবে, নীরবতা ভাঙলে ভেঙে যাবে পরমের সঙ্গে মানুষের অতিলৌকিক সম্পর্কও, কিন্তু কথা না বলেই বা পারবেন কীভাবে শিল্পীরা? তাদের সমস্ত সৃজনই তো কথানির্ভর! সুতরাং সৃষ্টি করতে হবে এমন 'কথা' যেন 'নীরবতা' গড়ে ওঠে, মানে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরমের সঙ্গে সম্পর্কই যদি সুপ্রিম হয়, তাহলে এই সম্পর্ক গড়ে তোলা যাবে কথা দিয়েই। যেমন-তেমন কথা নয়, নীরবতা গড়ে ওঠার মতো কথা।
শঙ্খ ঘোষ কবিতায় নীরবতা গড়ে তোলার কথা বলেছেন, সঙ্গত কারণেই সেই নীরবতা গড়তে হবে অক্ষরের পর অক্ষর সাজিয়ে শব্দ-বাক্য-কথা দিয়ে। কিন্তু সব ক্ষেত্রে শব্দ মানে কেবল কতগুলো অক্ষরের সমষ্টি নয়। বাস্তব জীবনে অক্ষর দিয়ে তৈরি শব্দের ভূমিকা সামান্যই। ধ্বনিপুঞ্জের বিবিধ সমন্বয়ে তৈরি হওয়া শব্দ দিয়েই আমাদের জগৎ ভরা। সেই শব্দ যেমন নৈসর্গিক হতে পারে, তেমনই যন্ত্র-নির্মিতও হতে পারে। যেমন সংগীত। সংগীতের সুর কি কখনো আপনার চারপাশে এক অপূর্ব নীরবতার দেয়াল গড়ে তোলেনি? মঞ্চের নাটক কিংবা পর্দার চলচ্চিত্র তো কোলাহলপ্রবণই, কিন্তু কোনো-কোনো দৃশ্য কি সমস্ত মিলনায়তনকেই স্তব্ধ-নির্বাক-নীরব করে দেয় না? চিত্রকলা প্রদর্শনীতে গিয়ে কোনো-কোনো ছবি দেখে কি মনে হয়নি, এক গভীর নৈঃশব্দ্য নেমে এসেছে চারপাশে? সংগীত তো অহরহই নীরবতার জন্ম দেয়, কোনো-কোনো কবিতা-গল্প-উপন্যাস পড়ার পর দীর্ঘসময় চুপ করে বসে থাকতে ইচ্ছে করে। শিল্পের চূড়ান্ত সাফল্য, সম্ভবত, এরকম নীরবতা গড়ে তোলার ভেতরেই।
আবার উল্টোদিকটাও ভাবুন। নীরবতার গড়ে ওঠা যেমন উপলব্ধি করা যায় তেমনি তার ভেঙে পড়ার শব্দও শোনা যায় মনের গহীনে।কোনো কোনো সংগীতকে কি নিতান্তই কোলাহল মনে হয়নি আপনার? কোনো গল্প বা কবিতা বা উপন্যাস পড়ে কি মনে হয়নি, এ বড় চিৎকারসর্বস্ব! এমনকি, এত যে নৈঃশব্দ্যে ভরা চিত্রকলা, তবু কোনো-কোনো ছবির সামনে দাঁড়িয়ে কি আপনার মনে হয়নি, এই ছবি বড্ড বেশি কথা বলছে! নীরবতা গড়া আর ভাঙার খেলা এভাবেই খেলে চলেন শিল্পীরা। সবসময় যে সচেতনভাবেই কাজটি তাঁরা করেন তা নয়, বরং অধিকাংশ সময়ই সেটি ঘটে তাঁদের অজান্তে বা অবচেতনে। মানুষের শিল্পীসত্তা ঠিক কীভাবে কাজ করে, এখন পর্যন্ত তার ব্যাখ্যা তো মেলেনি!
একসময় নীরবতাকে বলা হতো সম্মতির লক্ষণ। কিন্তু এ-তো অসম্মতিরও লক্ষণ। এমনকি সংশয়েরও। অবস্থাভেদে নীরবতার কাছেই আমাদের আশ্রয় নিতে হয়। মোট কথা, সব নীরবতার অর্থ একই নয়। কেউ স্বেচ্ছায় নীরব থাকে, কেউ থাকে ভয়ে- বিশেষ করে কথা বললে যখন নিপীড়ন নেমে আসে, তখন ভয় পাওয়া ছাড়া উপায় কী? কেউ নীরবতাকে ভালোবাসে, কেউ-বা ভালো না বেসেও নীরব থাকে- বিশেষ করে সেইসব মানুষ, যারা ভাবেন, অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগটা ঠিক হয়ে উঠছে না, কেউ বুঝতে পারছেন না তাকে। বিশ শতকের অন্যতম প্রভাবশালী দার্শনিক লুডভিগ ভিটগেনস্টাইন যে বলেছিলেন, what we can not speak about we must consign to the silence, এর অনেক অর্থ করা যায়। অন্তত একটা অর্থ তো এই যে, শব্দ-বাক্য-দেহভঙ্গি দিয়ে যদি আমাদের কাঙ্ক্ষিত কথাটি না বলা যায়, কিংবা বললেও যদি কাউকে না বোঝানো যায়, তাহলে নীরবতাই আমাদের হয়ে কথা বলুক। কেবল সম্মতি নয়, অসম্মতির কথা বলুক, বলুক সংশয়ের কথা, এমনকি অবিশ্বাসের কথাও; প্রশ্ন তুলুক, বিদ্রোহ করুক, ক্ষতবিক্ষত করে দিক ক্ষমতাসীনদের মন।
তো, কথা হচ্ছিল নীরবতার ভাঙা-গড়া নিয়ে। নীরবতা ভেঙে ফেলাটা সহজ, গড়ে তোলাটাই কঠিনতম ব্যাপার। লেখক-শিল্পীদের হাতে গড়ে ওঠা নীরবতা তো মনুষ্য-নির্মিত নীরবতা, নৈঃসর্গিক নীরবতার তুলনায় তার পরিমাণ সামান্য হলেও এর মূল্য অপরিমেয়। যে শিল্পের আস্বাদনে আপনার হৃদয়ে নীরবতার জন্ম হলো, সেটি প্রায় অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন। আপনার সচেতন মন তা জানক বা না-জানুক, অবচেতন মন তাকে ঠিকই চিনতে পারে, আর তার নির্যাস বাঁচিয়ে রাখে আপনার ভেতরে, জীবনের বিভিন্ন সময়ে আাপনাকে মনে করিয়ে দেয় সেই অলৌকিক আস্বাদনের কথা। আবার প্রকৃতি-সৃষ্ট নীরবতার কথা ভাবুন। কারই বা পরিচয় নেই এর সঙ্গে? একবার গভীরভাবে নিসর্গের দিকে তাকান, ধ্যানমগ্ন মন নিয়ে লক্ষ্য করুন সব কিছু, দেখবেন কথা বলতে ইচ্ছে করবে না, শুনতেও ইচ্ছে করবে না। মনে হবে এক গভীর নৈঃশব্দ্য ও নীরবতা আপনাকে ঘিরে ফেলেছে। হয়তো সেজন্যই গত শতকের সবচেয়ে প্রভাবশালী মিথতত্ত্ববিদ জোসেফ ক্যাম্পবেল উপনিষদের উদ্ধৃতি টেনে বলেছিলেন, সূর্যাস্তের সৌন্দর্য দেখে, কি পর্বতমালার সৌন্দর্য দেখে আপনি যখন মুহূর্তকাল দাঁড়িয়ে বিস্ময়োক্তি করেন 'আহ!' তখনই কিন্তু আপনি স্বর্গীয় পরম সত্তায় অংশ নেন।
পরমের সংজ্ঞা আপনার কাছে যেমনই হোক না কেন, সেই পরম সত্তায় অংশ নেওয়া বা পরমের সঙ্গে সম্পর্ক রচনার জন্য আপনাকে নীরবতার কাছে আশ্রয় নিতেই হবে। আর যে নীরবতা আপনাকে পরমের সঙ্গে সম্পর্কিত করে, সেই নীরবতাই সুন্দর, মনোহর, হিরণ্ময়।
Comments