গোলাম কাসেম ড্যাডি: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আলোকচিত্রী

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রশিক্ষণ ময়দানে পদাতিক বাহিনীর পোশাকে গোলাম কাসেম ড্যাডি (বিহার, ভারত ১৯১৫)। ছবি: ফটোজিয়ামের সৌজন্যে

পথিকৃৎ আলোকচিত্রী গোলাম কাসেম ড্যাডির হাত ধরেই এই দেশে ফটোগ্রাফির শিক্ষাচর্চা শুরু হয়। বাংলাদেশের ফটোগ্রাফির জনক হিসেবে সবাই তাকে ড্যাডি বলে ডাকেন। বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে তিনিই প্রথম সার্থক আলোকচিত্রশিল্পী ও ছোটগল্প লেখক। ট্রপিক্যাল ইনস্টিটিউট অব ফটোগ্রাফি ও ক্যামেরা রিক্রিয়েশন ক্লাব তার হাতে গড়া। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের পাশাপাশি গ্লাস প্লেট নেগেটিভে ধারণ করেছেন মহাযুদ্ধের দুর্লভ মুহূর্ত।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঠিক ২ বছর আগে ফটোগ্রাফিতে অভিষেক গোলাম কাসেম ড্যাডির। যুদ্ধের সময় তিনি পড়তেন কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় ১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই। ভারতীয় উপমহাদেশেও সেই যুদ্ধের ঢেউ এসে লাগে। কলকাতায় যেন কোনো যুদ্ধজাহাজ কিংবা উড়োজাহাজ এসে আক্রমণ না করতে পারে, সেজন্য আকাশে বড় বড় বেলুন ছেড়ে দেওয়া হতো। রাতের বেলায় আলো নিভিয়ে দেওয়ায় পুরো শহর অন্ধকারে হারিয়ে যেত।

সেই সময়ে ব্রিটিশ ভারতে বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠনে নানা টানাপোড়েন তৈরি হলো। ব্রিটিশরা তখন ভারতীয় বাঙালিদের খুব একটা উঁচু চোখে দেখতেন না। ১৯১৬ সালের ৩০ আগস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠিত হলো। সেখানে দলে দলে ভারতীয় বাঙালিরা ব্রিটিশদের পক্ষে যোগ দিতে লাগলেন। এর আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনফ্যানট্রি কোর বলে একটি বিশেষ দল গঠিত হলো। ওই কোরে শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই যোগ দিতে পারতেন। বাঙালি লড়াকু জাতি নয়, ব্রিটিশদের এই তকমাটা ভুল প্রমাণের জন্য ২১ বছর বয়সী ড্যাডি নাম লেখান ইনফ্যানট্রি কোরে। ক্যামেরাটা তার সঙ্গেই ছিল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রশিক্ষণ (বিহার, ভারত ১৯১৫)। ছবি: গোলাম কাসেম ড্যাডি/দৃক

ড্যাডি যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণের পাশাপাশি যুদ্ধের অসংখ্য মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দি করেছেন, সে বিষয়টিও শতাব্দিকাল ধরে কোনো মহলে আলোচিত হয়নি। যুদ্ধে অংশগ্রহণের সুবাদে তিনি কলকাতা ফোর্ট উইলিয়ামে অনেক দিন ছিলেন। ফোর্ট উইলিয়ামের পর বিহারের মধুপুরে ৬ মাসের একটা প্রশিক্ষণ হয়। সেখানে সাড়ে ৫ শর মতো ছাত্র যোগ দিয়েছিলেন।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর কর্মকর্তারা ছিলেন ইনফ্যানট্রি কোরের দায়িত্বে। প্রশিক্ষক ছিলেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন মি. গ্রে। গ্রে ছিলেন খুবই মিশুক প্রকৃতির। ছাত্রদের সঙ্গে সহজেই মিশে যেতে পারতেন। ফটোগ্রাফি বিষয়ে তার ধারণা ছিল। ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই গ্রের সঙ্গে ড্যাডির বন্ধুত্ব হয়ে যায়। ক্যামেরা থাকার একটা বাড়তি সুবিধা আছে। অন্যরা যেখানে যেতে পারতেন না, ড্যাডি সেখানে যাওয়ার অনুমতি পেতেন। ফোর্ট উইলিয়াম কিংবা মধুপুরে ড্যাডির এই অনুমতির কথাও সবাই জানতেন।

খুবই স্বাস্থ্যকর জায়গা মধুপুর। প্রশিক্ষণের শুরুতে সবাইকে ইউনিফর্ম দেওয়া হয়। প্রতিদিন সকালে নিয়ম করে প্যারেড হতো। সেখানে বন্দুক চালনা থেকে শুরু করে শত্রু আক্রমণসহ যুদ্ধের সবরকম কলাকৌশল শেখানো হয়। ওই সময় ছবি তোলার চেয়ে রণকৌশল শেখার দিকে তাকে বেশি মনোযোগ দিতে হয়েছে। এর মধ্যেও সময় বের করে কোডাক ক্যামেরায় তিনি মহাযুদ্ধের অসংখ্য আলোকচিত্র ধারণ করেন। ফটোগ্রাফির প্রবল নেশা আর ডকুমেন্টেশনের আকুতি থেকেই তিনি গ্লাস প্লেট নেগেটিভে ছবিগুলো তুলেছিলেন বলে ধারণা করা যায়। কলকাতার চৌরঙ্গীতে স্টুডিও পাড়ায় ঘোরাঘুরির কারণেই ডকুমেন্টেশনের বিষয়টি তার মাথায় ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তিনি যত ছবি তুলেছেন, ভারতবর্ষের আর কেউ এত ছবি তোলার সুযোগ পেয়েছেন বলে জানা যায়নি। ৯৪ বছর বয়সে ড্যাডি এক সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট করে বলে গেছেন এসব কথা।

বিশ্বযুদ্ধের প্রশিক্ষণক্যাম্পের তাঁবুর সামনে (বিহার, ভারত ১৯১৫)। ছবি: গোলাম কাসেম ড্যাডি/ফটোজিয়াম

ড্যাডি বলেছেন, ক্যাম্পের জীবনটা অন্যরকম ছিল। মাঝেমধ্যেই এমন একটা ভাব চলে আসত যে, মিলিটারিদের কত শক্তি, কত ক্ষমতা! অনেক সময় তার মনে হতো— সৈনিক জীবনে কাউকে কোনো পরোয়া করতে নেই। নিয়মতান্ত্রিক খাওয়া-দাওয়া, সকালে ঘুম থেকে ওঠা, সময়মতো ঘুমাতে যাওয়া— মোট কথা জীবনকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে উপভোগ করার মন্ত্র ওই রণপ্রশিক্ষণ ক্যাম্প থেকেই পেয়েছিলেন তিনি। ১০৪ বছর আয়ু পাওয়া ড্যাডি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই নিয়মের মধ্যেই ছিলেন। ফলে তার এই দীর্ঘ জীবনে কঠিন রোগ-বালাইয়ের কথা খুব একটা শোনা যায়নি। ড্যাডির সৈনিকজীবন ছিল দুই বছরের। ক্যাম্প ছাড়ার পর ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। কঠিন ম্যালেরিয়ায় ২ বছর ভোগেন। সেরে উঠতে উঠতে যুদ্ধ শেষ!

ড্যাডির অন্তর্মুখী ব্যক্তিত্ব আর নিভৃত জীবনযাপনের কারণে তিনি কখনো নিজেকে প্রকাশ করতে চাইতেন না। ফলে তার সুবিশাল ছবির ভাণ্ডারের অনেকটাই অজানা। নিঃসন্তান ছিলেন বলে শেষ সময়টা অনাদরে অবহেলায় কেটেছে। তার মৃত্যুর পর ইন্দিরা রোডের বাড়িটাও দীর্ঘদিন অরক্ষিত অবস্থায় পড়েছিল। সাপের উৎপাত, এ অজুহাতকে সামনে এনে একসময় তার বাসভবনটিও ভেঙে ফেলা হয়। এই সময়ের মধ্যে তার বিপুলসংখ্যক নেগেটিভ বেহাত হয়ে যায়। নেগেটিভগুলো কোথায় কিংবা কী অবস্থায় আছে; তাও এখন নানা রহস্যে ঢাকা।

ড্যাডি সারাজীবনে ৮ থেকে ১০ হাজার ছবি তুলেছেন। অতি বৃদ্ধ বয়সেও তিনি ৫ শতাধিক নেগেটিভ সংরক্ষণ করতে পেরেছিলেন। এরমধ্যে তিনি দৃক আলোকচিত্র গ্রন্থাগারকে ১৬৫টি নেগেটিভ দিয়ে যান। আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুনের ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা ফটোজিয়ামেও ১৩৫টি নেগেটিভ সংরক্ষিত আছে বলে জানা যায়। ৫টি নেগেটিভ আছে ড্যাডির প্রতিষ্ঠিত ক্যামেরা রিক্রিয়েশন ক্লাবে। কয়েক বছর আগে দৃক ড্যাডির ছবির প্রদর্শনী করলেও ফটোজিয়ামের সংগ্রহে থাকা বেশির ভাগ ছবিই মানুষের অদেখা। অতি সম্প্রতি পাঠক সমাবেশ থেকে সাহাদাত পারভেজ সম্পাদিত ৪ খণ্ডের 'ড্যাডিসমগ্র' প্রকাশের পর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ড্যাডির ৩টি আলোকচিত্র আলোচনায় আসে। ড্যাডির বর্ণনা অনুযায়ী, প্রথম মহাযুদ্ধের আরও ছবি থাকার কথা। এগুলো উদ্ধার করা গেলেই ছবিপাঠের মধ্য দিয়ে তাকে বিস্তারিতভাবে জানা-বোঝা সম্ভব হবে। তবে তার তোলা এ ৩টি আলোকচিত্র এখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের এক অমূল্য স্মারক।

মধুপুরের বিশাল প্রশিক্ষণ ময়দানে ইনফ্যানট্রি কোরের সদস্যরা। সবার হাতেই থ্রি নট থ্রি রাইফেল। প্রশিক্ষণের অগ্রভাগে ক্যাপ্টেন গ্রে। নিবিড় গাছগাছালির ছায়ায় বসে রণপ্রশিক্ষণ মহরা দেখছেন উৎসুক মানুষ। প্রখর রোদের কারণে ইউনিফর্ম পরা প্রশিক্ষণার্থীদের দীর্ঘ ছায়া মাটিতে প্রতিফলিত। স্লো শাটারে তোলা বলে সশস্ত্র অভিবাদনের সময় প্রশিক্ষণার্থীদের হাতগুলো শেক করায় ছবিতে গতিময়তা যোগ হয়েছে। ড্যাডির এই ছবি যুদ্ধকালীন ভারতবর্ষের সমাজচিত্রের একটা ধারণা দেয়।

মহাযুদ্ধের টালমাটাল সময়ে ব্রিটিশদের সঙ্গে ভারতীয় সাধারণ নাগরিকের মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব যে কিছুটা কমে গিয়েছিল, ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড আর ভিজুয়াল এলিমেন্ট সে রকমই আভাসই দেয়। তা না হলে মধুপুরের মতো একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৌতূহলী মানুষ ব্রিটিশ সেনা ক্যাম্পের আশপাশে ঘেঁষতে পারতেন না। ১০৪ বছর আগে তোলা গ্লাস প্লেট নেগেটিভটির ওপরের দিকে ফাঙ্গাস দখলে নিয়েছে। কিছু জায়গায় ছোপ ছোপ দাগ। নেগেটিভের পুরো জমিনজুড়ে হালকা সেপিয়া টোন। এসব অবশ্য ছবির অ্যান্টিক মর্যাদা বাড়িয়ে দেয়।

আরেকটি ছবিতে দেখা যায়, তাঁবুর সামনে ২ ব্যক্তি সাহেবি ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন। ছবিটি অনুমতি নিয়ে তোলা, সন্দেহ নেই। তবে একটা ব্যাপার লক্ষণীয় যে, কারো দৃষ্টি ক্যামেরার দিকে নয়। ফলে এ দৃশ্যটি তুলতে গিয়ে ড্যাডি যে একটা নির্দিষ্ট মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করেছিলেন, ছবিটা কিন্তু সেই সাক্ষ্য দেয়। ভার্টিক্যাল ফ্রেমে তোলা ছবিটির ব্যাকগ্রাউন্ডের তাঁবুটি হঠাৎ দেখলে পিরামিডের মতো মনে হয়। তাঁবুটি ছবিতে একটা ত্রিমাত্রিক বা থ্রি ডায়মেনশনাল ফিল দেয়। ছবির ২ জন ব্যক্তি কে কিংবা কী তাদের পরিচয়, এ ব্যাপারে ড্যাডি কাউকে কিছু বলে যাননি। তবে রণপ্রশিক্ষণের ছবিটার সঙ্গে এই ছবিটার মিল খুঁজলে হ্যাট পরা লোকটিকে ক্যাপ্টেন গ্রে বলেই মনে হয়। তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা কর্মকর্তা; এই ধারণা করা অমূলক নয়।

সেলফ পোর্ট্রেট (ঢাকা, বাংলাদেশ ১৯৫১)। ছবি: গোলাম কাসেম ড্যাডি/দৃক

প্রাসঙ্গিক কারণে আরেকটি ছবির কথা বর্ণনা করছি। ঝকঝকে দিনের আলোয় ঘোড়ার ওপর লাগাম ধরে বসে আছেন ড্যাডি। ইউনিফর্ম পরা, মাথায় হ্যাট; চোখে কালো চশমা। শার্টের হাতা ভাঁজ করা। হাফপ্যান্টের নিচে জুতার ভেতর মোটা মোজা। পড়ন্ত দুপুরে ছবিটি তোলার কারণে সাদা ঘোড়াটির ছায়া মাটিতে হেলে আছে। ব্যাকগ্রাউন্ডে ঘন গাছালি। ঘোড়ার পেছনে একজন কৌতূহলী মানুষ।

ছবিটি কার তোলা সেটা স্পষ্ট করে বলা কঠিন। তবে মধুপুর প্রশিক্ষণ ক্যাম্প সম্পর্কে ড্যাডি বলেছিলেন, 'এই ক্যাম্পে এত এত ছাত্রের মধ্যে একজন ছাড়া আর কারো সঙ্গেই বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। এই একজন ছিলেন একটু আলাদা ধরনের। পূর্ব বাংলার ছেলে। বেশ রুচিশীল, সুন্দর, শিক্ষিত আর স্বাস্থ্যবান। ছেলেটি সৌখিন ফটোগ্রাফার ছিলেন। বি-টু সাইজের ফিল্ম ক্যামেরা ব্যবহার করতেন।'

ওই ছেলেটির সঙ্গে তার সঙ্গে ভীষণ ভাব হয়েছিল। অতি বৃদ্ধ বয়সে ক্যামেরাটির কথা মনে করতে পারলেও প্রিয় বন্ধুটির নাম মনে করতে না পারায় তিনি মাঝেমাঝে দুঃখ করতেন। ছবিটি ড্যাডির ওই বন্ধুর তোলা কি না, তা নিয়ে গবেষণা, আলাপ-আলোচনা হতে পারে।

ড্যাডির তোলা যুদ্ধের ছবিগুলো গভীর আবেগ ধরা। কম্পোজিশনও সরল। আসলে সরলতাই হচ্ছে শিল্পের সৌন্দর্য। এই সরলতাকে তিনি বহু সাধনায় রপ্ত করেছেন। ড্যাডির ছবিগুলো দেখলে বোঝা যায় তিনি নিজেও ছিলেন এক সরল মানুষ। আর এই সরল হৃদয় দিয়ে তিনি সৃষ্টি করে গেছেন অসাধারণ সব শিল্পকর্ম।

সাহাদাত পারভেজ: আলোকচিত্রী, গবেষক ও শিক্ষক
[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Rampal fouling 2 Sundarbans rivers

The Rampal power plant began operation in late 2022 without an effluent treatment plant and has since been discharging untreated waste into the Pasur and Maidara rivers next to the Sundarbans.

4h ago