করোনায় অকালমৃত্যুতে ২ কোটি ৮১ লাখ বছর হারিয়েছে: অক্সফোর্ড গবেষণা

(বামে) ২০২০ সালের নভেম্বরে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গের কাছে করোনায় মৃতদের জন্য নির্দিষ্ট কবরস্থানে পিপিই পরা কবর খননকারীরা একটি কফিন নামাচ্ছেন। ছবি: রয়টার্স ও (ডানে) গবেষণা দলের প্রধান অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নাফিল্ড ডিপার্টমেন্ট অফ পপুলেশন হেলথের রিসার্চ ফেলো ড. নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

দুর্ঘটনা, অগ্নিকাণ্ড, আত্মহত্যা এমনকি বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছরই মানুষের অকালমৃত্যু হয়। তবে, করোনাভাইরাসে ২০২০ সালে পৃথিবীর অন্তত ৩১টি দেশে অকালমৃত্যুতে ২ কোটি ৮১ লাখ বছর অপ্রত্যাশিতভাবে হারিয়ে গেছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণার ফলাফলে এ তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণায় মধ্যম ও উচ্চ আয়ের মোট ৩৭টি দেশে ২০২০ সালের মৃত্যুর তথ্য পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করা হয়।

ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল গত বুধবার এটি প্রকাশ করে। গবেষণায় দেখা যায়, ৩৭টি দেশের মধ্যে তাইওয়ান, নিউজিল্যান্ড, ডেনমার্ক, আইসল্যান্ড, নরওয়ে ও দক্ষিণ কোরিয়া ছাড়া অন্যান্য দেশগুলোতে ২০২০ সালে প্রত্যাশিত হিসাবের চেয়ে অতিরিক্ত অকালমৃত্যু হয়েছে।

অকালমৃত্যুতে একজন মানুষের প্রত্যাশিত আয়ুষ্কালের কিছুটা হারিয়ে যায়। গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর ২০২০ সালের করোনাসহ সব অকালমৃত্যুর ঘটনা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এর মধ্যে করোনায় অকালমৃত্যুর ঘটনায় গড় আয়ুষ্কাল থেকে হারানো বছরগুলো যোগ করে মোট অপ্রত্যাশিত হারানো বছরের হিসাব দেখানো হয়েছে ফলাফলে।

অতিরিক্ত অকালমৃত্যুর সর্বোচ্চ হার ছিল রাশিয়া, বুলগেরিয়া, লিথুয়ানিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে। এতে গড় আয়ুষ্কালের (লাইফ এক্সপেকটেন্সি) সর্বোচ্চ পতনও হয়েছে রাশিয়ায় (পুরুষ ২.৩৩ ও নারী ২.১৪ বছর)। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র (পুরুষ ২.২৭ ও নারী ১.৬১ বছর), বুলগেরিয়া (পুরুষ ১.৯৬ ও নারী ১.৩৭ বছর), লিথুয়ানিয়া (পুরুষ ১.৮৩ ও নারী ১.২১ বছর), চিলি (পুরুষ ১.৬৪ ও নারী ০.৮৮ বছর) এবং স্পেনেও গড় আয়ুষ্কাল (পুরুষ ১.৩৫ ও নারী ১.১৩ বছর) অনেকখানি কমেছে।

গবেষকরা বলছেন, কোভিডে কেবল অতিরিক্ত মৃত্যুর গণনা নয়, অকালমৃত্যু বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায় এটি শতাব্দীর অন্যতম ভয়াবহ জনস্বাস্থ্য সংকট।

২০২০ সালের জুন মাসে এ গবেষণা শুরু হয়। এর নেতৃত্ব দেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নাফিল্ড ডিপার্টমেন্ট অব পপুলেশন হেলথের রিসার্চ ফেলো ড. নজরুল ইসলাম। বাংলাদেশের রংপুর মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস করা ড. নজরুল এপিডেমিওলজি অ্যান্ড বায়োস্ট্যাটিসটিকসে পিএইচডি করেছেন ব্রিটিশ কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে। সম্প্রতি তার সঙ্গে যোগাযোগ করে দ্য ডেইলি স্টার।

এ গবেষণার বিষয়ে জানতে চাইলে ড. নজরুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গবেষণা উপযোগী পর্যাপ্ত ডেটা না থাকার কারণে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার বেশিরভাগ দেশকে এ গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি। ব্রাজিল, ভারতের ডেটা ছাড়াই করোনায় অকালমৃত্যুতে ২ কোটি ৮১ লাখ বছর হারানোর তথ্য পেয়েছি।'

ব্রাজিলে করোনায় এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৬ লাখ ১০ হাজার এবং ভারতে ৪ লাখ ৬০ হাজার। যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৭ লাখ ও রাশিয়ায় প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজারেরও বেশি লোকের মৃত্যু হয়েছে।

ড. নজরুল জানান, গবেষণার ৩৭টি দেশের ২০০৫ সাল থেকে ২০১৯ সালের মৃত্যু, অকালমৃত্যু এবং গড় আয়ুষ্কাল পরিবর্তনের প্রবণতা পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। এর ভিত্তিতে ২০২০ সালের অতিরিক্ত অকালমৃত্যু ও হারিয়ে যাওয়া বছরের হিসাব বের হয়েছে।

তিনি বলেন, 'আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্ট্যান্ডার্ড লাইফ টেবিল ও লি কার্টার মডেল ব্যবহার করে অকালমৃত্যুতে হারিয়ে যাওয়া বছর ও কমে যাওয়া আয়ুষ্কালের হিসাব করেছি। মানুষের জন্মের পর থেকে প্রতি বছরের জন্য পৃথক লাইফ এক্সপেকটেন্সি বা গড় আয়ুষ্কালের উল্লেখ আছে স্ট্যান্ডার্ড লাইফ টেবিলে।'

করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরুর দিকে বয়স্ক ও অসুস্থদের মৃত্যুহার বেশি থাকলেও, একসময় কমবয়সীদেরও মৃত্যুঝুঁকি বাড়তে থাকে।

২০০৫ সাল থেকে ২০১৯ পর্যন্ত পর্যবেক্ষণে বেশিরভাগ দেশে মৃত্যুতে হারানো আয়ুর পরিমাণ কমের দিকে ছিল। ২০২০ সালে এসে তাইওয়ান ও নিউজিল্যান্ড ছাড়া বাকি সব দেশে অকালমৃত্যু বেড়ে যায়। এতে বাড়তে থাকে হারানো বছরের পরিমাণ।

গবেষকরা জানান, ২০২০ সালে অন্তত ৩১টি দেশে মৃত্যুতে ২২ কোটি ২০ লাখ বছর হারিয়েছে। এর মধ্যে করোনা মহামারির কারণে হারিয়েছে অতিরিক্ত ২ কোটি ৮১ লাখ বছর।

দেশগুলোতে বিভিন্ন বয়সীদের মৃত্যুর সংখ্যা বিশ্লেষণ করে জীবন থেকে হারানো বছর (ইয়ার্স অফ লাইফ লস্ট) হিসাব করা হয়েছে গবেষণায়, যেখানে মানবজাতির ওপর কোভিডের আরেকটি মারাত্মক প্রভাব বেরিয়ে এসেছে।

গবেষণায় অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে ছিল-কানাডা, গ্রিস, স্কটল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, হাঙ্গেরি, আইসল্যান্ড, ইসরায়েল, ইতালি, ডেনমার্ক, ইংল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, ক্রোয়েশিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, স্লোভাকিয়া ও স্লোভেনিয়া।

এ গবেষণায় বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করা যেত কি না, জানতে চাইলে গবেষক ড. নজরুল ইসলাম জানান, পর্যাপ্ত ডেটা না থাকার কারণে বাংলাদেশকে এ গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত যায়নি। তিনি বলেন, 'বাংলাদেশে করোনার কারণে অতিরিক্ত প্রাণহানি হয়েছে কি না, গবেষণা ছাড়া সেটা বলা মুশকিল। ডিজিটাল প্রযুক্তিতে সম্প্রতি বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। আশা করি বাংলাদেশ থেকে শিগগির জন্ম-মৃত্যুর মতো জরুরি পরিসংখ্যান পাওয়া সম্ভব হবে।'

Comments

The Daily Star  | English

22 sectors still pay wages below poverty line

At least 22 sectors in Bangladesh continue to pay their workers much less than what is needed to meet basic human needs.

4h ago