দুর্নীতিবাজরা ‘সুরক্ষা’ পায়

মহামারির এই সময়ে করোনা পরীক্ষা থেকে শুরু করে মাস্ক ও যন্ত্রপাতি কেনায় অনিয়মসহ স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন দুর্নীতির সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশ পেলেও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।
(উপরের সারিতে বা থেকে) অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ, অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম, (নিচের সারিতে বা থেকে) অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব, অধ্যাপক ইহতেশামুল হক এবং ড. ইফতেখারুজ্জামান। ছবি: সংগৃহীত

মহামারির এই সময়ে করোনা পরীক্ষা থেকে শুরু করে মাস্ক ও যন্ত্রপাতি কেনায় অনিয়মসহ স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন দুর্নীতির সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশ পেলেও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।

দু-একটি ঘটনায় নামমাত্র ব্যবস্থা নেওয়া হলেও প্রভাবশালীরা রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

গতকাল বুধবার প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন বলা হয়, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১৫টি করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে অনিয়মের কারণে সরকারের প্রায় ৩০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশের মহা হিসাবনিরীক্ষক নিয়ন্ত্রক (সিএজি)।

অনিয়মগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, চিকিৎসা উপকরণ হাসপাতাল থেকে হারিয়ে গেছে, সরঞ্জাম বুঝে না পেলেও ঠিকাদারকে বিল দেওয়া হয়েছে, চিকিৎসক-নার্সদের কোয়ারেন্টিনে রাখার জন্য একটি হাসপাতাল হোটেল মালিককে চুক্তির চেয়েও বেশি দরে বিল দেওয়া হয়েছে, খাবারের বিল দেওয়া হয়েছে অস্বাভাবিক বেশি এবং নিয়ম না থাকলেও সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের চেয়ে বেশি দরে ওষুধ কেনা হয়েছে।

সিএজির প্রতিবেদন অনুযায়ী যেসব হাসপাতালে বেশি অনিয়ম হয়েছে সেগুলো হলো, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা ডেন্টাল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল।

স্বাস্থ্যখাতের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি বারবার প্রকাশ পেলেও কেন এই খাতের দুর্নীতি কমছে না বা বন্ধ হচ্ছে না এবং অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কিনা জানাতে দ্য ডেইলি স্টার মুঠোফোনে কথা বলেছে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির অন্যতম সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব, বিএমএর বর্তমান মহাসচিব অধ্যাপক ডা. ইহতেশামুল হক ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের সঙ্গে।

তাদের সবাই জানান, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না বলেই এই খাতে দুর্নীতি বেশি হচ্ছে।

অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, 'স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম, দুর্নীতি নতুন কিছু নয়। এগুলো যুগ যুগ ধরে চলছে। তবে করোনা এসে এগুলোকে উন্মোচিত করেছে।'

তিনি বলেন, 'এই খাতে দুর্নীতি বন্ধের জন্য ব্যক্তি বিশেষে ব্যবস্থা নিয়ে কোনো লাভ হবে না। পুরো সিস্টেমটাকেই ঢেলে সাজাতে হবে। ঢেলে না সাজালে স্বাস্থ্য খাতের অদক্ষতা, অনিয়ম ও দুর্নীতি থেকে বের হয়ে আসা কঠিন হবে।'

'আমাদের দেশে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কোনো সময়েই ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি এবং এখনও হচ্ছে না। তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার,' তিনি বলেন।

অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, 'স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি বন্ধ করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না। একজন দুর্নীতি করলে তার বিরুদ্ধে শুধু ব্যবস্থা নিলেই দুর্নীতি বন্ধ হবে না। দুর্নীতি যাতে না হয় সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু কেউ এদিকে নজর দিচ্ছে না।'

তিনি বলেন, 'আমাদের এমন কোনো খাত নেই যেখানে দুর্নীতি হয় না। দুর্নীতিবাজদের নির্মূল করতে হলে ওপর থেকে উদ্যোগ নিতে হবে। নিচের কেউ দুর্নীতি নির্মূলে চেষ্টা করলে দেখা যাবে যে তারই চাকরি চলে যাবে বা তাকে অন্য কোথাও বদলি করা হবে।'

ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, 'দুর্নীতির অভিযোগে অনেকের নাম প্রকাশ পায়, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের জন্য আইন এক ধরনের আর বড় বড় মানুষদের জন্য আইন আরেক ধরনের। সব কিছু এক নিয়মে চললে দুর্নীতি বন্ধ হতো।'

'সরকারের সব সেক্টরের দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) আরও শক্তিশালী করতে হবে। কিন্তু দেশে দুদককে মূলত একটি নমুনা হিসেবে রাখা হয়েছে। যাতে বলা যায় যে আমাদের একটি দুদক আছে,' তিনি বলেন।

বিএসএমএমইউ সাবেক এই উপাচার্য বলেন, 'সরকার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিচ্ছে না বলেই স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না। কোনো কিছুর সঙ্গে দলীয় নাম জড়িয়ে দিলে যে কেউ স্বাচ্ছন্দ্যে দুর্নীতি করতে পারে। যখন সে ধরা পড়ে তখন মানুষকে দেখাতে তাকে দলের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু তার আগে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।'

'প্রত্যেক বিভাগকেই দুর্নীতি বন্ধে কাজ করতে হবে। প্রত্যেকে নিজ নিজ জায়গা থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ করলে তবেই দুর্নীতি বন্ধ হবে। কোনো দুর্নীতি হলে তার বিরুদ্ধে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি স্কুল-কলেজ পর্যায়ে এই বিষয়ে পাঠদান করতে হবে,' তিনি বলেন।

অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, 'আমাদের পুরো সিস্টেমটাই দুর্বৃত্তায়িত। এই সিস্টেমে দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব না। দুর্নীতিবাজরা জেনে গেছে যে, এই সিস্টেমে দুর্নীতি করে পার পাওয়া যায়। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যে সিস্টেম চালু করা দরকার তা কেউ করছে না। কারণ স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির ফলে অনেকেই লাভবান হচ্ছে।'

তিনি বলেন, 'স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির জন্য সরকার এবং ডোনার এজেন্সিগুলো দায়ী। সরকার বিভিন্ন প্রফেশনাল বডিগুলোকে তাদের অঙ্গ সংগঠন বানিয়েছে। অঙ্গ সংগঠন তো আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলবে না।'

'আইন ও তদারকি ব্যবস্থা ভালোভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। সরকার একটি কমিটি গঠন করতে পারে যেখানে বিভিন্ন পেশার বিশেষজ্ঞরা থাকবে। তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে কাজ করতে হবে। আমরা কিভাবে এগিয়ে যাব তার একটি পরিকল্পনা করতে হবে,' তিনি বলেন।

বিএমএর মহাসচিব অধ্যাপক ডা. ইহতেশামুল হক বলেন, 'যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আসে আজ পর্যন্ত তাদের কাউকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয়নি। জবাবদিহিতার আওতায় না আনতে পারলে এমন চলতেই থাকবে। যখন কেউ দেখছে এখানে দুর্নীতি করলে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না, এখানে পার পাওয়া যায়, তখনি সে বেপরোয়া হয়ে ওঠে।'

তিনি বলেন, স্বাস্থ্য খাতে এখন জরুরি ভিত্তিতে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে কিছুটা ব্যত্যয় হতেই পারে। কিন্তু ব্যত্যয় মানে এটা না যে, ১০ টাকার জিনিস ৫০ টাকা হবে। একক কোনো ব্যক্তিকে দায়ী করা যাবে না। বিভিন্ন ধাপে এখানে দুর্নীতি হয়। বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কেনাকাটার প্রক্রিয়া সঠিকভাবে নেওয়া হয় না তাই দুর্নীতি বেশি হয়।'

বিএমএর মহাসচিব আরও বলেন, 'যারা দুর্নীতি করেন তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। দুর্নীতি করলে জড়িতদের বদলি করা হয়। এটা আসলে কোনো শাস্তি না। এখন পর্যন্ত কোনো জড়িতদের বিরুদ্ধে তেমনভাবে শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে আমার চোখে পড়েনি।'

'স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি বন্ধে সরকার একটি কমিশন করতে পারে। সেই কমিশন বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের, যেমন হেলথ ইকোনোমি নিয়ে যারা কাজ করেন, যেসব সাংবাদিক স্বাস্থ্য বিট কাভার করেন, ডাক্তার-নার্সদের নিয়ে যারা কাজ করেন এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে পরামর্শ করে সরকারকে বিভিন্ন বিষয়ে সুপারিশ করবে এবং সরকার তা বাস্তবায়িত করবে। স্বল্প মেয়াদী, মধ্য মেয়াদী ও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে,' তিনি বলেন।

তিনি বলেন, 'সঠিক মানুষকে সঠিক জায়গায় বসাতে পারলে এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারলে তবেই এই খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব।'

টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'যেসব ব্যবস্থা নিলে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি বন্ধ হবে সেসব ব্যবস্থা আসলে নেওয়া হচ্ছে না। যারা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত তাদের চিহ্নিত করে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে এবং যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দুর্নীতি প্রতিরোধে যে আইন বা নীতিমালাগুলো আছে সেগুলো মানা হচ্ছে না বলেই দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না।'

তিনি বলেন, 'মূলত ত্রিমুখী আতাতে এই খাতে দুর্নীতি হচ্ছে। এর সঙ্গে জড়িত সরকারি প্রতিষ্ঠান, ঠিকাদার এবং প্রভাবশালী মহল। এই আঁতাত ভাঙতে না পারলে দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব নয়।'

তিনি আরও বলেন, 'দুর্নীতি প্রতিরোধ না করে মূলত দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন করলে বা বিভিন্ন মাধ্যমে লেখালেখি করলে সরকার তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং যারা দুর্নীতি নিয়ে লেখালেখি করে তাদেরকে নাজেহাল করে। সরকার মূলত দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ না করে দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ নিয়ন্ত্রণ করছে। যারা দুর্নীতি করে, বাস্তবে সরকার তাদের সুরক্ষা দিচ্ছে।'

তিনি বলেন, 'দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। অনেক সময় ছোটোখাটো কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, কিন্তু এর সঙ্গে যে অন্যান্য প্রভাবশালীরা জড়িত থাকে তাদেরকে ছাড় দেওয়া হয়। জড়িত সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি বন্ধ হবে।'

Comments

The Daily Star  | English

The story of Gaza genocide survivor in Bangladesh

In this exclusive interview with The Daily Star, Kamel provides a painful firsthand account of 170 days of carnage.

1d ago