সংক্রমণ মোকাবিলায় আরও বেশি প্রস্তুত, তবে ঝুঁকিমুক্ত নয়

ছবি: স্টার

২০২১ সালে দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল কোভিড-১৯ টিকা সরবরাহ নিশ্চিত করা। চ্যালেঞ্জ ছিল জনসংখ্যার বিশাল একটি অংশকে টিকা দেওয়া এবং সংক্রমিতদের জন্য শয্যা, আইসিইউ শয্যা ও পর্যাপ্ত অক্সিজেন নিশ্চিত করা।

ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কারণে বাংলাদেশ এখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় আরও বেশি প্রস্তুত। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন এখনো ঝুঁকিমুক্ত নয় বাংলাদেশ।

কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির সদস্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কার বিষয়ে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সংক্রমণের হার যদি ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের মতো হয়, তাহলে সংকট ততটা গুরুতর হবে না। তবে, ভয় থেকে যায়।'

সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রিদওয়ানুর রহমান ২০২১ সালে স্বাস্থ্যখাতে অর্জন ও ব্যর্থতার বিষয়ে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অক্সিজেন উৎপাদন ও সরবরাহ পরিস্থিতি এখন অনেক ভালো। তবে সবকিছু কার্যকরী পর্যায়ে রাখা চ্যালেঞ্জের হবে।'

তিনি সতর্ক করে বলেন, 'ওমিক্রন সম্ভবত আগামী বছরের শুরুর দিকে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার ওপর চাপ সৃষ্টি করতে শুরু করবে।'

করোনার প্রথম ঢেউয়ের পর মৃত্যু, শনাক্ত ও সংক্রমণের হার কম ছিল। ২০২১ সালে এক ধরনের স্বাভাবিকতার আশা নিয়ে নতুন বছর শুরু হয়।

এরপর ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে টিকাদান কর্মসূচি শুরু হলে দেশের জনগণ, অর্থনীতি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো কিছুটা স্বাভাবিক হতে শুরু করে।

তবে সেটা আর হয়ে ওঠেনি। অন্তত কয়েক মাসের জন্য, কারণ সরকার কার্যত একমুখী পরিকল্পনা নিয়ে বসেছিল। ভারত থেকে টিকা সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় এবং এপ্রিলের মধ্যে টিকাদান কর্মসূচি ব্যাহত হয়। মে মাসে ডেল্টা ভেরিয়েন্টের উত্থানের সঙ্গে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে উঠে।

অবশেষে, চীনসহ বিভিন্ন উৎস থেকে টিকা সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ে। অক্সিজেনের সংকট চরম আকার ধারণ করে, মানুষ মারা যেতে থাকে, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় সরকারের অযোগ্যতা ও সময়মতো প্রকল্প ব্যবস্থাপনার অযোগ্যতা আবারও প্রকাশ পায়।

অধ্যাপক নজরুল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রাথমিকভাবে টিকা সরবরাহ, ডেল্টা ভেরিয়েন্টের সংক্রমণ ও হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা নিয়ে সংকট ছিল।'

এখন ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ৭ জন ওমিক্রনে আক্রান্ত হওয়ার সংবাদ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া, বিশেষজ্ঞরা সামনের কঠিন পরিস্থিতির বিষয়ে সতর্ক করেছেন।

টিকাদান কর্মসূচি

সিরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার (এসআইআই) উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড দিয়ে ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়ার কর্মসূচি শুরু হয় ফেব্রুয়ারিতে।

প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সরবরাহ না করায় টিকা স্বল্পতার কারণে কয়েক দফা বাধার সম্মুখীন হয় টিকাদান কর্মসূচি। এরপর ২৬ এপ্রিল থেকে ২ ডোজের প্রথমটি বন্ধ রাখতে বাধ্য হয় সরকার।

ধীরে ধীরে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও জাপান থেকে টিকা সরবরাহে পরিস্থিতির উন্নতি হয়। ১৯ জুন থেকে সরকার আবারও প্রথম ডোজের টিকা দিতে শুরু করে। তবে, ওই টিকার বেশিরভাগ অংশই চীন থেকে কেনা হয়েছিল।

২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৪ কোটি ৮৭ লাখ মানুষ ২ ডোজ টিকা পেয়েছেন। যা লক্ষ্যমাত্রার ২৮ শতাংশ।

এ ছাড়া, গত ২৮ ডিসেম্বর থেকে বুস্টার ডোজও চালু করা হয়েছে।

ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট

ফেব্রুয়ারি থেকে দেশে দৈনিক সংক্রমণ ও মৃত্যুহার ক্রমাগত কমতে শুরু করে। মানুষ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার আশা করতে থাকে এবং সরকার মার্চের মাঝামাঝি থেকে বন্ধ হয়ে যাওয়া স্কুলগুলো আবারও চালু করার চিন্তা করে।

তবে, দেশব্যাপী স্বাস্থ্য সুরক্ষার নির্দেশিকা উপেক্ষার কারণে মার্চ থেকে আবারও সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে।

প্রাথমিকভাবে ৫ থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয় এবং তারপর পর্যায়ক্রমে সেটা বাড়ানো হয়।

এপ্রিলের শেষের দিকে সংক্রমণ কিছুটা কমতে শুরু করে। তবে, পরবর্তী কয়েক মাস পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে চলে যায়।

১ জুলাই থেকে লকডাউন কার্যকর করা সত্ত্বেও ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং মানুষ আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে থাকে। ২৮ জুলাই সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ২৩০ জনের করোনা শনাক্ত হয়। ৫ ও ১০ আগস্ট দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ২৬৪ জন, যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ।

ওই সময়, দেশের হাসপাতালগুলো তার সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছায়। জুলাইয়ের শেষ নাগাদ সারা দেশে ৯০ শতাংশ আইসিইউ শয্যা ও ৮০ শতাংশের বেশি সাধারণ শয্যায় রোগী ছিল।

স্থানীয়ভাবে প্রতিদিন অক্সিজেনের উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ১২০ টনের মতো। তবে, হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিনের অক্সিজেনের চাহিদা বেড়ে দাঁড়ায় ২১০ টনে।

সরকার তখন হাসপাতালগুলোতে বিল্ট-ইন অক্সিজেন ব্যবস্থা স্থাপনের পরিকল্পনা করে ব্যর্থ হয়। হাই-ফ্লো অক্সিজেন সরবরাহকারী যন্ত্রের ঘাটতি ছিল, যার ফলে ৩০ জুন থেকে ৭ জুলাইয়ের মধ্যে সাতক্ষীরা, রাজশাহী ও বগুড়ায় কমপক্ষে ১৬ রোগীর মৃত্যু হয়।

২০২১ সালের ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত করোনায় যে ২৮ হাজার ৬২ জনের মৃত্যু হয় তার প্রায় ৫৮ শতাংশ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণের পর।

গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা

মহামারিতেও থেমে নেই স্বাস্থ্য বিভাগের অনিয়ম।

গত ২০ সেপ্টেম্বর লিখিত পরীক্ষার উত্তরপত্রে অস্পষ্টতার কারণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, টেকনিশিয়ান ও কার্ডিওগ্রাফার পদে ২ হাজার ৮৩৯ জনকে নিয়োগের প্রক্রিয়া বাতিল করে।

সীমিত সংখ্যক কর্মী নিয়ে মানসম্পন্ন সেবা দিতে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে স্বাস্থ্য বিভাগ।

২৮ অক্টোবর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ১৭টি গুরুত্বপূর্ণ নথি নিখোঁজ হয়। যার বেশিরভাগই কেনাকাটা সম্পর্কিত।

এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি গঠন করে এবং কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ৪ কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তবে, ফাইল গায়েব হয়ে যাওয়ার পেছনের কারণ এখনো রহস্যে ঘেরা।

Comments

The Daily Star  | English

Over 14 million people could die from US foreign aid cuts: study

USAID had provided over 40 percent of global humanitarian funding until Trump returned to White House

9m ago