ঢামেকের 'অপরিষ্কার' লন্ড্রি

চিকিৎসা নিতে সারাদেশের মানুষ ভীড় জমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তথ্য মতে, ২ হাজার ৬০০ শয্যার এ সরকারি হাসপাতালে নিয়মিত প্রায় ৪ হাজার রোগী ভর্তি থাকেন।
ছবি: শাহীন মোল্লা

চিকিৎসা নিতে সারাদেশের মানুষ ভীড় জমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তথ্য মতে, ২ হাজার ৬০০ শয্যার এ সরকারি হাসপাতালে নিয়মিত প্রায় ৪ হাজার রোগী ভর্তি থাকেন।

এ রোগীদের বিছানার চাদর, ডাক্তার-নার্সদের অ্যাপ্রন ও অপারেশনের চাদরসহ প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার হাসপাতালের কাপড় ওয়ার্ড এবং অপারেশন থিয়েটার থেকে সংগ্রহ করে ধুয়ে শুকানো হয়। চাহিদা মেটাতে ২৪ ঘণ্টাই চলে এ কাজ।

কিন্তু আকার ও অনুপাতে হাসপাতালটির লন্ড্রি সেবা এখনও সেকেলে রয়ে গেছে। হাসপাতালে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা দরকার হলেও, এ লন্ড্রি তা করতে পারছে না।

নিউক্লিয়ার মেডিসিন ভবন এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গের পাশে অবস্থিত লন্ড্রিটি ১৯৪০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে স্থাপন করা হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালটি অনেক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে, উন্নত হয়েছে এবং এর বিভিন্ন সার্ভিস উন্নত করেছে। তবে লন্ড্রি পদ্ধতিতে কোনো উন্নতি দেখা যায়নি। এখনও মানব শ্রমের ওপর নির্ভর করে এ সার্ভিস চলে। জনবলের ঘাটতির কারণে সেটিও মানসম্মত না।

লন্ড্রিটি সকাল ৬টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত খোলা থাকে। সেখানে কাজ করেন ১০ জন। তারাই কাপড় সংগ্রহ করেন এবং ধুয়ে শুকান। মাত্র ১০ জন লোক সেকেলে পদ্ধতিতে এত বেশি কাজ করার কারণে, হাসপাতালের রোগী ও কর্মীদের কাছ থেকে কাজের গুণমান নিয়ে ক্রমাগত অভিযোগ আসে। স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে অভিযোগ ওঠে।

প্রায়ই চাদরে দাগ থাকার এবং ছিঁড়ে যাওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়।

ধোয়ার প্রক্রিয়া

ছবি: শাহীন মোল্লা

কম জনবল নিয়ে কাজ করার কারণে কর্মীদেরও কষ্ট হচ্ছে। সপ্তাহে ৬ দিন শিফটে এবং অস্থায়ী ভিত্তিতে ঠিকাদারের মাধ্যমে কাজ করে প্রতি মাসে তারা ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা আয় করেন।

এমন একজন কর্মী ময়মনসিংহের সাদ্দাম।

তিনি গত মার্চ মাসে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছিলেন, 'আমি আমার পরিবারের খরচ চালানোর জন্য মহামারির মধ্যে চাকরি খুঁজছিলাম। পরিচিত একজন ঠিকাদারের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার পর আমি এখানে কাজ শুরু করি।'

সাদ্দাম জানান, সকালে কাজ শুরু করতে হয় বলে সবাই কাছাকাছি থাকেন। এর মধ্যে ৫ জনের কাজ ভোর ৬টা থেকে শুরু হয়। তারা বিভিন্ন ওয়ার্ড, ওটিতে গিয়ে ব্যবহৃত কাপড় সংগ্রহ করে বস্তায় ভরে রাখেন।

'তারপর আমরা ট্রলি ব্যবহার করে সেগুলো লন্ড্রির জায়গায় নিয়ে যাই। মাঝেমাঝে আমাদের মাথায় করে বস্তা নিয়ে যেতে হয়', সাদ্দাম বলেন। 

এক মাসে একাধিকবার ঢামেক পরিদর্শনের সময় দ্য ডেইলি স্টারের সংবাদদাতারা দেখেছেন, ওটি থেকে সংগ্রহ করা বেশিরভাগ কাপড় রক্তের দাগযুক্ত।

এ ছাড়া, কোন কাপড় কোন বিভাগ বা ওয়ার্ডের, তা নির্দিষ্ট করার জন্য কোনো চিহ্ন থাকে না। বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে সংগৃহীত সব কাপড় একসঙ্গে মিশে যায়।

লন্ড্রির কর্মীরা গ্লাভস বা মাস্ক ব্যবহার করেন কি না জানতে চাইলে জবাবে 'না' বলেন সাদ্দাম। 

কর্মীরা জানান, কাপড়গুলো লন্ড্রিতে নিয়ে যাওয়ার পর সেগুলো ডিটারজেন্ট ও পানি ভর্তি বিশাল পাত্রে সেদ্ধ করা হয়। ধোয়ার জন্য ব্লিচিং পাউডার, ওয়াশিং সোডা ও ডিটারজেন্ট ব্যবহার করেন তারা।

তারপর কাপড়গুলো ধোয়ার জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। যেখানে অন্তত ৫ জন লোক বড় ট্যাংকে ডিটারজেন্ট মিশ্রিত পানিতে ধুয়ে ফেলেন। এরপর সীমানা প্রাচীরের পাশে তার ও দড়িতে বা হাসপাতালের ভেতরের কোনো খোলা জায়গায় এসব কাপড় শুকানো হয়।

পরে লন্ড্রিতে নিয়ে এগুলো ভাঁজ করে হাসপাতালের ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হয়।

স্বাস্থ্য ঝুঁকি, জনশক্তি সংকট

ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্লিচিং পাউডার ও ডিটারজেন্ট মিশ্রিত পানির সংস্পর্শে থাকায় কর্মীদের ক্ষতি হচ্ছে।

কর্মীদের অনেকেই জানান, তারা প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়েন। কাজটি কঠোর পরিশ্রমের হওয়ায়, ক্রমাগত লোকবল পরিবর্তিত হতে থাকে।

নিজেকে গোপালগঞ্জের একটি কলেজের অনার্সের ছাত্র হিসেবে পরিচয় দিয়ে সালমান মোল্লা নামের একজন জানান, পরিবারের ভরণপোষণের খরচ জোগানোর জন্য গত বছর তিনি এ চাকরি শুরু করেন।

পরিচ্ছন্নতার অভাব এবং চাদর ছিঁড়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কারণ হিসেবে কাজের চাপের কথা উল্লেখ করেন।

ঢামেক লন্ড্রিতে ৭ বছর ধরে কর্মরত আবুল হোসেনও (৪২) একই কথা বলেন।

'আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করি। কিন্তু কাজের চাপ সামলানোর জন্য আমাদের যথেষ্ট মানুষ নেই', যোগ করেন তিনি।

ঠিকভাবে ধোয়া হয় না

হাসপাতালের অনেক কর্মচারী অভিযোগ করেছেন, ধোয়া ও পরিষ্কারের এ পদ্ধতিটি পুরানো। এ পদ্ধতিতে সঠিকভাবে কাপড় পরিষ্কার হচ্ছে না।

লন্ড্রি ব্যবস্থা উন্নত করার দাবি জানান তারা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন নার্স সুপারভাইজার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মাঝেমাঝে রক্ত ও অন্যান্য দাগ চাদরে থেকে যায়। পরিষ্কারের জন্য সেগুলো ফেরত পাঠাতে হয়। অনেক জায়গায় ছিঁড়েও যায়। অনেক সময় অ্যাটেন্ডেন্ট বা রোগীরাও আমাদের বিছানার চাদর পাল্টে দিতে বলেন।'

আরেকজন সিনিয়র নার্স জানান, বেশিরভাগ সময় তাদেরকেই এ ঝামেলা সহ্য করতে হয়। কারণ রোগী ও অ্যাটেন্ডেন্টরা তাদেরই দোষ দেন।

তিনি বলেন, 'যদি আমাদের একটি ওয়াশিং প্ল্যান্ট থাকত, তাহলে এ সমস্যা থাকত না।'

নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডের রোগী হানিফ মিয়া ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি গত ২ সপ্তাহ ধরে এখানে ভর্তি। বিছানার চাদর নোংরা হয়ে গেলেও ২-৩ দিন পর পাল্টে দেওয়া হয়। প্রায়ই দেখা যায়, সেগুলো পরিষ্কার না। আমি বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছি।  কিন্তু কোন লাভ হয়নি।'

হাসপাতালের পুরনো ভবনের কেবিন ব্লকের কয়েকজন রোগীও চাদর ঠিকমত পরিষ্কার না হওয়ার কথা জানান।

বারবার চেষ্টা করেও ডেইলি স্টার লন্ড্রিতে জনবলের দায়িত্বে থাকা ঠিকাদারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি।

তবে, এ সংবাদদাতারা সম্প্রতি ঠিকাদার প্রতিনিধি মোহাম্মদ জুয়েলের সঙ্গে দেখা করেন। নিজেকে ঠিকাদারের সহকারী হিসেবে উল্লেখ করেন জুয়েল।

জনবল সংকটের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, 'আগে আমাদের ১৫ জন কর্মী ছিল। কিন্তু কেউ কেউ চলে গেছেন। আমিসহ ১১ জন এখানে কাজ করছি। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করি। যদি কোনো দাগ দেখি বা নোংরা কাপড় দেখতে পাই, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো পরিষ্কার করি।'

'আমরা জনবল বাড়ানোরও চেষ্টা করছি, যোগ করেন তিনি।

করোনা ওয়ার্ডের জন্য ওয়াশিং প্লান্ট

এমন নয় যে ঢামেক হাসপাতালে কাপড় ধোয়ার আধুনিক কোনো সুবিধা নেই। হাসপাতালের করোনাভাইরাস ওয়ার্ডের কাপড় পুরনো লন্ড্রির পাশে অবস্থিত একটি ওয়াশিং প্ল্যান্টে পাঠানো হয়।

ওয়াশিং প্লান্টের সুপারভাইজার চয়ন দাস বলেন, 'তারা দিনে প্রায় ৩০০ কাপড় ধুতেন। এখন প্রতিদিন প্রায় ২০০ কাপড় ধুয়ে থাকেন। ২ জন অস্থায়ী কর্মী ও  ২ জন হাসপাতালের কর্মী– মোট ৪ জন এ প্ল্যান্টে কাজ করেন।'

প্রায় ২ বছর আগে তারা ঢামেকে প্ল্যান্টটি স্থাপন করেছেন বলে জানান তিনি।

কর্মকর্তারা যা বললেন

শ্রমিকসহ যারা কাপড় ব্যবহার করছেন তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. সুলতানা শাহানা বানু বলেন, 'কাপড় সংগ্রহ, ধোয়া ও বিতরণের সময় কর্মীদের অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।

'যদি তারা নিয়মগুলো অনুসরণ না করে, তবে অবশ্যই স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকবে,' তিনি যোগ করেন।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ঢামেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক জানান, তারা ধোয়ার প্রক্রিয়াটি বাইরের লোকজনকে দিয়েছেন এবং তিনি সরাসরি এর সঙ্গে জড়িত নন।

তবে এ বিষয়ে বড় ধরনের কোনো অভিযোগ শোনেননি জানিয়ে তিনি বলেন,'আমরা সেবার মান উন্নত করার চেষ্টা করছি। যেমন, আমরা করোনা ওয়ার্ডের কাপড় এভাবে ধুই না। সেগুলোর জন্য আলাদা ওয়াশিং মেশিন ব্যবহার করি।'

'শিগগির সামগ্রিক পদ্ধতি হালনাগাদ করার পরিকল্পনা করছি আমরা,' যোগ করেন তিনি।

অনুবাদ করেছেন জারীন তাসনিম

Comments

The Daily Star  | English
Workers rights vs corporate profits

How some actors gambled with workers’ rights to save corporate profits

The CSDDD is the result of years of campaigning by a large coalition of civil society groups who managed to shift the narrative around corporate abuse.

9h ago