আবুল হাসান: অকালে ঝরে যাওয়া কবির গল্প

আবুল হাসান। ছবি: সংগৃহীত

"মৃত্যু আমাকে নেবে, জাতিসংঘ আমাকে নেবে না, 
আমি তাই নিরপেক্ষ মানুষের কাছে, কবিদের সুধী সমাবেশে"

কে জানতো মাত্র আটাশেই প্রস্থান হবে তার? জাতিসংঘ না নিলেও মৃত্যু ঠিকই নিয়েছিল তাকে। আবুল হাসান কি টের পেয়েছিলেন? ১৯৭০ সালের এশীয় কবিতা প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন।
পড়াশোনায় নিরন্তর অবহেলার পরেও কী দোর্দণ্ড মেধাবী! কেন তা চিরন্তন জীবনের মতো অবহেলা; একটি ঘটনার প্রমাণ দিলেই বোঝা যাবে।

সালটা ১৯৬৫। সে বছরের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় জীববিদ্যার দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষা চলছে। বরিশাল বিএম কলেজ কেন্দ্রে পরীক্ষা দিচ্ছে একটি ছেলে। হঠাৎ পরীক্ষক দেখলেন একটি ছেলে কী যেন ভাবছে। সন্দেহ হলো। কাছে গিয়ে দেখতেই দেখলেন ছেলেটি পরীক্ষার খাতায় না লিখে পাশের সিটের উপরে কবিতা লিখছে। শিক্ষক মুচকি হেসে বললেন, 'পরীক্ষার খাতায় না লিখে কবিতা লিখছ! এক ঘণ্টা যে শেষ হয়ে গেল। তুমি পরীক্ষা দিতে এসেছো তো!' বাকি দু ঘণ্টায় একবারও কারো দিকে না তাকিয়ে মনোযোগ দিয়ে লিখতে লাগলো সেই ছেলে। মজার বিষয় হলো সেদিনের সেই কবিতা লেখা ছেলেটি ঠিকই দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করে উচ্চ মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হয়েছিল।

নিঃসঙ্গতা, আর একাকীত্বকে যে কবিতার ঠাসা বুনটে কী নিপুণ কায়দায় তুলে ধরেছিলেন তিনি। অথচ পাখির মতো উড়নচণ্ডী জীবন ছিল তার, যে পাখি কেবলই উড়বে খোলা আকাশে। জীবন তাকে যেমন দিয়েছে অপার স্বাধীনতা ঠিক তেমনি খুব দ্রুতই কেড়ে নিয়েছে। একটি জীবন উপলব্ধি করার কী দোর্দণ্ড প্রতাপ ছিল তার। বৃষ্টি আর মায়াভরা জীবনের খাঁজে যিনি খুলে দিয়েছিলেন প্রশান্তির দুয়ার।

"নিঃসঙ্গতা" কবিতায় আবুল হাসান যেমন একটি বালিকার অপূর্ণ ইচ্ছা ফুটিয়ে তুলেছিলেন।

'অতটুকু চায়নি বালিকা!
অত শোভা, অত স্বাধীনতা!
চেয়েছিল আরো কিছু কম,
আয়নার দাঁড়ে দেহ মেলে দিয়ে
বসে থাকা সবটা দুপুর, চেয়েছিল
মা বকুক, বাবা তার বেদনা দেখুক!
অতটুকু চায়নি বালিকা!
অত সমাগম!
চেয়েছিল আরো কিছু কম!
একটি জলের খনি
তাকে দিক তৃষ্ণা এখনি, চেয়েছিল
একটি পুরুষ তাকে বলুক রমণী।।'

প্রকৃতি, প্রেম, রাজনীতি সমস্তকেই কখনো একই সঙ্গে ব্যপ্তি দিয়েছেন, "বৃষ্টি চিহ্নিত ভালোবাসা" কবিতায় যেন তারই প্রমাণ।

"মনে আছে একবার বৃষ্টি নেমেছিল? 
একবার ডাউন ট্রেনের মতো বৃষ্টি এসে থেমেছিল 
আমাদের ইস্টিশনে সারাদিন জল ডাকাতের মতো 
উৎপাত শুরু করে দিয়েছিল তারা; 
ছোট খাটো রাজনীতিকের মতো পাড়ায় পাড়ায় 
জুড়ে দিয়েছিল অথই শ্লোগান।"

কবিতায় নিঃসঙ্গতা প্রকাশ পেলেও আবুল হাসান ছিলেন দারুণ আড্ডাবাজ, উড়নচণ্ডী, ভবঘুরে। তাইতো কখনো থিতু হতে পারেননি। ৬৯' এর গণ অভ্যুত্থানের উত্তাল সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে অনার্সে পড়া অবস্থায় ফাইনাল পরীক্ষা না শেষ করেই বের হয়ে যাওয়া, যোগ দিয়েছিলেন দৈনিক ইত্তেফাকের বার্তা বিভাগে। তখন কবিতা পরিপূর্ণ গ্রাস করেছে কবি আবুল হাসানকে। আর তাই কবিতাতেই নিজেকে সম্পূর্ণ সঁপে দিয়েছিলেন তিনি।

দেশ স্বাধীনের পর গণবাংলা পত্রিকায় যোগ দিলেন। সে সময় গণবাংলা পত্রিকায় সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন কবি শহীদ কাদরী। সেখানেই সহ সম্পাদক হিসেবে ঢুকেছিলেন তিনি। গণবাংলা পত্রিকাতে থাকা অবস্থাতেই প্রকাশিত হয়েছিল তার 'রাজা যায় রাজা আসে' কাব্যগ্রন্থ। যেখানে তার প্রথম নিঃসঙ্গতার প্রকাশ।

"পাখি হয়ে যায় প্রাণ" কবিতায় লিখেছিলেন যেন আদ্যোপান্ত নিজেকে।
"অবশেষে জেনেছি মানুষ একা! 
জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা! 
দৃশ্যের বিপরীত সে পারে না একাত্ম হতে এই পৃথিবীর সাথে কোনদিন।"

তবে কবিতার বাইরেও প্রবন্ধ ও সম্পাদকীয় নিবন্ধে ছিল তার অসামান্য দখল। যার প্রমাণ মিলে যখন তিনি আবদুল গাফফার চৌধুরীর সম্পাদিত জনপদ পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক যোগ দিলেন। এই পত্রিকায় "খোলা শব্দে কেনাকাটা" ও "আপন ছায়া" নামের দুটো কলাম ছিল ভীষণ জনপ্রিয়।

বন্ধু নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই গড়ে উঠেছিল গভীর বন্ধুত্ব। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় শেষ দিকে আবুল হাসানের প্রেম গড়ে উঠেছিল ইংরেজি বিভাগের লেকচারার সুরাইয়া খানমের সঙ্গে। সেই প্রেমকে বলা যায় এক অপার মুগ্ধতা। প্রেমিকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ক্যামব্রিজ পড়ুয়া সুরাইয়া খানম। সুরাইয়া খানম চেয়েছিলেন আবুল হাসানকে খানিকটা বশে আনতে। উড়নচণ্ডী জীবনযাপনে খানিকটা লাগাম টানতে। আর তাই সুরাইয়া খানম সহ্য করতে পারতেন না নির্মলেন্দু গুণকেও। তখন আবুল হাসান ও নির্মলেন্দু গুণের বন্ধুত্বে কিছুটা চিঁড় ধরেছিল। 
আর তাই বন্ধুকে অভিমানের ছলে লিখেছিলেন, 'তুমি কি ভুলেই গেলে সেই সব দিনের কথা, যখন শীতের কুয়াশার মধ্যরাত্রির বাতাসকে আমরা সাক্ষী রেখে ঢাকা শহরের অলিগলি চষে বেড়িয়েছি। আমরা তখন কি সুখী ছিলাম না? সেই সুখের কারণেই কি তুমি আবার ফিরে আসতে পারো না? যতই ভালোবাসার পেছনে ধাবমান আমাদের ছায়া এর- ওর সঙ্গে ঘুরুক, তুমি জানো আর আমিও জানি- একসময় আমরাই আমাদের প্রেমিক ছিলাম।' এমন কি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ডাক্তাররা আশা ছাড়লেও সুরাইয়া খানম নাকি আশা ছাড়তে পারেননি।

মাত্র তিনটি কাব্যগ্রন্থ, একটি গল্প সংকলন, একটি কাব্য নাট্য এই হলো আবুল হাসানের প্রকাশিত সাহিত্য সম্ভার। কিন্তু ক্ষুদ্র জীবনে তার কবিতা মোহনীয় চুম্বকীয় শক্তি, তার কবিতায় উঠে আসা মানুষের জীবনের গল্প, শৈশবের স্মৃতি বেদনা, প্রকৃতির চিরচেনা মুগ্ধতা, অন্ধকারের মাঝেও বেঁচে থাকার প্রেরণা, আত্মত্যাগ, দুঃখবোধ, মৃত্যুচেতনা, বিচ্ছিন্নতাবোধ, দৈনন্দিনের অবহেলায় হারিয়ে যাওয়া গল্পগুলো, সম্পর্কের চিরন্তন বাস্তবতা যেন কালোত্তীর্ণ কবির ভাষ্য। যেখানে আমরা পাই নতুন করে বাঁচতে শেখার প্রেরণা। 

তাইতো আবুল হাসান তার বিখ্যাত 'ঝিনুক নীরবে সহো' কবিতায় লেখেন--
'ঝিনুক নীরবে সহো/ 
ঝিনুক নীরবে সহো, 
ঝিনুক নীরবে সহে যাও/ 
ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুঁজে মুক্তা ফলাও!' 
'আবুল হাসান রচনা সমগ্র' এর ভূমিকায় কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন, 'আবুল হাসান মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত কবি, কবি ছাড়া আর কিছুই নন। তাঁর প্রতিটি নিঃশ্বাসে বয়ে গেছে কবিতা। তাঁর এলোমেলো জীবনের ছাপ পড়েছে তার কবিতাতেও। এই এলোমেলোমি তাঁর কবিতার দুর্বলতা এবং শক্তি।'

কবি ও সাহিত্য সমালোচক আবু হেনা মোস্তফা কামাল যেমনটা বলেছিলেন, 'চূড়ান্ত ব্যবচ্ছেদ করলে আবুল হাসানের ভেতরে মায়া ও মমতা, মানুষের জন্যে দুঃখবোধ ছাড়া আর কিছু পাওয়া যাবে না।'

শৈশবের রিউম্যাটিক জ্বরই যে তাকে হৃদরোগে ক্ষয়ে আনবে তা কে ভেবেছিল। একই সঙ্গে উড়নচণ্ডী জীবন, অপরিমিত খাওয়া দাওয়া আর রাতের পর রাত জাগার অভ্যাস তাকে ক্ষয়ে দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে অসুস্থ হয়েও জীবনযাপনে আনেননি নিয়ন্ত্রণ। ফের ১৯৭৪ সালে অসুস্থ হলে তো বন্ধুদের প্রচেষ্টায় ও সরকারি উদ্যোগে তাকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পূর্ব জার্মানিতে। তিনিই ছিলেন প্রথম কোনো কবি যার চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশ সরকার সরকারি খরচে বিদেশে পাঠিয়েছিলেন। সেখানে পরিচয় আরেক কবি ও শিল্পী গেব্রিয়ালের সঙ্গে। একসময় চিত্রশিল্পের প্রতিও তীব্র আকর্ষণ বোধ করেছিলেন। পূর্ব জার্মানিতে চিকিৎসার স্বল্পতা ছিল বলে তাকে পাঠানো হলো চেকস্লোভাকিয়ায়, কিন্তু সেখান থেকে আবার ফের বার্লিন হয়ে ঢাকায়। কিন্তু কবিতা তাকে ত্যাগ করতে পারেনি, কিংবা তিনিও। কবিতাই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল আজীবন, রাখবে অনন্তকাল। 

"অপরূপ বাগান" কবিতায় আবুল হাসান লিখেছিলেন, 
"চলে গেলে- তবু কিছু থাকবে আমার: আমি রেখে যাবো
আমার একলা ছায়া, হারানো চিবুক, চোখ, আমার নিয়তি।' 
আজ কবি আবুল হাসানের জন্মদিন। বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই বাংলা কবিতার এই কালজয়ী কবির প্রতি।

তথ্য সূত্র- 
আবুল হাসান রচনা সমগ্র। 
আবুল হাসান জীবনী গ্রন্থমালা/ বিশ্বজিত ঘোষ

Comments

The Daily Star  | English
road accidents death in Bangladesh April

Road accidents killed 583 in April: Jatri Kalyan Samity

Bangladesh Jatri Kalyan Samity (BJKS), a passenger welfare platform, said that a total of 583 people were killed and 1,202 injured in 567 road accidents across the country in the month of April, citing media reports

5h ago