লেক্সিংটন শহরের ক্ষুদ্র যাত্রাপথে

ছবি: নাদিয়া রহমান

কেন্টাকির এই লেক্সিংটন শহরে আমার যাত্রাপথ ধরে নিচ্ছি খুব বেশির দিনের না। কেননা আমার পরবর্তী উচ্চশিক্ষার জন্য আগামী গন্তব্য কোথায় হবে তা জানি না। কোন স্টেটের কোন শহরতলীতে, জানি না। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ক্যাম্পাসে তাও জানি না। তাই এই সংক্ষিপ্ত যাত্রাপথের সুখস্মৃতিগুলো জমিয়ে রাখার তোড়জোড়। 

এখানে বেশ কিছু বন্ধু মানুষের দেখা মিলেছে, চেনা-জানা হয়েছে বেশ কয়েকজন অধ্যাপকের সঙ্গে, যারা ক্লাসরুমের গণ্ডির বাইরে ভালো মানুষ। এদের বাইরেও বেশ কিছু মানুষের সঙ্গে চলতি পথে দেখা হয়েছে দুদণ্ডের জন্য। যাদের সঙ্গে হয়ত আর কখনো দেখাও হবে না, কিন্তু পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকা হোক না কেন, এই মানুষগুলোর কথা লেক্সিংটন শহরে খাবি খাওয়া এক বাঙ্গালি শিক্ষানবিশের মনে থাকবে। 

প্রথম যেদিন মহাসাগর পাড়ি দিয়ে এই শহরে নামলাম, রাত বাজে প্রায় ১২টা। যেখানে মানুষ সন্ধ্যা ৭টা না বাজতেই ঘুমিয়ে পড়ে। এত দীর্ঘ যাত্রা শেষে আমি যারপরনাই ক্লান্ত ছিলাম। বিমানবন্দরে আমাকে পিক করার কথা ছিল মার্কিন এক ভলান্টিয়ারের। আমি খুব উদ্বিগ্ন হয়ে তাকে খুঁজছিলাম। দেখলাম একেবারে সামনেই এরিয়েল আমার জন্য একটা প্ল্যাকার্ডে নাম লিখে দাঁড়িয়ে আছে। আমার ফ্লাইট ট্র্যাক করে এরিয়েল আরও আধা ঘণ্টা আগেই এসে দাঁড়িয়ে আছে। আমার ২২ মাসের ব্যবহৃত ভারী ব্যাগগুলো সে একাই তুলে নিলো নিজের গাড়িতে। পথে শুনলাম সে তার ছোট বাচ্চাকে রেখে এসেছে। শুধু তাই নয় আমাকে পিক করতে হবে বলে এরিয়েলের পার্টনার অফিস থেকে আগেই বাসায় ফিরেছে। নামার পথে যখন আবারও আমার বাড়ির কথা ভেবে যারপরনাই দশা, তখন এরিয়েল আমাকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ধরিয়ে দিলো। খাবার, মিনারেল ওয়াটার থেকে শুরু করে, বালিশ-চাদর, চা পাতা, বিস্কুটসহ দু-সপ্তাহে যা লাগবে তাই ছিল ওখানে। এমনকী ভারতীয় এক দোকান থেকে কিছু খাবারও দিলো, যাতে আমি নিজের মতো করে খেতে পারি। 

বিভিন্ন ব্যস্ততায় এরিয়েলের সঙ্গে পরে শুধু একবার দেখা হয়েছিল। এরপর আর দেখা হয়নি। তড়িঘড়িতে আর দেখা হবেও কি না আমরা কেউ জানি না। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভলান্টিয়ার ছাড়াও সংক্ষিপ্ত এই যাত্রাপথে দেখা হয়েছে আমার ইন্টার্নশিপের সুপারভাইজার ড. কোলবার্টের সঙ্গে, যিনি অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসক। মোরহেড নামের ছোট্ট শহরের পাহাড় ঘেরা কাঠের বাড়িতে নিজের ছোট্ট মেয়ের মতোই আমাকে আপ্যায়ন করেছিলেন। সেখানেই কাজ করার সময় পরিচয় হয়েছে ইংলিশের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. মার্কের সঙ্গে, যিনি বাংলাদেশের কয়েকটি জেলায় এনজিওর সঙ্গে কাজ করেছিলেন। সেই সময়কার ছবিগুলো যখন ড. মার্ক আর তার স্ত্রী আগ্রহ নিয়ে দেখাচ্ছিলেন, আমি তখন নিতান্তই শৈশবে। 

এ ছাড়াও, নিজ বিভাগের বাইরে পরিচয় হয়েছে পাবলিক হেলথের অধ্যাপক ড. সোয়ানসন এবং তার স্ত্রী ড. ন্যানসির সঙ্গে। এখানে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য কয়েকজন অধ্যাপক কাজ করেন। কেন্টাকির ভিন্ন সংস্কৃতি, নতুন পরিবেশে একজন শিক্ষানবিসের কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে তারা চেষ্টা করেন পাশে থাকতে। ড. ন্যানসি আর ড. সোয়ানসনের গোছানো পরিপাটি বাড়িতে যাওয়া হয়েছে ডিনারের আয়োজনে। একবার যখন ঠাণ্ডায় কাবু হয়ে গিয়েছিলাম, আমার ডর্মের সদর দরজায় গরম কুকিজ, চা আর ফল রেখে গিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিল সুন্দর হাতে লেখা একটি নোট। ভালো লাগে বাংলাদেশ আর বাংলা ভাষা সম্পর্কে এইসব মানুষদের আগ্রহ দেখে।

শেষে যার কথা না বললেই নয়, ডেন্টিস্ট ড. হার্নান্দেজ। আমার ভয়-ভীতি আর আশঙ্কা দেখে তিনি এতটাই সচেতন ছিলেন যে, আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য নিজেই গাড়ির ব্যবস্থা করলেন। একে তো এখানে ডেন্টাল খরচ অত্যধিক বেশি। শিক্ষার্থী বিধায় সেই খরচের হিসাবটাও তিনি খুবই সামান্য ধরেছিলেন। ডেন্টাল সার্জারির পর সীমাহীন ব্যথা নিয়েও ড. হার্নান্দেজের মেইল অ্যাড্রেসটা চেয়েছিলাম, পরবর্তীতে মন খুলে ধন্যবাদ দেব ভেবে। কিন্তু কোনো কারণবশত সেই মেইল তার কাছে যায়নি, এতবার চেষ্টা করার পরও। মেডিকেলেও ফোন করেছিলাম, কিন্তু কোনো কারণে তার কাছে কৃতজ্ঞতাটুকু পৌঁছেনি। 

সব মিলিয়ে শুভ-বার্তা থাকুক এই মানুষগুলোর প্রতি।      

নাদিয়া রহমান: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) ও যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কেন্টাকির শিক্ষার্থী।
 

Comments

The Daily Star  | English

Threat of fresh Rohingya influx looms as clashes erupt in Myanmar

Gunfire and explosions were heard late Friday night from villages across the border in Myanmar opposite Whykong union in Teknaf upazila of Cox’s Bazar. Residents, gripped by panic, reported that this was the most intense gunfire they had heard in months.

7h ago