‘অভিবাসী কুটনীতি’ নিয়ে প্রবাসী সাংবাদিকদের প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের বদ্ধমূল ধারণা প্রবাসী লেখক-সাংবাদিকদের হাত বাঁধা নেই। তাই তারা দ্বিধাহীনভাবে লিখতে পারেন। অকপটে সব কথা বলতে পারেন। অথচ এ ধারনাটি সম্পূর্ণ ভুল। তাদের জানাও নেই যে, প্রবাসী একজন সাংবাদিককেও মিডিয়ায় বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের সরকার নিয়ে কিছু বলার আগে দেশের একজন সাংবাদিকের মতোই অনেকবার ভাবতে হয়। এখানকার একজন লেখক একটি লেখা প্রকাশের আগে দেশের একজন লেখকের মতোই অনেকবার সম্পাদনা করেন। এরপর যা অবশিষ্ট থাকে তা 'বন্দনাগীতি' ছাড়া আর কিছু না।
প্রবাসী প্রত্যেক লেখক-সাংবাদিকেরই গভীর যোগাযোগ ও সম্পর্ক আছে বাংলাদেশের সঙ্গে। কেউ একুশের বইমেলায় নিয়মিত দেশে যান। কারও অসুস্থ বাবা-মায়ের জন্য দেশে যেতে হয়। কারও আছে ব্যবসা-বানিজ্য। কেউ দেশে বেড়াতে যান পরিবার নিয়ে। আর এদের প্রত্যেকেরই বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের 'ক্ষমতা' সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা আছে। মিডিয়ার কল্যাণে এখন এটা সবারই জানা আছে যে, প্রবাসে বসে দু-একজন সাংবাদিক সরকারের সমালোচনা করায় দেশে তাদের পরিবারকে কতোটা নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। তাই প্রবাসের লেখক-সাংবাদিকদের ভেতরেও বহুল আলোচিত 'সেলফ সেন্সরশিপ' শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকেই।
মাঝে মধ্যেই মিডিয়ায় খবর আসে, প্রবাসী সাংবাদিকদের লেখালেখি সারাক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে স্থানীয় বাংলাদেশ দূতাবাস। দূতাবাস বা হাইকমিশনের অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম নিয়ে কথা বলায় অস্ট্রেলিয়াসহ অনেক দেশেই অনেক সাংবাদিককে কালো তালিকাভূক্ত করা হয়েছে। দূতাবাসের জাতীয় দিবসগুলোর অনুষ্ঠানে তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয় না। বঞ্চিত করা হয় দূতাবাসের সমস্ত সেবা থেকেও। কূটনৈতিক মিশনগুলোর অব্যবস্থাপনা, হয়রানি ও অসঙ্গতি নিয়ে সমালোচনা করলে সেটিকে বলা হয় 'দেশবিরোধীতা'।
বাংলাদেশে ডিজিটাল আইন করে লেখক-সাংবাদিকদের মনে যে ভীতি তৈরী করা হয়েছে সেই ভীতির ঢেউ আছড়ে পড়েছে প্রবাসেও। প্রবাসী অনেক সাংবাদিকই বলছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সব চেয়ে জঘন্যতম স্বৈরশাসক এরশাদের সময়েও প্রবাসী সাংবাদিকদের এত চাপ নিয়ে লিখতে হয়নি।
এর মধ্যেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শুরু করতে যাচ্ছে 'অভিবাসী কুটনীতি'। বিদেশে বাস করা বাংলাদেশি যেসব লেখক-সাংবাদিক সরকারের নেতিবাচক সমালোচনা করবেন তাদের 'মোকাবিলার' ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের প্রচারের জন্য লেখক খোঁজা হবে। তাদের লেখার জন্য দেওয়া হবে সন্মানী।
দ্যা ডেইলি স্টারের বাংলা বিভাগের সম্পাদক গোলাম মোর্তোজা এ বিষয়ে লিখেছেন, 'পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দাবি, নির্বাচনের আগের দেড় বছরে "নেতিবাচক প্রচার-প্রচারণা" আরও অনেক বাড়বে। তা মোকাবিলায় "অভিবাসী কূটনীতি" শুরু করা হচ্ছে।
'যিনি যে দেশে থেকে "নেতিবাচক প্রচার-প্রচারণা" চালাচ্ছেন, তার বিষয়ে তথ্য দেওয়া হবে সংশ্লিষ্ট দেশের কর্তৃপক্ষকে। অনুরোধ করা হবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার। অর্থের বিনিময়ে "কলাম লেখক"দের লেখায় তুলে ধরা হবে সরকারের ইতিবাচক দিক।'
উল্লিখিত বিষয় নিয়ে এই লেখাটি তৈরির জন্য যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপানসহ ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশের লেখক-সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন এই প্রতিবেদক। এর মধ্যে অন্তত ১৫ জন কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। তাদের প্রত্যেকের মূল বক্তব্য মোটামুটি একইরকম। তা হলো—'আমাদের কোনো না কোনো সময় বাংলাদেশে যেতে হবে। আমরা ঝুঁকি নিতে চাই না।'
তবে বাকি কয়েকজন তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
যুক্তরাজ্য প্রবাসী কবি ও সাহিত্যিক শামীম আজাদ এ ব্যাপারে বলেন, 'আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমাদের দেশ এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত নেবে না। সরকারে এমন বিজ্ঞ লোকের অভাব নেই যাঁরা খোঁজ রাখেন প্রবাসী লেখক, সাংবাদিকদের বিষয়ে। বাংলাদেশের সরকার যদি এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করার পদক্ষেপ নেন, তাতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের দেশ নাজুক ও স্পর্শকাতর বলে প্রমানিত হবে, যা কারুর জন্যেই মঙ্গলজনক হবে না।'
যুক্তরাষ্ট্রের নি ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক 'আজকাল' পত্রিকার প্রধান সম্পাদক জাকারিয়া মাসুদ জিকোর ভাষ্য, 'সরকারের সমালোচনা করা এবং দেশের বিরুদ্ধে কথা বলা যে এক নয়- সেটাই বর্তমান সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বুঝতে চাইছেন না। প্রবাসী লেখক সাংবাদিকরা দেশকে ভালোবাসেন বলেই দেশের প্রশাসন ও সরকারের নানা অসঙ্গতি নিয়ে কথা বলেন। সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় অভিবাসী কুটনীতির যে ঘোষণা দিয়েছে তাতে আমার মনে হয়, এতে সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল না হয়ে বরং নষ্ট হবে। দূতাবাসের মাধ্যমে উন্নত দেশগুলোর প্রশাসন দিয়ে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার যে কথা বলা হয়েছে, সেটা মোটেও বাস্তবসম্মত নয়।'
অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ আব্দুল মতিন বলেন, 'দেশের ইতিবাচক বিষয় তুলে ধরার জন্য সম্মানী দিয়ে কলাম লেখক খোঁজা এবং বিদেশে বসবাসরত প্রবাসী ও অভিবাসী সত্যিকারের লেখক বা সাংবাদিকদের বাকরুদ্ধ করার জন্য "অভিবাসী কূটনীতি" হবে কফিনে শেষ পেরেক ঠোকার শামিল।'
কানাডা প্রবাসী লেখক ও সাংবাদিক সওগাত আলী সাগর বলেন, 'বাস্তবে ২-৩টি হাতেগোনা কয়েকজন সরকারের বিরুদ্ধে নানা ধরনের প্রচারনা চালায়। এর বাইরে বহির্বিশ্বে প্রবাসী লেখক-সাংবাদিকদের মধ্যে সেই অর্থে সরকার বিরোধীতা নেই। তবে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি এবং হয়রানিমূলক কর্মকাণ্ডের সমালোচনা আছে। সরকারের নানা সংস্থার অনিয়ম ও দুর্নীতির সমালোচনাকে দেশবিরোধীতা হিসেবে চিহ্নিত করাটা অগ্রহণযোগ্য।'
তার ভাষ্য, 'সন্মানী দিয়ে সরকারের পক্ষে লেখানোর জন্য লোক খোঁজা হচ্ছে—এই বার্তাটিই সরকারের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এখন কেউ সরকারের পক্ষে লিখলেই অন্যরা তাকে ভাড়া খাটা লেখক ভেবে বসতে পারেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের এই উদ্যোগটি বরং সরকারের ভাবমূর্তির ক্ষতিই করেছে।'
ইতালি থেকে 'ভেনিস-বাংলাদেশ প্রেসক্লাব'র আহ্বায়ক পলাশ রহমান বলেন, 'প্রবাস থেকে যেসব সাংবাদিক সরকারের খারাপ কাজের সমালোচনা করেন তাদের নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়। দূতাবাসগুলোযতে কনস্যুলেট সেবা নিতে গেলে তাদের নানা ভবে হয়রানি করা হয়। তাদের দেশবিরোধী বলে প্রচার করা হয়। প্রবাসীরা যে দেশে বসে সমালোচনা করেন, সে দেশের প্রশাসন দিয়েই তাদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সরকার এখন অভিবাসী কূটনীতির কথা বলছে। যা শুধু অসম্ভবই নয়, হাস্যকরও বটে।'
কানাডা প্রবাসী লেখক-সাংবাদিক জসিম মল্লিক বলেন, ব্যক্তির যেমন ভুল আছে তেমনি রাষ্ট্রেরও ভুল থাকে। আবার সংশোধনেরও সুযোগ থাকে। আমরা যারা অভিবাসী, যারা লেখালেখি করি, সংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত তাদের উচিত দেশের ভালো জিনিসগুলো মেইনস্ট্রিমে তুলে ধরা। নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা। এজন্য ফরমায়েশি লেখার বা লেখক প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।'
জাপান থেকে সাংবাদিক রাহমান মনি বলেন, 'প্রশ্ন হলো সরকারকে কেন এই সিদ্ধান্ত নিতে হলো? কী এমন ইমেজ সংকট দেখা দিয়েছে যে অর্থের বিনিময়ে কলাম লেখকদের লেখায় তুলে ধরতে হবে সরকারের ইতিবাচক দিক? এমনিতেই তো মিডিয়া তাদেরই নিয়ন্ত্রণে।'
রাহমান মনি মনে করেন, এই প্রক্রিয়ায় দেশের ভাবমূর্তি দারুনভাবে ক্ষুন্ন হবে।
আকিদুল ইসলাম: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী লেখক, সাংবাদিক
Comments