মুক্তিযুদ্ধে ‘বীরপ্রতীক’ খেতাবপ্রাপ্ত একমাত্র বিদেশি ঔডারল্যান্ড

উইলিয়াম আব্রাহাম সাইমন ঔডারল্যান্ড। ছবি: সংগৃহীত

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক উইলিয়াম আব্রাহাম সাইমন ঔডারল্যান্ড বাংলাদেশে ছিলেন। তিনি বাটা সু কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন।

১৯৭১ সালে ইতিহাসের অন্যতম জঘন্য গণহত্যা শুরু হয় তার চোখের সামনে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও এমন আরেকটি গণহত্যা দেখেছিলেন তিনি। তখন নাৎসি বাহিনীর বর্বরতা ও নৃশংসতা দেখেছিলেন ঔডারল্যান্ড। সেই বর্বরতার বিরুদ্ধে মিত্র বাহিনীর একজন গেরিলা সৈনিক হিসেবে লড়েছিলেন তিনি।

এর ঠিক ২৯ বছর পর বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরতা ও নির্মমতা তার সৈনিক জীবনের স্মৃতিকেই মনে করিয়ে দিয়েছিল।

একাত্তরের ৫ মার্চ পাকিস্তানি বর্বরতার বিরুদ্ধে টঙ্গীর মেঘনা টেক্সটাইল মিলের সামনে শুরু হয় শ্রমিক-জনতার মিছিল। সেই মিছিলে প্রশাসনের নির্দেশে গুলি চালায় ইপিআর বাহিনী। ঘটনাস্থলে ৪ জন নিহত ও ২৫ জন আহত হন। এর প্রভাব পড়ে টঙ্গীর বাটা কোম্পানির কারখানাতেও। স্বচক্ষে এ হত্যাকাণ্ড ও তাণ্ডব দেখে নিজেকে আর স্থির রাখতে পারেননি ঔডারল্যান্ড।

প্রথমদিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংস নির্যাতন ও গণহত্যার আলোকচিত্র তুলে গোপনে বহির্বিশ্বের গণমাধ্যমে তুলে ধরেন তিনি। বাটা কোম্পানির মতো বহুজাতিক কোম্পানির প্রধান নির্বাহী হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়মিত যাতায়াত ছিল ঔডারল্যান্ডের। এ সুবিধাকে ভিন্নভাবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নীতিনির্ধারণী মহলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন ঔডারল্যান্ড।

প্রথমে ঢাকা সেনানিবাসের ২২ বেলুচ রেজিমেন্টের অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কর্নেল সুলতান নেওয়াজের সঙ্গে গড়ে তোলেন ঘনিষ্ঠতা। সেনানিবাসে শুরু হয় তার নিয়মিত যাতায়াত। একপর্যায়ে লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান, লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লা খান নিয়াজি, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলিসহ আরও অনেক সামরিক অফিসারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে তার। কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে, সেনাবাহিনীর সামরিক অফিসারদের আলোচনা সভায় অংশগ্রহণের সুযোগও পেয়ে যান তিনি।

ফলে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গোপন সংবাদ সংগ্রহ করার সুযোগ পান ঔডারল্যান্ড। সংগৃহীত সব তথ্য তিনি গোপনে পাঠিয়ে দিতেন ২ নম্বর সেক্টরের ক্যাপ্টেন এটিএম হায়দার ও জেড ফোর্সের কমান্ডার মেজর জিয়াউর রহমানের কাছে।

পাকিস্তানিদের তাণ্ডবলীলা যখন ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে, তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতার আলোকে শুরু করেন গেরিলা প্রশিক্ষণের কাজ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কমান্ডো হিসেবে তিনি ছিলেন অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন। তার পরিকল্পনায় ও পরিচালনায় ঢাকা ও ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকায় বহু অপারেশন সংঘটিত হতে থাকে। মেজর হায়দারের দেওয়া এক সনদপত্রে উল্লেখ পাওয়া যায়, ঔডারল্যান্ড মুক্তিযুদ্ধে যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, পরামর্শ, নগদ অর্থ, চিকিৎসা সামগ্রী, গরম কাপড় ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছেন।

যুদ্ধ চলাকালে তিনি প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানীর সঙ্গেও সবসময় যোগাযোগ রাখতেন। ঢাকায় অবস্থিত অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনের গোপন সহযোগিতা পেতেন তিনি।

১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ঢাকায় ফিরে তিনি আবার পুরনো কর্মস্থল বাটায় যোগ দেন। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত এ দেশেই ছিলেন ঔডারল্যান্ড। পরে বাটার পক্ষ থেকে তাকে বদলি করা হয় অস্ট্রেলিয়ায়।

ওই বছরই মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ ও অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে 'বীরপ্রতীক' সম্মাননায় ভূষিত করে। তিনিই একমাত্র বিদেশি যিনি এ স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরপ্রতীক পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকায় তার নাম ২ নম্বর সেক্টরের যোদ্ধাদের তালিকায় ৩১৭ নম্বর। ১৯৯৮ সালের ৭ মার্চ খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা ও সনদপত্র বিতরণ অনুষ্ঠানে ঔডারল্যান্ডকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু, অসুস্থ থাকায় অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারেননি তিনি।

বীরপ্রতীক পদকের সম্মানীর টাকা তিনি দান করে গেছেন মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে।

তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ গুলশানের একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে।

২০০১ সালের ১৮ মে অস্ট্রেলিয়ার পার্থে ৮৪ বছর বয়সে বীরপ্রতীক উইলিয়াম আব্রাহাম সাইমন ঔডারল্যান্ড মৃত্যুবরণ করেন।

আকিদুল ইসলাম: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী লেখক, সাংবাদিক

Comments

The Daily Star  | English

Farewell of Pope Francis at Vatican

Applause rang out as the wooden coffin, inlaid with a large cross, was brought out of St. Peter's Basilica and into the sun-filled square by white-gloved, black-suited pallbearers.

3h ago