জাপানে শিশুর জন্মগত অধিকার, প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা ও সরকারের দায়

জাপানের একটি বিদ্যালয়ে দেশটিতে বসবাসরত বাংলাদেশিদের সন্তান। ছবি: সংগৃহীত

জাপানে  ১৪ বা তার চেয়ে কম বয়সী ছেলে-মেয়েদের তুলনায় ৬৫ বা তার চেয়ে বেশি বয়সী নারী-পুরুষের সংখ্যা বেশি। এখানে ৬৫ বা তার চেয়ে বেশি বয়সী নাগরিকের সংখ্যা ৩ কোটি ৩০ লাখের মতো। দেশটিতে জন্মহার আশঙ্কাজনক হারে কমতে থাকার বিপরীতে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে।

জাপানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ২০২২ সাল পর্যন্ত আগের ৭ বছর দেশটিতে টানা জন্মহার কমেছে। এতে করে দেশটির জনসংখ্যা কমে যাওয়ার উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

এ অবস্থায় জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার সরকার নিম্নমুখী জন্মহার বাড়ানোর বিষয়টিকে অগ্রাধিকারের তালিকায় রেখেছে। সন্তান জন্মদানে নাগরিকদের উৎসাহিত করতে ঘোষণা করেছে নজিরবিহীন প্যাকেজ। সন্তান জন্মদান এবং লালন-পালন বাবদ দেশটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ প্রণোদনা দিচ্ছে ফুমিও কিশিদা প্রশাসন।

সে মোতাবেক সন্তানের জন্ম থেকে শুরু করে নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত লেখাপড়ার একটা বড় ব্যয়ভার বহন করবে সরকার। ২০৩০ সাল নাগাদ এ প্রণোদনা দ্বিগুণ করার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা।

জাপানে আগে প্রতিটি শিশু জন্মের পর তার অভিভাবককে স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে সরকারের তহবিল থেকে ৪ লাখ ২০ হাজার ইয়েন দেওয়া হতো, যা চলতি বছরের এপ্রিল থেকে ৫ লাখ ইয়েন-এ উন্নীত করা হয়েছে।

এর বাইরে জন্মের পর স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতিমাসে প্রতিটি শিশুকে (বিদেশি শিশুসহ) কম-বেশি ১৫ হাজার ইয়েন মাসিক ভাতা প্রদান করা হয়। এছাড়া সরকারি পর্যায়ের জুনিয়র হাইস্কুল পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ ও অবৈতনিক শিক্ষা সুবিধা দেওয়া হয়। আগে স্কুলগুলোতে নামমাত্র মূল্যে যে পুষ্টিকর খাবার দেওয়া হতো, এখন সেটাও বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে কোনো শিক্ষার্থী যদি বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে যায়, সেক্ষেত্রে বিদ্যালয় থেকে স্কুল ফিডিং বাবদ ওই শিক্ষার্থীর জন্য যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ থাকে সেটা তাকে দিয়ে দেওয়া হয়। কারণ, সেখানকার অনেক মুসলিম পরিবার ধর্মীয় বিবেচনায় সন্তানদের জন্য বাসার তৈরি খাবার সরবরাহ করে থাকে।

আর ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের পথ্যসহ বিনামূল্যে চিকিৎসা সহায়তাও দিয়ে আসছে জাপান সরকার।

জাপানের প্রাথমিক শিক্ষা

জাপানে প্রাথমিক এবং নিম্ন মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাগ্রহণ বাধ্যতামূলক। সেখানে শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় উৎসবমুখর পরিবেশে। অভিভাবকদের পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসন ও ‍পুলিশের প্রতিনিধি, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের বরণ করে নেওয়া হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের পুনর্গঠন ও বাণিজ্যিক সাফল্যের ক্ষেত্রে শিক্ষা সবচেয়ে বেশি অবদান রেখে চলেছে। ১৯৪৭ সালে জাপান শিক্ষার জন্য যুগোপযোগী ও সুদুরপ্রসারী একটি আইন পাশ করে। জাপানের এখনকার শিক্ষা ব্যবস্থাতেও এই আইনের প্রভাব আছে।

এই আইনে শিক্ষানীতি অনুসারে গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে চারটি ধাপে ভাগ করা হয়েছে। এই ধাপগুলো হচ্ছে—ছয় বছরের জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়, তিন বছরের জন্য নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, তিন বছরের জন্য উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং দুই অথবা চার বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়।

তবে আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকলেও প্রাথমিক শিক্ষা শুরুর আগে শিশুদের কিন্ডারগার্টেন ও ডে-কেয়ার সেন্টারে পাঠানোর বিষয়টি সেখানে অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। এ জন্য অনেকে জাপানের শিক্ষা ব্যবস্থাকে পাঁচ ধাপে ভাগ করার কথা বলে থাকেন।

জাপানের নাগরিকদের সবাই এক থেকে পাঁচ বছরের শিশুদের পাবলিক ও ডে-কেয়ার সেন্টারে পাঠিয়ে থাকেন। সেখানে শিশুরা খেলাধুলার মাধ্যমে শিক্ষাগ্রহণ করে বিদ্যালয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। এছাড়াও  সেখানে তারা একে অপরকে সহযোগিতা, মনুষ্যত্ববোধ, ত্যাগ, শৃঙ্খলা, সততা, বিনয়-শিষ্টাচার, সৌন্দর্যবোধ ও নৈতিক চেতনার শিক্ষা নেয়। আত্মিক বিকাশের এই শিক্ষাই পুরো জাপানি শিক্ষাব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য। যেকোনো ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জনের চেয়ে আত্মিক বিকাশের এই দিকটাতেই বেশি গুরুত্ব দেয় জাপানিরা। এ কারণেই জাপানিদের অপরাধ প্রবণতার হার প্রায় শূণ্যের কোঠায়।

জীবনমুখী শিক্ষা

জাপানের স্কুলগুলোতে যে শিক্ষাটা দেওয়া হয় তা মূলত জীবনমুখী। গণিত ও ভাষাশিক্ষার পাশাপাশি সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয় নৈতিকতা শিক্ষার ওপর। শেখানো হয় সামাজিক ন্যায়-অন্যায়, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মতো বিষয়গুলো।

ছয় বছর বয়স হলে জাপানের শিশুদেরকে প্রাথমিক স্কুলে যেতে হয়। জাপানে সরকারি এবং বেসরকারি দুই ধরনের প্রাথমিক স্কুল রয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে সোমবার থেকে শুক্রবার সপ্তাহে পাঁচ দিন ক্লাস হয়। দিনে সর্বোচ্চ ছয়টি ক্লাস নেওয়া হয়। প্রতি ক্লাসের ব্যাপ্তি ৪৫ মিনিট করে। মাঝে থাকে ১০ থেকে ১৫ মিনিটের বিরতি।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সবার আগে স্কুলে আসেন। তিনি নিজে স্কুলগেটে দাঁড়িয়ে সব শিক্ষার্থীকে অভ্যর্থনা জানান। ধনী-গরিব সব শিক্ষার্থীকে পায়ে হেঁটে স্কুলে যেতে হয়।

স্কুলে ক্লাস শুরু হওয়ার আগে শিক্ষার্থীদের সবাই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজে অংশ নেয়। কেউ খেলাধুলা করে। কেউ কেউ শেখে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং। কেউ শেখে হাতের কাজ। প্রতিটি ক্লাসে একজন শিক্ষক ও ৩০ থেকে ৩৫ জন শিক্ষার্থী থাকে। সঙ্গীত, শিল্পকলা এবং শারীরিক শিক্ষার জন্য থাকেন বিশেষজ্ঞ শিক্ষক।

এর পাশাপাশি প্রতিটি স্কুলে একজন করে ডায়েটিশিয়ান থাকেন। ডায়েটিশিয়ান বাচ্চাদের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যালরি হিসাব করে ব্যালেন্স ডায়েট তৈরি করেন। সেটা অনুসরণ করেই খাবার তৈরি করেন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাবুর্চি।

জাপানের প্রতিটি স্কুলের নিজস্ব রান্নাঘর আছে। খাবারের সময় শিক্ষার্থীরা বিশেষ ধরনের পোশাক পরে সারিবদ্ধভাবে রান্নাঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তাদের হয়ে প্রতি ক্লাসের দায়িত্বপ্রাপ্তরা রান্নাঘর থেকে খাবার বুঝে নেন। তারপর খাবার নিয়ে ক্লাসরুমে ফিরে যায় শিক্ষার্থীরা।

জাপানে প্রায়ই বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনা ঘটে। তাই ক্লাসগুলোতে গুরুত্ব দিয়ে দুর্যোগকালীন পরিস্থিতিতে কী করণীয় এবং বর্জনীয় তা হাতে-কলমে শেখানো হয়। এছাড়াও প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিত শারীরচর্চা শেখানো হয়। বেসবল, ফুটবল, দৌড়সহ বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলায় বাচ্চারা নিয়মিত অংশ নেয়।

বিদ্যালয়ের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মতো সব আয়োজন হয় শিক্ষার্থীদের পরিকল্পনায়। তারাই সেগুলো পরিচালনা করে। শিক্ষকরা তাদের কেবল সহযোগিতা করে।

জাপানের বিদ্যালয়গুলোতে প্রতিবন্ধী অর্থাৎ বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা আছে। এছাড়া অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিক্ষার্থীদের দিকেও দেওয়া হয় বিশেষ নজর।

স্কুল থেকে বাসায় ফিরতে ফিরতে জাপানের শিক্ষার্থীদের প্রায়ই সন্ধ্যা হয়ে যায়। এক্ষেত্রে অবসরে যাওয়া ব্যক্তিরা তাদের বাসা পর্যন্ত নিরাপদে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করেন। কারা এই দায়িত্ব পালন করবেন সেটা সমন্বয় করে থাকে স্থানীয় প্রশাসনের লোকজন ও অভিভাবকরা।

জাপানের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে বিবেচনা করা হয় আদর্শের সূতিকাগার হিসেবে। বিদ্যালয়গুলো প্রতিটি কর্মকাণ্ড সুনাগরিক তৈরির একেকটি ভিত্তি। শিক্ষকরা তার কারিগর। জাপানি সমাজে শিক্ষকদের সমাজের আদর্শতম মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়।

জাপানে শিক্ষক-অভিভাবক কর্তৃক নির্ধারিত জ্যেষ্ঠ একজন দলনেতার নেতৃত্বে প্রত্যেক শিশু পায়ে হেঁটে স্কুলে যায়। করোনাভাইরাস মহামারির শুরুতে এই নিয়মে কিছুটা পরিবর্তন আসে। অথচ এখানকার প্রায় প্রত্যেক অভিভাবকেরই ব্যক্তিগত গাড়ি আছে।

Comments

The Daily Star  | English
NSC shop rent scam in Dhaka stadiums

Shop rent Tk 3 lakh, but govt gets just Tk 22,000

A probe has found massive irregularities in the rental of shops at nine markets of the National Sports Council (NSC), including a case where the government receives as little as Tk 22,000 in monthly rent while as much as Tk 3 lakh is being collected from the tenant. 

17h ago