অন্যরকম অবকাশ
ছুটি থেকে ছুটি নিয়েছেন কখনো?
শিকাগো থেকে শীতের ছুটিতে ঢাকায় আসা হলো যখন, পরিকল্পনা মোটামুটি আত্মীয় বাড়ি আর বিয়ে বাড়ি ঘোরাঘুরির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু একটানা কাচ্চি বিরিয়ানি আর কত খাওয়া যায়? তার মধ্যে আবার আবাসিক এলাকায় থেকেও ২৪ ঘণ্টা চারপাশে ইমারত নির্মাণের আওয়াজ। কোথায় পাব সবুজ-শ্যামল বাংলা মায়ের বিছানো আঁচল? পাখির কিচিরমিচির? সঙ্গে চাই ইন্টারনেট সংযোগ আর কলে গরম পানি। যাবতীয় আরাম-আয়েশ ছাড়া চলবে না কিন্তু!
ঝটপট ঠিক হয়ে গেল, মা-বাবা আর স্বামী রাশেদ দীনকে নিয়ে সিলেটের নতুন সব আকর্ষণীয় রিসোর্টে ঝটিকা সফর মন্দ হয় না। যেই কথা সেই কাজ। আমরা করব রিসোর্ট ট্যুর অফ সিলেট। ই-মেইলে হয়ে গেল বুকিং। নরম-গরম কাপড় লাগেজে আর কচকচে মচমচে নাশতা গাড়ির পেছনে। কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে হুডি চাপিয়ে চায়ের কাপ হাতে বেরিয়ে গেলাম পথে। মনে দুরকমের উত্তেজনা। বেড়ানোর তো আছেই। ঢাকার প্রগতি সরণিতে গাড়ির ওপর বাসের হুমকি পিলে চমকে দিয়েছে। হাইওয়েতে গিয়ে চাপ সামলাতে পারব তো?
রাস্তা দেখলাম নতুন কার্পেটিং করা। সবাই লেন মেনে চালালে আরামে তিনটা গাড়ি চলতেই পারে। কিন্তু ত্রিচক্রযান আর ট্রাক যখন আমাদের সঙ্গে অকারণ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত তখন করুণাময়ের দয়া আর চালক আরিফের পারদর্শিতার ওপর ভরসা রেখে গ্রাম-বাংলার শীতের সৌন্দর্য উপভোগে মনোযোগী হলাম। হাইওয়ের দুপাশে মাঝেমধ্যেই রঙিন সব গেট, দূর গ্রামের বিয়েবাড়ি। না জানি কত হইচই হবে! খুব ইচ্ছে করছিল লাল-হলুদ কাগজ দিয়ে সাজানো আয়োজনে শামিল হয়ে যাই। কিন্তু আমরা ছুটে চলেছি হবিগঞ্জের দিকে। মেঘনার ওপর দাপটের সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা ব্রিজ পার হতে হতে দুচোখে খোঁজার চেষ্টা করলাম জীবনানন্দের অনুপ্রেরণা।
হঠাৎ গ্রাম শেষ। পথের দুপাশে বিভিন্ন কারখানা, আধুনিক রপ্তানিমুখী কারখানা—কয়েক মাইলজুড়ে দেশের অগ্রগতির নানা নিদর্শন। স্পিনিং, সিরামিকস, মশার কয়েল, কী নেই! এর ফাঁকে ফাঁকেই চা-বাগান, ছোট ছোট বাজার, শহরতলি। সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার পথ পেছনে রেখে পেয়ে গেলাম বাহুবল উপজেলার প্রায় শেষ প্রান্তে দি প্যালেস রিসোর্টের আগমনপথ। উঁচু-নিচু টিলা পার হয়ে চা-বাগানের ধার ঘেঁষা সরু পথে এগোতেই পৌঁছে গেলাম কারুকার্যময় গেটে। উষ্ণ অভ্যর্থনা, সঙ্গে আগমনী এবং বিদায়ী অতিথিদের গাড়ির লম্বা কিউ। নেমে পড়লাম। এখনই ঘুরে দেখব শ্যামলিমায় ঘেরা আসলেই রাজকীয় প্যালেস রিসোর্ট। একটু এগোতে দেখি পরিচিত অনেকেই দাঁড়িয়ে আছেন পরিবারসহ ঢাকা ফেরার আয়োজনে ব্যস্ত। হঠাৎ দেখা হওয়ায় ভালো লাগা অন্যরকম।
ঘর পেতে সময় লাগবে তাই আমরা কমপ্লিমেন্টারি ‘বাগি’র (একরকম বেশি সিটবিশিষ্ট গলফ কার্ট) জন্য অনুরোধ করলাম, রিসোর্ট ঘুরে দেখব। শুরু হলো বাগি নিয়ে মিনি ট্যুর।
এই তো পেলাম পাখির কিচিরমিচির, যত দূর চোখ যায় সবুজ টিলা, ঘন বন, মাঝেমধ্যে বাঁকা পথ বেয়ে ভিলা, গাঁদা ফুল নানা রঙের, হঠাৎ কোনো রেস্ট জোনে খেলে বেড়ানো বাচ্চাদের হইচই। সেলফি তোলার কথা ভুলেই গেলাম একরকম। আঁকাবাঁকা বাঁধানো পথে হেঁটে যেতে মা শুরু করলেন গান, যোগ দিলাম আমরাও। শীতের হাওয়ার লাগল নাচন আমলকীর ওই ডালে ডালে। রুমে যেতে ইচ্ছেই করছিল না।
ঘুরতে ঘুরতে আবিষ্কার হলো ছবি তোলার সবচেয়ে ভালো স্পট। হেলিপ্যাডের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চারদিকে দৃষ্টি ঘোরালাম। আদর্শ প্যানারমিক ভিউ। চোখ জুড়ানো সবুজ আর ধীরে ধীরে অস্তগামী টকটকে রাঙা সূর্য। এই তো আমার বাংলাদেশ।
পরদিন আমরা রওনা হলাম শ্রীমঙ্গলের দিকে। খাবার মান যদি আরেকটু ভালো করা যায়, তাহলে নিঃসন্দেহে প্যালেস রিসোর্ট
বিশ্বের যেকোনো আধুনিক উঁচুমানের রিসোর্টের সমতুল্য। খুব গর্ব হচ্ছিল দেখে।
শ্রীমঙ্গলের গ্র্যান্ড সুলতান গলফ রিসোর্ট সেই তুলনায় ছোট এলাকাজুড়ে হলেও অতিথিতে পরিপূর্ণ! দুপুরের খাবারের ভালো আয়োজন দেখে আমরা বসে পড়লাম। সাতকরা দেওয়া গরুর মাংস খেতে ইচ্ছে হচ্ছিল, কিন্তু মেন্যুতে বারগার পাস্তার ছড়াছড়ি। তবে এখানেও কর্মরত সবাই শুদ্ধ ইংরেজি ভাষাভাষী। যা অবশ্যই আন্তর্জাতিক পর্যটনের জন্য প্রয়োজন। দেখে ভালো লাগল। রাশেদ বলল, ‘চা দরকার’। অতি উত্তম! কাছেই আছে বিশ্বের নামী বিজ্ঞানীদের তাক লাগানো সাতরঙা চা। গ্র্যান্ড প্যালেস থেকে বের হয়েই রমেশ গৌরের নীল কণ্ঠ টি কেবিন। দেশ-বিদেশের নানা পর্যটক এখানে ভিড় জমান আশ্চর্য স্তরবিশিষ্ট ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের চা পান করার জন্য। আমরাও বিভিন্ন চা পরখ করে দেখলাম। কিন্তু দোকানে কর্মরত কেউই অতিথিদের সঙ্গে কথা বলেন না। যা একটু অদ্ভুত। চা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম আরেক রিসোর্টের পথে।
মৌলভীবাজারের সর্পিল পথে হঠাৎ দেখা হবে শ্বেতশুভ্র চা-কন্যার সঙ্গে। চমৎকার এক ভাস্কর্য। কিন্তু ভাস্করের নাম লেখা নেই, আছে স্বত্বাধিকারীর নাম। তা-ও ধন্যবাদ জানাই সাতগাঁও টি এস্টেটকে এই শৈল্পিক স্বাগত স্থাপনার জন্য। খাসিয়াপল্লি যেতে চাইলে চা-কন্যার পাশ দিয়ে যাওয়া মেঠোপথ দিয়ে এগোতে হবে অনেক দূর।
বিকেলের নরম রোদ যখন ঢলে পড়ছে আঁধারে, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরেই দুসাই রিসোর্ট স্পা। থাইল্যান্ডের অভিনব সব রিসোর্টের আদলে গড়া কৃত্রিম প্রপাতের কলকল শব্দে স্বাগত জানানো হলো। উঁচু-নিচু পাহাড়ি পটভূমি বজায় রেখেই সুইমিংপুল, রেস্টুরেন্ট, স্পোর্টস কোর্ট—নানা আয়োজন। ঘরের সাজসজ্জায় কিছুটা কমতি থাকলেও এর খাওয়া মজা। দলবল বেঁধে যাঁরা এসেছেন তাঁরা বেশ জোনাকির আলোয় বাগানে বসে গিটারে সুর তুলছেন আর সবাই যোগ দিচ্ছেন। কেউবা ব্যস্ত ব্যাডমিন্টন নিয়ে। পরদিন পুলের পাশে বসে সিলেটের মিষ্টি আনারসের রস উপভোগ করে তারপরই রওনা হলাম ঢাকার পথে।
আমাদের রিসোর্ট ট্যুরে একেক জায়গায় একেক রকম ভালো লাগা—কিন্তু সবচেয়ে মুগ্ধ হওয়ার বিষয় হলো, আমাদের স্থানীয় লোকবল দিয়েই এমন বিশ্বমানের আতিথেয়তাসম্পন্ন রিসোর্ট চলছে। বাংলাদেশিরাও দেশের ভেতরেই পর্যটনে আগ্রহী হচ্ছেন। এভাবেই প্রগতি, উন্নতি ছড়িয়ে পড়ুক দেশের আনাচকানাচে, রূপবতী বাংলাদেশ মোহিত করুক বিশ্ববাসীকে।
Comments