শুধু মনে মনে নয়, মধ্যবিত্ত মানুষগুলো এখন বেড়ায় বনে বনে

“কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা, মনে মনে” গানটি বোধকরি কবিগুরু লিখেছিলেন বাংলা ১৪০০ সাল বা তার পরবর্তী মধ্যবিত্ত সমাজের একটি সুপ্ত ইচ্ছের কথা ভেবেই। নব্বই দশকের আগ পর্যন্ত এ দেশের বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের মধ্যে বেড়াতে যাওয়ার ধারণাটা ছিলো না বললেই চলে। থাকলেও সেটা ছিল ঐ মনে মনে।

“কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা, মনে মনে” গানটি বোধকরি কবিগুরু লিখেছিলেন বাংলা ১৪০০ সাল বা তার পরবর্তী মধ্যবিত্ত সমাজের একটি সুপ্ত ইচ্ছের কথা ভেবেই। নব্বই দশকের আগ পর্যন্ত এ দেশের বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের মধ্যে বেড়াতে যাওয়ার ধারণাটা ছিলো না বললেই চলে। থাকলেও সেটা ছিল ঐ মনে মনে। বেড়ানো ব্যাপারটা যে জীবনের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সে সম্পর্কে তাদের কোন ধারণাই ছিলো না। কলকাতার মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজ “হাওয়া বদল” বা “স্বাস্থ্য রক্ষার” জন্য এখানে সেখানে বেড়াতে যাওয়ার কথা ভাবলেও বাংলাদেশে বেড়ানো ব্যাপারটা কদর পেয়েছে আরও অনেক পরে।

৭০ বা ৯০ এর দশকের প্রথমদিক পর্যন্ত আমরা বেড়াতে যাওয়া মানে বুঝতাম দাদা কিংবা নানার বাড়ি যাওয়া। স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা হয়ে গেলে আমরা যারা শহরে থাকতাম, তারা দেশে গ্রামের বাড়ি যেতাম। ব্যস, এটুকুই ছিলো আমাদের বেড়ানো। এরমধ্যে আবার কেউ কেউ যারা আরও একটু সচ্ছল তারা যেতো কক্সবাজার বা রাঙামাটি। আর যারা উচ্চবিত্ত, শুধু তারাই উড়োজাহাজে চেপে বিদেশ যেতো। বাকিরা তাদের ছবি দেখেই আশ মেটাতো। অবশ্য সেসময়ে জীবন এত জটিল ও সবুজহীন ছিলো না। আর অধিকাংশ মানুষের আয় যেমন ছিল সীমাবদ্ধ, তেমনি চাহিদাও ছিল সামান্য। শহরগুলোতেও ছিল ফাঁকা জায়গা, সবুজ বনানী, পার্ক, ফুটপাত, অল্প মানুষ, অল্প গাড়ি, স্বল্প শব্দ। নদী ছিল, নীল আকাশও দেখা যেতো। জীবনে জটিলতা কম ছিল বলে নাগরিক জীবন আজকের মত দমবদ্ধকর ছিলো না।

সে যাক আমাদের দেশে মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে বেড়ানোর ব্যাপারটা কিন্তু এখন আর শুধু মনে সীমাবদ্ধ নেই। নানা কারণে মানুষ বুঝেছে জীবনের প্রয়োজনেই বেড়া-বেড়ির দরকার আছে। আর তাই কল্পনা ছেড়ে বাস্তবেই মানুষের বেড়ানোর প্রবণতা বেড়েছে বহুগুণ। শুধু একটি ছুটির অপেক্ষা। ব্যস ওমনি দলবেঁধে বেড়িয়ে পড়ছে ছেলে থেকে বুড়ো সবাই। কেউবা যাচ্ছে পরিবারের সাথে, কেউবা বন্ধুদের সাথে, কেউবা একাই। দেশে বা দেশের বাইরে যে যার পছন্দ অনুযায়ী, সামর্থ্য অনুযায়ী বেড়িয়ে পড়ছে। তারা সময়টা কাটাতে চাইছে আনন্দ করে, বই পড়ে, চুটিয়ে আড্ডা দিয়ে, প্রকৃতি দেখে, সবুজের কাছে থেকে, পাখির, নদী বা সাগরের গান শুনে। মানুষ নিজেরা নিজেরা সময় কাটাতে ভালবাসে, ভালবাসে শুধুই বেড়াতে বা এডভেঞ্চার করতে।

অথচ মাত্র ১০/১২ বছর আগেও মানুষের বেড়ানোর প্রবণতা ছিলো একবারেই অন্যরকম। দুই বা তিন যুগ আগে এই চেহারা ছিল আরও অন্যরকম। ৮০ ও ৯০ এর দশকে এসে বেড়ানোর একটা অংশ হিসেবে “হানিমুন” ধারণাটি বাজার পেতে শুরু করলো। নবদম্পতি বিয়ের পর সংসার ও বাস্তব জীবন শুরু করার আগে নিজেদের মত করে একটু সময় কাটানোর, দুজন দুজনকে বোঝার ও জানার জন্য কদিন পরিচিত জনদের ছেড়ে বাইরে কোথাও গিয়ে কাটিয়ে আসতে পারে বা আসা উচিৎ, এ ধারণাটাও খুব বেশিদিনের নয় আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজে। তবে হ্যাঁ দিন, মাস, বছর যেতে যেতে এখন হানিমুনের ভাবসাবই পাল্টে গেছে। ইদানীংতো বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করার আগেই পাত্র-পাত্রী হানিমুনের জায়গা ঠিক করে ফেলে, সে দেশেই হোক বা দেশের বাইরেই হোক।

বেড়ানোর প্রবণতাটা কতটা বেড়েছে তা খুব সহজেই বোঝা যায় ঈদ বা অন্য কোন বড় ২/৩ দিনের ছুটি পেলেই ঝাঁকে-ঝাঁকে মানুষ বেড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। দেশের এমনকি বিদেশের পর্যটন এলাকাগুলোর থাকার জায়গাতে বুকিং পাওয়া যায় না। বাস, ট্রেন, জাহাজ এমনকি উড়োজাহাজের টিকেট পাওয়া যায় না। মানুষ যাচ্ছে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, সুন্দরবন, কক্সবাজার, কুয়াকাটা, চা বাগান, লাউয়াছড়া, শ্রীমঙ্গল, বিছানাকান্দি, লালাখাল, বিরিশিরি, উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গাসহ আরও অনেক জায়গায়।

প্রতিদিন নতুন নতুন বেড়ানোর জায়গার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে। পাশাপাশি বিকাশ ঘটছে দেশীয় পর্যটন শিল্পের। ভাবতেও অবাক লাগে শুধু দেশে নয়, লাখ লাখ মানুষ এখন বেড়াতে যাচ্ছে ভুটান, নেপাল, ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া এমনকি ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াতেও।

সবচেয়ে মজার ব্যাপারটা হচ্ছে দলে দলে যে মানুষগুলো মানুষ ভ্রমণ পিপাসু হয়ে উঠলো, এদের অধিকাংশই কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ। যারা এই শহরে বেঁচে থাকে খাঁচায় বন্দী পাখির মত। কবিগুরুর ভাষায় এরা বেঁচে থাকে ইটের মধ্যে লুকিয়ে থাকা পোকার মত “ইটের পরে ইট, মাঝে মানুষ কীট। নেইকো ভালবাসা, নেইকো স্নেহ”। এই দলটির মনের কথাই উঠে এসেছে কবির লেখনীতে -

“কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে

মেলে দিলেম গানের সুরের এই ডানা মনে মনে

তেপান্তরের পাথার পেরুই রূপকথার

পথ ভুলে যাই দূর পাড়ে সেই চুপ কথা

সাত সাগরের ফেনায় ফেনায় মিশে

আমি যাই ভেসে দূর দেশে

পরীর দেশে বন্ধ দুয়ার দেই হানা মনে মনে”

কিন্তু এখন সময় পাল্টে গেছে। এই বদ্ধ জীবন ও রুটিন বাধা জীবন থেকে বের হয়ে একটু দম ফেলার জন্য মানুষ বছরে কমপক্ষে একবার হলেও বেড়াতে যেতে চায় বা বেড়াতে যায়।

মধ্যবিত্তদের, বিশেষ করে শহুরে মধ্যবিত্তদের জীবন একবারে একঘেয়ে ও ছকে বাধা। সকালে উঠে ঘড়ির কাঁটা ধরে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়। সংসার, অফিস, স্কুল-কলেজ, যানজট, নিত্যদিনের অভাব-অভিযোগ, শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, বাজার-হাট, ধুলাবালি, যানবাহনের ভোগান্তি, খানাখন্দকে ভরা রাস্তাঘাট, মিছিল, মিটিং, আবর্জনায় ভরা একটি নগরীতে তাদের বাস। নিঃশ্বাস নেওয়ার মত জায়গা নেই কারও। বাচ্চাদের জন্য নেই খেলার জায়গা, হাঁটার জায়গা। নাই মাঠ, পার্ক, গাছগাছালি, জলাধার, আনন্দ উদযাপনের কোন জায়গা। নাগরিক জীবনের এই চাপাচাপিতে প্রায় সবারই আছে হাইপার টেনশন, ব্লাডসুগার, প্রেসার, হাইকোলস্টোরেল, ফ্রোজেন সোলডার, কোমর ও হাঁটু ব্যথা, স্নায়ুরোগ, এ্যাজমার মত মারাত্মক সব অসুখ-বিসুখ। শিশুরাও বাদ যাচ্ছে না।

দিন যত যাচ্ছে, মানুষ ততোই বুঝতে পারছে তাদের পালাতে হবে, একটু সময়ের জন্য হলেও তাদের নগরীর চার দেয়ালের ভেতর থেকে বের হতে হবে। বলা যায় নিজেদের হাঁপিয়ে ওঠা জীবন বাঁচানোর জন্যই এই মানুষগুলো পরিবার পরিজন নিয়ে বা বন্ধুবান্ধবের সাথে বেড়াতে যাওয়ার জন্য যেমন করেই হোক, বছরে একবার বা দুবার সময় বের করছে। সেটা দেশেই হোক কিংবা বিদেশেই হোক। যার যার সামর্থ্য ও ইচ্ছা অনুযায়ী তারা পরিকল্পনা করছে। বেড়ানোর ব্যাপারে মধ্যম আয়ের মানুষের আগ্রহ বাড়ছে বলে, ট্যুর কোম্পানি থেকে শুরু করে হোটেল-মোটেল ও এয়ারলাইন্সগুলো চালু করেছে বাজেট ট্যুর বা প্যাকেজ ট্যুরের ব্যবস্থা।

এদেশে নির্দিষ্ট আয়ের ও মাঝারি আয়ের মানুষদের পক্ষে একটু বিনোদন ও বিশ্রামের জন্য সময় বের করা যতোটা সম্ভব, টাকার যোগাড় করাটা ঢের বেশি কঠিন। কিন্তু এরপরও মানুষ বুঝতে পেরেছে জীবনের প্রয়োজনে তাদের যেতে হবে প্রকৃতির কাছাকাছি। শিশু থেকে বুড়ো সবার শরীর আর মন চনমনে রাখার জন্যই ঘর থেকে বাইরে পা ফেলতে হবে। মধ্যবিত্তের নাগরিক জীবন মানে চাপে-তাপে কাহিল একটি জীবন। এই জীবনকে সবুজ-সতেজ রাখার এবং সবচেয়ে বড়কথা বাঁচিয়ে রাখার জন্য বেড়ানোর কোন বিকল্প নেই।

যে মানুষগুলো ১০/১৫ বছর আগেও ভাবতে পারেনি সংসারের ফাঁকে, কষ্ট করে টাকা জমিয়ে বছর বছর শুধু প্রাণের টানে, আনন্দ করার জন্য বেড়াতে যাওয়া যায় টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া কিংবা হিল্লী থেকে দিল্লী, সেই মানুষগুলো আর ৫/১০ বছর পর যে সবাই মিলে ছুটি কাটাতে চাঁদে যাবেনা, এইবা বলি কেমন করে?

 

ছবিগুলো সংগৃহীত

Comments

The Daily Star  | English

DMCH doctors threaten strike after assault on colleague

A doctor at Dhaka Medical College Hospital (DMCH) was allegedly assaulted yesterday after the death of a private university student there, with some of his peers accusing the physicians of neglecting their duty in his treatment

4h ago