চার শহরে জীবনের জয়গান উৎসব
ঘুরে বেড়াতে কার না ভালো লাগে। আর সেই ঘুরে বেড়ানোটা যদি হয় কাজেরই অংশ, তাহলে তো একেবারে সোনায় সোহাগা। গত ১০ বছর ধরে আয়োজিত হচ্ছে ‘জীবনের জয়গান’। চলচ্চিত্র, স্থিরচিত্র এবং গীতিকাব্য প্রতিযোগিতা নিয়েই মূলত এই আয়োজন। প্রতিযোগিতা শেষে বিজয়ীদের কাজগুলো নিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয় দেশের ১২টি জেলায়। আর এই আয়োজনের অংশ হওয়ার সুবাদেই ঘুরে বেড়াতে পারি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
সম্প্রতি ১২ জেলার মধ্যে ৪টি জেলার অনুষ্ঠান হয়ে গেল। ময়মনসিংহে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং কক্সবাজারে কক্সবাজার সরকারি কলেজ নিয়ে ছিল এই পর্বের কাজ। ময়মনসিংহ এবং কক্সবাজারে শুধু স্থিরচিত্র এবং চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হলেও ঢাকা এবং চট্টগ্রামে এর সঙ্গে যুক্ত হয় কনসার্ট। দেশের নামকরা দুটি ব্যান্ড “চিরকুট” এবং “লালন”-এর সঙ্গে অংশ নেয় নতুন ব্যান্ড দল “ডুব”।
১৮ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহে অনুষ্ঠানের তারিখ নির্ধারিত ছিল। একই মাসের ১৯, ২১ এবং ২৩ তারিখ নির্ধারিত ছিল যথাক্রমে ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজারের জন্য। প্রচারণার জন্য আমাদের একটি দল আগে থেকেই কাজ করেছে এই ভেন্যুগুলোতে। আমরা পৌঁছেছি অনুষ্ঠানের আগে।
শেষটা দিয়েই শুরু করি। ২১ তারিখ চট্টগ্রামের কনসার্ট শেষে আমাদের গন্তব্য কক্সবাজার। তেমন বেশি কাজ না থাকায় ভেবেছিলাম কক্সবাজার ঘুরে দেখার আরেকটি সুযোগ বুঝি পেলাম। কিন্তু আদতে তা হয়নি। অফসিজন বলতে আসলে কী বুঝায় তা কক্সবাজার এবার আমাদের দেখিয়ে দিল। মনে হলো সবকিছুই অফ হয়ে আছে।
বাতাসটাও ঠিকমতো বইছে না। তাই ভাবলাম সমুদ্রের গর্জন শোনার আনন্দ ছাড়া আর কিছুই পাব না কক্সবাজার থেকে। ২৩ তারিখ সকালে কক্সবাজার সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মহোদয়ের হাতে স্থিরচিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন হয়ে তা দিনব্যাপী চলে। কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা বেশ আনন্দ পেয়েছে জীবনের জয়গান উৎসবের চলচ্চিত্রগুলো দেখে। বিশেষ করে “জোঁকের তেল” সিনেমাটি চলার সময় তাদের চিৎকার, হাসি আর মন্তব্যই বলে দিচ্ছিল তারা কতটা আনন্দ পেয়েছে। সব মিলিয়ে এবার কক্সবাজারে ঘুরে আনন্দ না পেলেও আয়োজনের সার্থকতার আনন্দ নিয়ে ঢাকা ফিরতে পেরেছিলাম। শেষেরটা আগে বলার কারণটা হয়তো বুঝে ফেলেছেন। আসলে বেড়ানোর আনন্দ মাটি হয়ে যাওয়ায় ভাবলাম কষ্টের কথাটুকু আগে শেয়ার করে নেই। যা হোক, চলুন ফিরি আবার শুরুতে।
১৮ সেপ্টেম্বর সকাল ৯টায় ময়মনসিংহে পৌঁছে সবকিছু ঠিক-ঠাকমতো আছে কিনা দেখে নেই। আমাদের যে দলটি কাজ করেছে তাদের সাধুবাদ দেওয়া ছাড়া আর কিছু করার বাকি ছিল না আমাদের হাতে। ত্রিশালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্থিরচিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন বেলা ১০টায়। ১১টা থেকে শুরু হওয়া চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর সময় আয়োজন কক্ষটি ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। এই পুরো আয়োজনটির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়টির ফিল্ম অ্যান্ড ফটোগ্রাফি ক্লাবের উপদেষ্টা এবং থিয়েটার ও পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আল জাবির বিশেষ ধন্যবাদ প্রাপ্য। তাঁর প্রত্যক্ষ সহযোগিতার কারণে খুব সহজেই এই অনুষ্ঠানটি আমরা সম্পন্ন ও সমাপ্ত করে সন্ধ্যা ৬টার দিকে রওনা হই পরবর্তী গন্তব্যের দিকে। রাতেই পৌঁছে যাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে।
তরুণদের কাছে ব্যান্ড সংগীত তুমুল জনপ্রিয়। আমার কাছেও তা অনুরূপ। কোথাও কোনো কনসার্টে ব্যান্ড সংগীতের আয়োজন থাকলে সেখানে তারুণ্যের উন্মাদনা চোখে পড়ে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও তার কোনো ব্যত্যয় হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়টির মুক্ত মঞ্চে ১৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় কনসার্ট হবে। এ নিয়ে আলোচনা শুনি রাতের খাবার খাওয়ার সময়ই। ছাত্ররা নিজেদের মধ্যে এ নিয়ে আলোচনা করছিলেন। রাতের বৃষ্টির কারণে কয়েকজন বলছিল, বৃষ্টির যে অবস্থা তাতে কনসার্ট করতে পারলে হয়। আমাদেরও এই বিষয়টি ভাবিয়েছিল আগেই। পথে যখন বৃষ্টি দেখেছিলাম তখনই। ময়মনসিংহ থেকে জাহাঙ্গীরনগর যাওয়ার সময়ই পরিকল্পনা করছিলাম কনসার্টটি মুক্তমঞ্চ থেকে সরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির জহির রায়হান মিলনায়তনে করার। পরদিন করতেও হলো তাই। সকাল থেকেই বৃষ্টি। আর সেই বৃষ্টির মধ্যেই বেলা ১০টার একটু পরেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য উদ্বোধন করলেন স্থিরচিত্র প্রদর্শনীর। আর এর কিছু সময় পর থেকেই শুরু হয়ে যায় চলচ্চিত্র প্রদর্শনী। সকাল থেকেই আমাদের এবং স্বেচ্ছাসেবকদের সব থেকে বেশি যে প্রশ্নটি শুনতে হয় তা হলো, এর মধ্যে মুক্তমঞ্চে কীভাবে কনসার্ট হবে। আমাদের উত্তর ছিল, এটি এখন মিলনায়তনের ভেতরেই হবে। মাইকিং করার জন্য দুটি দল বের হয়ে যায়। সারা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচার হয় “চিরকুট ব্যান্ডের কনসার্টটি বৃষ্টির কারণে সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চের বদলে জহির রায়হান মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হবে”। দুপুরের পর থেকে প্রশ্নবাণ থেকে মুক্তি পাই আমরা। এরপর শুধু অপেক্ষা। অপেক্ষা চিরকুটের। মোবাইল ফোন আসার আগে মানুষ যেমন অধীর আগ্রহ নিয়ে প্রিয়জনের চিরকুটের জন্য অপেক্ষা করত, তেমনভাবেই ছাত্র-ছাত্রীরা তাঁদের প্রিয় ব্যান্ড চিরকুটের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। বিকেল ৫টা থেকেই ভরে যেতে থাকে মিলনায়তন। স্বল্প কিছু সময়ের ভেতরেই সামনের সারির অল্প কিছু চেয়ার ছাড়া বাকি সব ভরে যায়। বাইরে আড্ডায় মগ্ন অপেক্ষমাণ আরও অনেকেই। কনসার্টের শুরুতে তারা ঢুকবেন এই আশায়। সন্ধ্যায় সব প্রস্তুতি শেষ করে কনসার্টের শুরু। প্রথমেই মঞ্চে ওঠে ব্যান্ড দল “ডুব”।
নতুন এই ব্যান্ড দলটিকে আমরা সুযোগ করে দিয়েছি আমাদের জীবনের জয়গানের মূল চেতনার কারণেই। আমরা সব সময়ই চাই বাংলাদেশের তরুণরা মেলে ধরুক তাদের প্রতিভা। এত দর্শকের সামনে তাদের তুলে দিয়ে আমরা বেশ চিন্তায়ও ছিলাম। ভাবছিলাম, পারবে তো? মুহূর্তের মধ্যেই আমাদের চিন্তা দূর করে দিল “ডুব” ব্যান্ডের ভোকাল অ্যান্ড গিটারিস্ট সাদী শাহনেওয়াজ, ভোকাল সুমাইয়া পেহনাজ উপমা, লিড গিটারিস্ট নিয়াজ মাহমুদ সফল, কাহোন বাদক অনিক ভৌমিক এবং বেজ গিটারিস্ট মাসরুর। ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের সঙ্গে সঙ্গে সুর তুলল বেশ কিছু গানে। সময়ের স্বল্পতার কারণে তাদের গানের চাকা থামাতে হলো আমাদের। কারণ, তখনো বাকি রয়ে গেছে মূল আকর্ষণ চিরকুটের গান। সুমি আপু স্টেজে ওঠার পর থেকেই আমি স্টেজের পাশে দাঁড়িয়ে পড়ি তার একটি গানের অপেক্ষায়। সেটি হচ্ছে প্রথম প্রেমে মরে যাবার গান। কারো প্রেমে এত বেশি না মজলেও কেন জানি এই গানটা যতই শুনি আরও শুনতে মন চায়। মাঝে মাঝে তো ভাবি হয়তো এমনভাবে কারো প্রেমে পড়ার সম্ভাবনা রয়ে গেছে সামনে। সে যা-ই হোক, আমি কারো প্রেমে পড়লেই কী আর না পড়লেই কী। সবাই তো এখন ব্যস্ত চিরকুটের গান নিয়ে। একটি ব্যাপার লক্ষ্য করলাম, সিনেমায় চিরকুট যে গানগুলো করেছে, সেগুলোও জনপ্রিয়তার দিক থেকে কোনোভাবেই পিছিয়ে নেই। ব্যান্ডের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উপস্থিত সবাই গেয়ে চলেছে গানগুলো। সিনেমার গানগুলোর এতো জনপ্রিয়তার পর চিরকুটের সদস্যরা সিনেমায় নিয়মিতভাবে প্লেব্যাক করার পরিকল্পনা মাথায় রাখতেই পারে।
অনেক কথা, অনেক গান আর অনেক আনন্দের পর অনেক খাওয়া হলো আমাদের। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের আয়োজনে এই অনুষ্ঠানটি আমরা করেছিলাম সেখানে। রাতের খাবারের সময় তাদের আয়োজন আমাদের প্রীত করেছিল বেশ। আর এই অনেক ধরনের অনেক কিছু শেষ হতে না হতেই আবার আমাদের অনেকটা পথ যাত্রা করার সময় হয়ে যায়। “চিরকুট” এবং “ডুব” ব্যান্ডের সদস্যদের বিদায় জানিয়ে রাত ১১টার দিকে আমাদের টিম রওনা হয়ে যায় চট্টগ্রামের উদ্দেশে। সেখানে অপেক্ষা করছে অনেক অনেক ভক্ত। ভুল ভাববেন না, আমার ভক্ত নয়। অপেক্ষা করছে “লালন” ব্যান্ডের ভক্তকুল। সেখানে লালনের কনসার্ট ২১ তারিখে।
আমাদের গাড়ি নিয়েই চট্টগ্রামের পথে রওনা দেই। গাড়িতে উঠে ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুম ভাঙল ভোর ৫টার দিকে, দলের অন্যদের ডাকে। উঠে সময় দেখে ভাবলাম, যাক তাড়াতাড়িই পৌঁছে গেছি। কিন্তু চোখ তো ছানাবড়া হয়ে গেল যখন হোটেলের নামের নিচে ঠিকানার শেষে লেখা দেখলাম কুমিল্লা। হায়, আল্লাহ, সারা রাত পরে মাত্র কুমিল্লা। পরে শুনলাম মেঘনা ব্রিজ পার হতে জ্যাম ঠেলতে হয়েছে প্রায় ঘণ্টা দুয়েক। কী আর করার, শেষ পর্যন্ত ২২ তারিখ ১১টার দিকে পৌঁছলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানেও মাইকিং করার পরিকল্পনা ছিল আমাদের। কিন্তু মাইকিং আমরা কী করব, মাইকিং তো মুখে মুখেই হচ্ছে। সব আড্ডাতেই কেন্দ্র হয়ে আছে লালন ব্যান্ডের নাম। ক্লাস নেই তাতে কী, শুধু কনসার্ট দেখার জন্যই পরের দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পরিকল্পনা করছেন অনেকেই। সারাদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরে এক পর্যায়ে চিন্তিতই হয়ে পড়লাম। কারণ এখানেও কনসার্টটি হবে মিলনায়তনের ভেতরে। বৃষ্টির সম্ভাবনার কারণে এখানেও বাইরে আয়োজন না করে ভেতরে করা হয়েছে। যা-ই হোক সময়ের ওপর ছেড়ে দিয়ে রাত কাটিয়ে ২৩ তারিখ সকালে স্থিরচিত্র প্রদর্শনীর সব প্রস্তুতি শেষ করলাম।
সেদিন সকাল ১১টায় উপাচার্য মহোদয় প্রদর্শনীর উদ্বোধন করলেন। এখানে কনসার্টটি শুরু হওয়ার সময় ছিল বিকেল ৩টা। কেননা, আমরা চাইছিলাম বিকেল ৫টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ট্রেন আছে সেই ট্রেনে যাতায়াত করা ছাত্র-ছাত্রীরা যাতে এটি মিস না করেন। সময় গড়াতে থাকে। দুপুরে খাবার খেতে যাওয়ার সময় হলে একটু উঁকি দিয়ে দেখি ভেতরে একদম পরিপূর্ণ। ওমা, এত তাড়াতাড়িই সবাই চলে এলো? ২টার মধ্যেই হল ভরে গেলে কনসার্ট শুরুর সময় কী হবে? আমাদের চিন্তা কিছুক্ষণ পর আর রাখার জায়গা পেলাম না। রাখব কোথায় পুরো অডিটোরিয়াম তো কানায় কানায় পূর্ণ। সামনে অতিথিদের জন্য বসার জায়গা তো দূর, স্টেজের সামনের জায়গাটুকুও ভরে গেছে। বাধ্য হয়ে অতিথিদের নিয়ে স্টেজের ওপর এক পাশে বসার ব্যবস্থা করতে হলো। ৪টার দিকে স্টেজে উঠল ব্যান্ড লালন। খুব একটা গান না শুনলেও লালনের গানগুলো আমাকে ভীষণ টানে। আর সেগুলো যখন ব্যান্ড লালনের হাত ধরে আধুনিকতার ছোঁয়া নিয়ে হয়, তখন তো কথাই থাকে না। কিন্তু বিধি বাম, ব্যান্ড লালনের কণ্ঠে আর গান শোনা হলো না। শুনব কীভাবে, হাজার পাঁচেক দর্শক যখন মিলনায়তনের ভেতরে সুমির সঙ্গে সঙ্গে গান গাইছে তখন আর কোনো স্পিকারের সাধ্য আছে সেই কণ্ঠ ভেদ করে শব্দ পার করে। প্রতিটি গান, প্রতিটি লাইন তারা গাইছিল তারুণ্যের আমেজ নিয়ে।
কনসার্ট শেষে জীবনের জয়গান উৎসবের পরিচালক রাফি হোসেন এবং স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশের কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স প্রধান বিটপী দাশ চৌধুরীর কথায় উঠে আসছিল একটিই কথা, আর তা হলো এভাবেই সবাই গাইতে থাক জীবনের জয়গান।
Comments