দুই চাকায় ভ্রমণ

দুই চাকার পরিবেশবান্ধব বাহন সাইকেল। অনেকেই শখের বাহন, কারো আছে আবার নিত্যদিনের প্রয়োজন মেটানোর বহুদিনের সঙ্গী।
সাইকেল
সাইকেলে করে ঘুরে বেড়ানোটা কারো কাছে শখ, কারো কাছে আবার নেশার মতোই। ছবি: মাহাদি

 দুই চাকার পরিবেশবান্ধব বাহন সাইকেল। অনেকেই শখের বাহন, কারো আছে আবার নিত্যদিনের প্রয়োজন মেটানোর বহুদিনের সঙ্গী। সাইকেল শুধু একটি বাহন নয়, কেন যেন এর সঙ্গে যুগ যুগ ধরে জড়িয়ে আছে অনেক গল্প, অনেক আবেগ-অনুভূতি। যুগ যুগ ধরে সাইকেল প্রয়োজনীয় বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এলেও এখন এই দু-চাকার বাহনের সংজ্ঞা বদলেছে অনেকখানি। শুধু আসা-যাওয়ার বাহন হিসেবে নয়, সাইকেল এখন ব্যবহৃত হচ্ছে হুট করে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ার অন্যতম বাহন হিসেবে। কেউবা আবার বহুদূরের পথ কিংবা দুর্গম রাস্তার অ্যাডভেঞ্চারের সঙ্গী হিসেবেও বেছে নেন সাইকেলকে। কেউ আবার ছোট-বড় সাইকেল গ্রুপ নিয়ে ছুটির দিনে বেরিয়ে পড়েন ডে-ট্রিপে।

 

এক ঢিলে দুই পাখি

সাইকেলে করে ঘুরে বেড়ানোটা কারো কাছে শখ, কারো কাছে আবার নেশার মতোই। জ্যামের এই শহরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়িতে বসে কাটানোর চেয়ে সাইকেলে ঘুরে বেড়ানোটা একদিকে যেমন সময় সাশ্রয়ী, অন্যদিকে শরীরের পক্ষেও বেশ কার্যকরী। ব্যস্ততার জন্য যারা ব্যায়ামে সময় দিতে পারেন না তারা বাহন হিসেবে বেছে নিতে পারেন সাইকেলকে। জ্যামের সময়টাও বেঁচে গেল আর শরীর ও মন থাকল ফুরফুরে।

সাইকেল
মডেল: আজিম ও পিয়া; ছবি: শাহরিয়ার কবির হিমেল

শখ থেকে নেশায়

শুধু শখের বশে এদিক-সেদিক সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়া নয়, সাইক্লিং তারুণ্যের বিশেষ প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সপ্তাহান্তে বাসায় গা এলিয়ে দেয়ার পরিবর্তে অনেকেই সাইকেল নিয়ে চলে যায় ঢাকা শহর কিংবা ঢাকার আশপাশের জায়গাগুলো চষে বেড়াতে। আজ সাভার তো কাল নারায়ণগঞ্জ- এভাবেই চলছে সাইকেলচারীদের প্রত্যেকটা ছুটির দিন। সাইকেলের মায়া যেন অদ্ভুত এক নেশা হয়ে পড়েছে তাদের জন্য। এমনকি শুধু সমতলেই নয়, পাহাড়, নদী পেরিয়ে সাইকেলে চেপে বহুদূরের পথ পাড়ি দেয়ার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকেন এখন অনেক দ্বিচক্রযান-প্রেমীরা।

সাইকেল
মডেল: পিয়া; ছবি: শাহরিয়ার কবির হিমেল

জনসচেতনতায় সাইকেল ভ্রমণ

সাইকেল ভ্রমণ যে সবসময় নেশা, পেশা কিংবা স্রেফ ভ্রমণের কাজে ব্যবহার করে তা কিন্তু নয়। যুগে যুগে সাইকেল নিয়ে অনেকে বেরিয়ে পড়েছেন সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে। ২০১৪ সালে ‘আপনার সন্তানকে স্কুলে পাঠান, সুশিক্ষায় শিক্ষিত করুন’, ‘নিরাপদ সড়ক চাই, সুস্থভাবে বাঁচতে চাই’, ‘ঘুষ ও দুর্নীতি হতে বিরত থাকুন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান’, ‘মাদক থেকে বিরত থাকুন, সুস্থভাবে বেঁচে থাকুন’, ‘ফরমালিন ব্যবহার রোধ করুন, সুস্থভাবে বেঁচে থাকুন’, ‘জীববৈচিত্র্য রক্ষা করুন বাংলাদেশ বাঁচান’ এই ছয়টি স্লোগানকে সামনে রেখে তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ সাইকেলে পাড়ি জমান বাংলাদেশি ২০ যুবক। এছাড়া বিশ্বব্যাপী ‘সাইক্লিং ফর অ্যাওয়ারনেস’ নামে গোটা পৃথিবী জুড়েই বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক সব কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন অনেক সাইকেলপ্রেমীরাই।

সাইকেল
মডেল: আজিম ও পিয়া; ছবি: শাহরিয়ার কবির হিমেল

সাইকেলের সঙ্গে জড়ানো প্রেমকাহিনী

প্রেমের ডাকে সাত সমুদ্র পাড়ি, কাঁটাতার ভেদ করে প্রবেশ করার ঘটনা শোনা যায় অনেক। প্রেমের কারণেই সাইকেলে চেপে ভারত থেকে সুদূর সুইডেনে পাড়ি জমান ড. প্রাদ্যুমন কুমার মহানন্দিয়া। প্রেমিকা শার্লট ভন প্লেনের টিকেট পাঠাতে চাইছিলেন, তবে প্রাদ্যুমন  চেয়েছিলেন নিজের রোজগারের টাকাতেই সেখানে পৌঁছতে। আর সেই জেদই পরিণত হয় মহাকাব্যে। সাড়ে চার মাস সাইকেলে ভ্রমণ করে তিনি পৌঁছান সুইডেনে। চল্লিশ বছর একসঙ্গে সুইডেনে সুখে সংসার করছেন এই দম্পতি।

 

সাইকেল নিয়ে ভালোবাসায় বিডি সাইক্লিস্ট

বাংলাদেশের তরুণরা এখন সাইকেল নিয়ে নিজেদের ঘুরে বেড়ানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে গড়ে তুলেছে ‘বিডি সাইক্লিস্ট’ নামের কমিউনিটি। সেই কমিউনিটির উদ্যোগেই সম্প্রতি হয়ে গেল বিশ্ব রেকর্ডের এক অসাধারণ প্রচেষ্টা। কিন্তু কিসের টানে দ্বিচক্রযানের সঙ্গে এই ভালোবাসায় জড়িত হয়েছেন তারা? সেই প্রশ্নের উত্তরে বিডি সাইক্লিস্টের অন্যতম মুখ এবং একদম শুরু থেকে যুক্ত সাইক্লিস্ট আখলাকুর রহমান রাহী বলেন, ‘পুরো শহর যখন ঘুমিয়ে আছে তখন আড়মোড়া ভেঙে চুপিচুপি বাড়ির মূল ফটক পেরিয়ে একে একে বেরিয়ে পড়ে পঙ্গপালের দল। এই হিমশীতল ঠা-ায় যখন সবচেয়ে সাহসী ছেলেটাও কাবু হয়ে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে, তখন এই দলছুটেরা কুয়াশায় লাইটের আলো ফেলে ভোরের অন্ধকার চিরে একে একে ছুটছে শহরের সীমানা ছাড়িয়ে। গন্তব্য শহর ঘেঁষা গ্রামের মেঠো পথ। সোঁদা মাটির গন্ধ আর চার পাশে সবুজ গাছপালা শুধু মনকে প্রশান্তিই দেয় না বরং সহ-সাইক্লিস্টদের সঙ্গে গাঁয়ের টং দোকানে মালাই চা আর তুমুল আড্ডা ফিরিয়ে দেয় নব্বইয়ের সজীব আর প্রাণবন্ত দিনগুলো। মুঠোফোনসর্বস্ব একঘেয়ে জীবন থেকে বেরিয়ে এসে একটু প্রশান্তি আর বন্ধুদের সঙ্গে খুনসুটির আনন্দ শুধু তারাই জানে। আর তারা কারা? এ শহরেরই কিছু দ্বিচক্রযান পাগল!’ এমন অসাধারণ বর্ণনার পর কেন এই ভালোবাসা? এই প্রশ্নের উত্তর আবারো খুঁজতে যাওয়াটা বেশ বোকামিই বলা চলে।

সাইকেল
সাইকেল ভ্রমণ যে সবসময় নেশা, পেশা কিংবা স্রেফ ভ্রমণের কাজে ব্যবহার করে তা কিন্তু নয়। ছবি: মাহাদি

নির্বাচনী প্রচারণায়

অনেকেরই মনে থাকার কথা। মেয়র নির্বাচনে ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হক নিজেই সাইকেল চালিয়ে অংশ নিয়েছেন প্রচারণায়। আর পরিচ্ছন্ন ও দূষণমুক্ত ঢাকা গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

পেশাদার প্রতিযোগিতা

ঢাকায় পেশাদার প্রতিযোগিতা সে অর্থে নেই। তবে সেই খেদ দূর হয়েছে। বাংলাদেশ সাইক্লিং ফেডারেশনের উদ্যোগ আর বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেডের পৃষ্ঠপোষকতায় এবার সেই আয়োজন হয়েছে বাংলাদেশে। নাম ফরচুন ট্যুর ডি বাংলাদেশ। মূল উদ্যোগ আর ভাবনাটা বলতেই হবে বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেডের। উদ্দেশ্য বাংলাদেশে সাইক্লিংকে জনপ্রিয় করার পাশাপাশি বাংলাদেশে স্পোর্টস ট্যুরিজমকে জনপ্রিয় করা। বিশ্বে বাংলাদেশকে তুলে ধরা। ট্যুর ডি ফ্রান্সের আদলেই আয়োজন করা হচ্ছে এই আসর।

এবার বাগেরহাট, গোপালগঞ্জ, টুঙ্গিপাড়া ও ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছে তিনটি পর্ব। গত ডিসেম্বরের এই প্রতিযোগিতায় ৮টি দলে মোট ৪০ জন সাইক্লিস্ট অংশ নেন। আগামী বছর ট্যুর ডি বাংলাদেশে যোগ হবে কক্সবাজার পর্ব। বাড়বে প্রাইজমানি আর যোগ হবে সার্ক দেশের প্রতিযোগী। প্রথম ফরচুন ট্যুর ডি বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতার তিন পর্ব মিলিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের সিরাজুল ইসলাম। দ্বিতীয় হয়েছেন সতীর্থ  রিপন বিশ্বাস। আর তৃতীয়, সেনাবাহিনীর আলমগীর।

দেশে সাইক্লিংকে জনপ্রিয় করার পাশাপাশি এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বিশ্বে বাংলাদেশকে অন্যতর উচ্চতায় উন্নীত করার লক্ষ্যে পৃষ্ঠপোষক হিসেবে সর্বাত্মক সমর্থন ও সহযোগিতা করেছে বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেড। আর তাদের প্রিমিয়াম ব্র্যান্ড ফরচুন যোগ হয়েছে প্রতিযোগিতার নামের সঙ্গে।

সাইকেল
মডেল: আজিম; ছবি: শাহরিয়ার কবির হিমেল

শখের সাইকেলবৃত্তান্ত

সাইকেল নিয়ে অনেক গল্প হলো। এবার জানা যাক প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য। শখের সাইকেল আর সাইকেলের অনুষঙ্গগুলো নিয়ে সাইকেলপ্রেমীরা বেশ সচেতন। ব্র্যান্ড, মূল্য ও বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভর করে সাইকেলের বিভিন্ন রকম-সকম রয়েছে।

বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে অন্যতম লায়ন, লায়ন অপটিমাস, গোল্ডেন হুইল, আপল্যান্ড, মেরিডো ইত্যাদি। বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে আপল্যান্ডের দাম ২০-৬০ হাজার টাকা, ট্রেকের দাম ৩০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকার মতো আর মেরিডার দাম ১৮ থেকে ৫০ হাজার টাকার মধ্যে। তবে দাম শুনে পকেটের দিকে তাকিয়ে হা হুতাশ শুরুর আগেই জেনে রাখুন, আমাদের দেশেও বেশ ভালো মানের সাইকেল পাওয়া যাচ্ছে এখন। দেশি ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে মেঘনা গ্রুপের স্টিল ফ্রেমের বাইকগুলো পাওয়া যাবে ৭-১১ হাজার টাকার ভেতর, অ্যালুমিনিয়াম ফ্রেমের সাইকেলের দাম ১২ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। মেঘনা গ্রুপের ভ্যালোস, টেলাস, ডায়মন্ডব্যাক, কোর, রয়্যাল ইত্যাদি দেশি ব্র্যান্ডের সাইকেল বেশ জনপ্রিয় তরুণদের মধ্যে। পাওয়া যাবে ১৩ থেকে ৩০ হাজার টাকায়।

সাইকেল কিংবা সাইকেল বিষয়ক যেকোনো অনুষঙ্গের জন্য সবচেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য স্থান পুরান ঢাকার বংশাল। দেশি-বিদেশি সব ধরনের সাইকেলের পসরা রয়েছে সেখানে। এছাড়া গুলশান, উত্তরা, মিরপুর, পান্থপথে রয়েছে বেশ কিছু সাইকেলের শোরুম এবং অনুষঙ্গের দোকান। সাধারণত সাইকেল কেনার সময় সংশ্লিষ্ট দোকান বা কোম্পানি থেকে ছয় মাস বা এক বছরের ওয়ারেন্টি দেওয়া হয়। সেই ওয়ারেন্টি সম্পর্কে সঠিকভাবে জেনে নিন কেনার সময়ও। তবে যেখান থেকে সাইকেল কেনা হয়, ওয়ারেন্টি ছাড়াও অন্য যেকোনো সময় সাইকেলে কোনো সমস্যা হলে সে দোকানে সাইকেল সারানোর ব্যবস্থা রাখা হয়। সাইকেল সারানোর জন্য প্রধান দোকানগুলোও বংশালেই পাওয়া যাবে।

সাইকেল
মডেল: আজিম ও পিয়া; ছবি: শাহরিয়ার কবির হিমেল

সাবধানতা

শখের সাইকেল নিয়ে বিপত্তিতে পড়তে চাইবেন না কেউই। তাই কেনার আগে বেশ কিছু বিষয়ে দেখে নিয়ে কেনা উচিত। যেমন- গিয়ার, ফ্রেম, ডুয়াল সাসপেনশন, ব্রেক, সিট, টায়ার, চেইন এসব দেখেশুনে বুঝে নেয়া উচিত সাইকেল কেনার আগেই। এছাড়া সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে সাইকেলের সঙ্গেই হেলমেট, গ্লাভস, স্ট্যান্ড, ফ্রন্ট লাইট এসবও একেবারেই কিনে নেওয়াই শ্রেয়। আর সাইকেল নিয়ে উত্তেজনাটাও কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে প্রাথমিক দিকে। হুট করেই হাইওয়ে বা বড় রাস্তায় না উঠে গিয়ে প্রথমেই নিজের চালনা নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।

ডে-ট্রিপ হোক বা অ্যাডভেঞ্চার, সাইকেল নিয়ে উন্মাদনা, সাইকেলের প্রতি ভালোবাসা টিকে থাক, সাবধানে সাইক্লিস্টরা দেশের পতাকা নিয়ে এগিয়ে যাক দৃঢ় প্রত্যয়ে।

 

কৃতজ্ঞতা : আহমেদ সাদাত মোমেন

ম্যানেজিং ডিরেক্টর, বাইসাইকেল শপ লি. এবং ডিস্ট্রিবিউটর জায়েন্ট বাইসাইকেল

  

Comments

The Daily Star  | English

DMCH doctors threaten strike after assault on colleague

A doctor at Dhaka Medical College Hospital (DMCH) was allegedly assaulted yesterday after the death of a private university student there, with some of his peers accusing the physicians of neglecting their duty in his treatment

5h ago