অনলাইনে নারীর উচ্ছল পদচারণা

অনলাইন, ইন্টারনেট এখন শুধু অবসর সময় কাটানোর জায়গা নয়। মেধা, সময় ও দক্ষতা কাজে লাগিয়ে অনলাইনই হয়ে উঠতে পারে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর এক অন্যতম মাধ্যম- সেটি প্রমাণ করেছেন অনেকেই। আর নারীরাও পিছিয়ে নেই এই ক্ষেত্রে।

অনলাইন, ইন্টারনেট এখন শুধু অবসর সময় কাটানোর জায়গা নয়। মেধা, সময় ও দক্ষতা কাজে লাগিয়ে অনলাইনই হয়ে উঠতে পারে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর এক অন্যতম মাধ্যম- সেটি প্রমাণ করেছেন অনেকেই। আর নারীরাও পিছিয়ে নেই এই ক্ষেত্রে। চাকরির পেছনে না ছুটে অনলাইনে নিজের ইচ্ছের বিষয়টাকে পেশা হিসেবে সাজিয়ে নিয়েছেন এমন আছেন অনেকেই। খুব সহজ পথে হাঁটছেন না এই অনলাইন উদ্যোক্তারা। তথাকথিত সব প্রতিষ্ঠিত পেশায় না জড়িয়ে নিজের নামে, নিজের মতো করে কিছু তৈরি করার চেষ্টা করছেন। বন্ধুর কিন্তু আনন্দদায়ক এই কাজের সফল কিছু মুখ নিয়ে আনন্দধারার নারী দিবসের আয়োজনের এই পর্ব।

ইসপিয়া মমতা
ইসপিয়া মমতা

ইসপিয়া মমতা

তরুনিমা’স বিবর্তন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। বরাবরই মেধাবী ছাত্রী হিসেবে নাম ছিল ইসপিয়ার। তাই সবার ধারণা ছিল পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষকতা পেশায় ঢুকবেন। সেই মোতাবেকই সব চলছিল। মাস্টার্স শেষ করেই একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার হিসেবে যোগ দেন তিনি। ২০১৪ সালে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে চাকরি ছাড়েন। কিন্তু এরপর থেকেই হতাশা ভর করতে থাকে। একজন শিক্ষিত নারী হয়ে নিজের এই বেকার পরিচয় মেনে নিতে পারছিলেন না তিনি। ঠিক সেই সময়ই ব্যবসায়ের চিন্তা ভর করে ইসপিয়ার মাথায়। কাছের কিছু মানুষের সহযোগিতায় বলতে গেলে একেবারে বিনা পুঁজিতেই ব্যবসায় নামেন তিনি। সমাজের অনেকেই এই পেশা মেনে না নিলেও সহযোগিতা পেয়েছেন পরিবার ও কাছের মানুষের কাছ থেকে। সেই থেকে চলছে ‘তরুনিমা’স বিবর্তন’-এর যাত্রা। শুরুতে বিদেশি বিভিন্ন পণ্য এনে ব্যবসা শুরু করলেও এখন সম্পূর্ণই স্বদেশমুখী হয়েছেন ইসপিয়া। হাতের কাজের ডিজাইনার শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ ও গয়না তৈরি করে নিখুঁত কাজ ও দেশীয় ভাবমূর্তি বজায় রাখার জন্য ইতোমধ্যেই নাম করেছেন তিনি। তরুনিমা’স বিবর্তন নিয়ে ইসপিয়ার প্রাপ্তির কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অনেক ক্রেতাদের নিখাদ ভালোবাসা আর বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছি। এর চেয়ে বেশি আর কী লাগে?’ অবশ্য অনেক অবহেলাও সহ্য করতে হয়েছে ইসপিয়াকে। তবে সাফল্যের কারণে সেসব আর এখন খুব বেশি মনে রাখতে চান না তিনি। নিজের কাজকে ব্যবসায়ের খাতিরেই না রেখে বরং একটি ব্র্যান্ড গঠনের স্বপ্ন দেখেন ইসপিয়া, স্বপ্ন দেখেন ভালো মানের স্বদেশী পণ্য নিয়ে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ার।

নবনীতা রায় ও সামিয়া
নবনীতা রায় ও সামিয়া

নবনীতা রায়

গ্রাম্পি ফিশ

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম থেকেই ছোটখাটো চাকরি করতেন নবনীতা। সেখান থেকেই বুঝতে পারলেন এমন গৎবাঁধা চাকরির চেয়ে নিজের মতো করে কিছু করার প্রতিই আগ্রহ বেশি তার। একদিন এক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার হিসেবে খুব দ্রুত একটা কাস্টমাইজড টিশার্ট দরকার ছিল, যার জন্য কাজ করতে গিয়েই পথচলা শুরু নবনীতার গ্রাম্পি ফিশের। সঙ্গে সঙ্গী সহপাঠী ও প্রিয় বন্ধু সামিয়া। গ্রাম্পি ফিশের কাজ করার ধরন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ছাত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশে অধিকাংশ নাগরিকের বয়স ২০ থেকে ৩০-এর ভেতর, এদের মধ্যে আবার একটা গ্রুপ আছে যারা পপ কালচারের ফ্যান- সিরিজ ফ্যান, আমরা এই সিরিজ লাভারদের জন্য টিশার্ট বানাই। তাছাড়া যে কোনো কোম্পানি অথবা ইভেন্টে টি-শার্ট লাগেই, সেক্ষেত্রে সেই টি-শার্টও আমরা কাস্টমাইজড অর্ডার নিয়ে বানিয়ে দেই। ‘বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কোনো মেয়ে উদ্যোক্তার জন্যই চলার পথটা সহজ নয়, নবনীতাদের অভিজ্ঞতাও এমনটাই। ব্যবসার কাজে গাজীপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ যেমন যেতে হয়েছে, আবার একদম শ্রমিকরা যেখানে কাজ করে সেই পরিবেশে গিয়ে কাজ বুঝে নিতে হয়েছে। কিন্তু দিন শেষে আসলে যখন কাউকে গ্রাম্পি ফিশের টি-শার্ট পরতে দেখি ওটাই বড় প্রাপ্তি মনে করেন নবনীতা। এখন পর্যন্ত ধর, সেভেন রিংস সিমেন্টসহ অনেক লিডিং কোম্পানির টি-শার্ট বানানোর কাজ করেছে গ্রাম্পি ফিশ, যা নিঃসন্দেহে অর্জনের ঝুলিকে আরো সমৃদ্ধ করেছে।

নবনীতা ও সামিয়া দু’জনেই বর্তমানটাকে ভবিষ্যতের চেয়ে বেশি বিশ্বাস করেন। প্রতিদিন চেষ্টা করেন আগের দিনের চেয়ে ভালো টি-শার্ট বানাতে। ‘যত কিছুই হোক হাল ছাড়ছি না, গ্রাম্পি ফিশ অন্যান্য স্টার্ট আপের মতো স্টার্ট হয়ে হারিয়ে যাবে না’- এমন দৃঢ়কণ্ঠেই নবনীতা জানান তার স্বপ্নের কথা।

ইফফাত ই ফারিয়া
ইফফাত ই ফারিয়া

ইফফাত ই ফারিয়া

প্যাস্টেলস

২০১৪ সালের জানুয়ারিতে প্যাস্টেলস নিয়ে যাত্রা শুরু করেন ইফফাত ই ফারিয়া। এর আগে বরাবরই নিজের ডিজাইন করা পোশাক পরতেন। সবার প্রশংসাও পেতেন। কেউ কেউ আবার তার কাছ থেকে নকশা করে জামা বানাত। এসব করতে করতেই উঁকি দেয় প্যাস্টেলসের স্বপ্ন। ২০১৪ সালে উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে পাড়ি জমানোর সব কাজকর্ম শেষ করে অবসর সময়েই হুট করে শুরু করলেন প্যাস্টেলস। আর মাত্র ৬০০০ টাকা মূলধনের সেই প্যাস্টেলসই ফারিয়া’র জীবনের সেরা সিদ্ধান্ত হয়ে দাঁড়াল। পরিচিত একজনের হলুদের পোশাক তৈরি করা থেকে শুরু করে পরে আর পেছনে তাকাতে হয়নি তাকে। বিয়ে কিংবা উৎসবে পরার মতো গাউন ডিজাইন করে প্যাস্টেলস। বিভিন্ন বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনের অনুপ্রেরণায় নিজের মতো করে পোশাক বানিয়ে দেয়ার কাজও করেছেন অনেক।

ছোট পরিসরে শুরু করা কাজ দিয়ে শুরু হয়ে প্যাস্টেলসের আজ আছে নিজস্ব কারখানা। ৮ জন কর্মচারী প্রতিনিয়ত কাজ করে এই অনলাইন ব্যবসাটাকে চালিয়ে রাখতে। নানান বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়েছে যদিও, অনলাইন অ্যাটাকের শিকার হয়ে হারাতে হয়েছে লাখ খানেক ফলোয়ার সমৃদ্ধ পেজটি, কিন্তুথেমে থাকেননি ফারিয়া ও প্যাস্টেলস কেউই। ব্যবসায়ের লাইসেন্স পেয়ে এখন আরো বড় পরিসরে কাজ করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।

প্যাস্টেলস প্রসঙ্গে ফারিয়া বলেন, ‘আমার ডিজাইন করা পোশাক পরে একজন নিজের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে পা রাখবে ভাবলেও একটা শিহরণ অনুভব করি। রঙিন পোশাকে হাসিখুশি তরুণীরা একেকজন পোশাকের সৌন্দর্য বাড়িয়ে তোলে বহুগুণ। পোশাক বাইরের দেশেও পাঠাই। রাশিয়া, জার্মানি, কাজাখস্তান এবং মালয়েশিয়ান কিছু ক্লায়েন্ট তাদের বিয়ের দিনের ছবি যখন আমাকে পাঠিয়ে ড্রেসের বিষয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে, সেটাকেই নিজের প্রাপ্তি মনে হয়।’

সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ায় অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলেন ফারিয়া। আন্তর্জাতিকভাবে প্যাস্টেলসের বিস্তারের স্বপ্ন দেখেন ফারিয়া। আন্তর্জাতিক কোনো ফ্যাশন উইকে প্যাস্টেলসের পোশাক পরে সুপার মডেলরা হাঁটবে, এই স্বপ্নে বিভোর হয়ে অক্লান্ত কাজ করে যাচ্ছেন তিনি।

উম্মে সালমা সোমা
উম্মে সালমা সোমা

উম্মে সালমা সোমা

ক্রাফ্টস অ্যান্ড আর্টিস্ট্রি

কাগজের শিল্পের কারিগর সোমা, সামান্য কাগজ থেকেই রঙ-বেরঙের ফুল, পাতা আর ঘর সাজানোর বিভিন্ন অনুসঙ্গ বানান তিনি। কাগজ দিয়ে নতুন কিছু করার চিন্তাতেই ২০১৫ সালে শুরু করেন ক্রাফট অ্যান্ড আর্টিস্ট্রি নামের অনলাইন পেইজ ও গ্রুপ। সবসময়ই ক্রাফট নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে ছিল সোমার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হওয়ার সুবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে স্টেজ ও ডেকোরেশনের কাজ করেন এবং প্রশংসা কুড়ান। সবার এমন আগ্রহেই ভাবলেন, পছন্দের এই কাজ কীভাবে পেশায় রূপান্তর করা যায়। এভাবেই শুরু। বন্ধুদের উৎসাহেই কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

ডেকোরেশনে গৎবাঁধা বেলুন আর ফুলের ব্যবহারে পরিবর্তন আনতে চান সোমা। কম খরচে কীভাবে ভিন্নভাবে স্টেজ ও অনুষ্ঠানের আনুষঙ্গিক সবকিছু সাজানো যায় সেই ভাবনা থেকেই কাগজের বিভিন্ন ডিজাইনের ফুল, পমপম, রঙিন পাখা, ব্যানার এসবের কাজ করে চলেছেন। ঘরোয়া কিংবা বাইরের আয়োজনে ভিন্ন লুক দিতে সোমা কাজ করে যাচ্ছেন তার ক্রাফটস অ্যান্ড আর্টিস্ট্রি নিয়ে।

সোমা বলেন, ‘পড়াশোনা শেষ করে এই পেশায় আসব সেটা পরিবার ঠিকভাবে মেনে নিতে পারেনি কখনো। কিন্তু আমি আমার ভালোলাগার জায়গা থেকে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি আর শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। সবার মধ্যে নতুন কিছু পৌঁছে দিতে পেরে আমি নিজেকে সফল মনে করি। কাজ করতে গিয়ে গ্রাহকদের ভালোলাগা এবং চাহিদা সম্পর্কেও ভালো অভিজ্ঞতা হয়েছে।’

সোমা চান তার এই উদ্যোগ শুধু ঢাকা কিংবা অনলাইনে সীমাবদ্ধ না রেখে পুরো দেশে ছড়িয়ে দিতে। সৃজনশীলতা দিয়ে খুব কম খরচে একটি অনুষ্ঠানকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা যায় সেটা সবার কাছেই পৌঁছে দিতে চান গুণী এই শিল্পী।

অন্তরা মেহরুখ আজাদ ও অনন্যা মেহপার আজাদ
অন্তরা মেহরুখ আজাদ ও অনন্যা মেহপার আজাদ

অন্তরা মেহরুখ আজাদ ও অনন্যা মেহপার আজাদ

মালাইকাট ক্যাসকেট

চারুকলার ছাত্রী দুই বোন অনন্যা ও অন্তরা। স্বাভাবিকভাবেই রঙতুলির সঙ্গে পরিচয় সেই ছোটবেলা থেকে। ছোটবেলাতেই মায়ের সঙ্গে অনেকের কাপড়ে, রুমালে ছবি এঁকে দিয়েছেন। শিল্পের সঙ্গে বসবাস এই দুই বোনের ইচ্ছে ছিল এমন একটা মাধ্যম তৈরি করা, যেখানে শিল্পকে মায়ার সঙ্গে গায়ে জড়িয়ে রাখা যায়। সেই ভাবনা থেকেই বন্ধুদের উদ্দীপনা আর আগ্রহে রঙতুলি হাতে নিয়ে ক্যানভাস হিসেবে বেছে নেন শাড়ি, ওড়না অথবা যখন যেই পোশাকে ক্রেতারা পেইন্টিং চান সেই পোশাককে। এভাবেই শুরু মালাইকাটের যাত্রা। নিজেদের পেইন্টিংকে ওয়্যারেবল আর্টে পরিণত করতে সফল হয়েছেন এই দুই বোন। শাড়িতে পদ্ম, ময়ূর কিংবা একগুচ্ছ কাঠগোলাপ বা হলুদ গাঁদা বা যেকোনো আর্টকে কাপড়ে ফুটিয়ে তুলতে জুড়ি নেই এই দুই মালাইকাট কন্যার। সঙ্গে বন্ধু রূপন্তী যোগ দেন ব্যবসায়ের দেখভালের জন্য। এভাবেই এখন চলছে তাদের শিল্প নিয়ে এগিয়ে চলা।

পেইন্টিংটা খুব ভালোবাসেন, তাই নিজের সব ভালোবাসা দিয়ে একেকটি পোশাকের কাজ করেন এই দুই বোন। আর তার পূর্ণতা পায় যখন নিজেদের পেইন্টিংকে এভাবে মানুষের গায়ে মায়ার জড়িয়ে থাকতে দেখেন। অন্তরা ও অনন্যা বলেন, ‘আমরা প্রথমে যখন ফেসবুকে আমাদের কাজের ছবি দেই, এত সাড়া পাব আশা করিনি। কিন্তু মানুষের ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে কাজ করে যাচ্ছি এখন। খুব ভালো লাগে যখন কেউ নিজের খুব পছন্দের কিছু আমাদের দিয়ে পেইন্ট করিয়ে নেন।’ অন্তরা-অনন্যা এবং রূপন্তী তিনজনই একই লক্ষ্যে কাজ করছেন এখন। নিজেদের পণ্যগুলোকে শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তারা। এছাড়া দেশে মার্জিত হ্যান্ডপেইন্টেড পণ্যের বাজার তৈরি করতে চায় মালাইকাট।

Comments

The Daily Star  | English

Rooppur Nuclear Power Plant: First unit to start production in Dec

One of the two units of the Rooppur Nuclear Power Plant will be commissioned this December if transmission lines are ready although the deadline for the project’s completion has been extended to 2027.

4h ago