বানিয়া লুকায় সাঁজের মায়া
বানিয়া লুকা। বসনিয়া-হারজেগোভিনার দ্বিতীয় প্রধান শহর। রাজধানী সারায়েভোর কথা জানা ছিল অল্পবিস্তর। নব্বই দশক জুড়েই তো পশ্চিমা মিডিয়ার দৈনন্দিন সংবাদ শিরোনামে ছিল বসনিয়া, সার্বিয়ার জাতিগত দাঙ্গা, ক্রোয়াট মুসলিম, গণহত্যা, মসজিদে হামলা, লুটতরাজ ইত্যাদি শব্দগুচ্ছ। সায়ায়েভো, আলিয়া ইজেতবেগোভিচ, স্লোবোদান মিলোসেভিচ, রাদোভান কারাদজিচ- এসব নাম ছিল বহুশ্রুত। তাহলে আমরা সারায়েভো না গিয়ে বানিয়া লুকা কেন যাচ্ছি?
মিলেনাকে জিজ্ঞেস করতেই জানলাম, বসনিয়ার পরোক্ষ কর কর্তৃপক্ষের (শুল্ক বিভাগ) সদর দফতর রাজধানীতে নয়, বানিয়া লুকায়। কেন? প্রশ্নটি না করে থাকতে পারলাম না। বিষয়টি জটিল, বলল মিলেনা। কিছুটা রাজনৈতিক। বানিয়া লুকা হলো স্প্রসকা প্রজাতন্ত্রের রাজধানী। যুদ্ধের পর আঞ্চলিক দাবি-দাওয়া মেটাতে নানা সরকারি বিভাগের দফতরও বণ্টন করতে হয়েছে। বিষয়টি অনেক জটিল। যেতে যেতে বলব।
দেখতে দেখতে ফেব্রুয়ারির সেই মেঘলা সকাল। সহকর্মী মিলেনা বুদিসিরোভিচ আর আমি ওয়ার্ল্ড কাস্টমস অর্গানাইজেশনের হয়ে বসনিয়া যাচ্ছি। ওদের সরকারের দফতরগুলোকে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার বাণিজ্য সুবিধা চুক্তি (ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন এগ্রিমেন্ট) বাস্তবায়নে সহায়তা করতে। মিলেনা সার্বিয়ার। বসনিয়ায় ওর কাছে বাড়ির অদূরবর্তী আঙিনা। আমার জন্য মধ্য আর পূর্ব ইউরোপে প্রথম পদার্পণ। স্বভাবতই আমার উত্তেজনা বেশি। এটা-ওটা প্রশ্ন করে সারাক্ষণ তটস্থ রেখেছি ওকে।
ব্রাসেলস থেকে সরাসরি বানিয়া লুকায় ফ্লাইট নেই। যেতে হবে জাগরেব। ঘণ্টা দুয়েক লাগবে। জাগরেব বিমানবন্দরে আমাদের নিতে আসবে। জাগরেব বিমানবন্দরের বেষ্টনী পেরোতেই ঠান্ডা হাওয়ার পরশ লাগল মুখে। আহ্! আগেভাগেই রুপালি রঙের শেভরোলে অভিও নিয়ে অপেক্ষায় ছিল শফার রুস্তম। দশাসই চেহারা পাহলোয়ান রুস্তমকে মনে করিয়ে দেয়। সোহরাব-রুস্তমের কিংবদন্তি কী এ অঞ্চলের, চকিতে প্রশ্ন জাগে মনে। নাহ্! তা কেন হবে? রুস্তম ছিলেন সিস্তানের বীর, বাদশাহ্ কায়কাউসের প্রিয়প্রাত্র। সেখানেই রাজকন্যা তাহমিনার সঙ্গে প্রেমও হয়। তাহমিনা ছিলেন রুস্তমের শৌর্যবীর্যের একনিষ্ঠ ভক্ত। এক রাতে তাহমিনা রুস্তমের ঘরে চলে আসেন আচমকা। এসেই অদ্ভুত এক প্রস্তাব, রুস্তমের কাছে তিনি সন্তান চান, বিনিময়ে তিনি রুস্তমকে তেজি ঘোড়া ফেরত দেবেন। ঠিক হয়, মেয়ে হলে তার চুলে আর ছেলে হলে বাহুতে বেঁধে দেবেন রুস্তমের নামাঙ্কিত সিল। ছেলেই হলো, নাম রাখলেন- সোহরাব।
তাহমিনার সঙ্গে রুস্তমের আর যোগাযোগ নেই। সোহরাবও বড় হচ্ছে। ওদিকে যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। ইরান আর তুরানের মধ্যে। ইতোমধ্যে সোহরাব তুরানের সেরা যোদ্ধা হয়ে উঠেছেন। রুস্তম ইরানের। মূলত খুরাসানের। দু’পক্ষ মুখোমুখি। তুরানের কেউ রাজি হলো না রুস্তমের সঙ্গে মল্লযুদ্ধে। মীর সোহরাব রাজি। পিতা-পুত্রজানে না পরস্পরের পরিচয়। সে এক প্রচ- কুস্তি! রুস্তমের বয়স হয়েছে। পেরে উঠছিলেন না তেজি সোহরাবের সঙ্গে, ওদিকে সুখ্যাতি হারানোর ভয়! আচমকা, সুনাম বাঁচাতে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ছোরা বসিয়ে দিলেন পুত্রের বুকে। আর তখনই চোখে পড়ল বাজুবন্ধনী। এ যে তারই সন্তান! কী কাহিনী! কত যে গল্প-উপন্যাস আর সিনেমা হয়েছে এ কাহিনী নিয়ে, তার ইয়ত্তা নেই।
রুস্তম সাহেবের দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে গেল পুরো গল্প। গাড়িতে উঠে কিছুক্ষণের মধ্যে জানতে চাইলাম, তার পুত্রের নাম সোহরাব নাকি? না, রুস্তমের পুত্রসন্তান নেই, তবে গল্প খুব জমল না ভাষার বৈরিতায়। রুস্তম মিয়া ইংরেজি বোঝেন না। ওদিকে মিলেনা ততক্ষণে বসনিয়ান ভাষায় বাতচিত জমিয়ে নিয়েছে রুস্তমের সঙ্গে। মিনিট দশেক পর মনে হলো- যেন অনেক বছর ধরে পরস্পরের চেনা ওরা। অনেকদিন পর দেখা হলো। ক্ষণে ক্ষণে হাসি-কৌতুক। মিলেনা মাঝে মাঝে তরজমা করে দিচ্ছিল আমার জন্য। তাতে জমছিল না। আমি বরং জাগরেব বানিয়া লুকা সড়কের দু’পাশের সৌন্দর্য দেখায় মনোযোগী হলাম।
সারায়েভো, জাগরেব আর বেলগ্রেডের যে ত্রিভুজ, তার কেন্দ্রে হলো বানিয়া লুকা। জাগরেব থেকে ১৬৭ কিলোমিটারের পথ। শীতকাল। দু’পাশের নলখাগড়ার বনে পত্রহীন বৃক্ষের সারি। ধূসর। মাঝে মাঝে দূরবর্তী গ্রাম। রুস্তম জানান, ঘণ্টা তিনেক লাগবে। মিলেনা মুহুর্মুহু প্রশ্ন করে জেনে নিচ্ছে যুদ্ধোত্তর বসনিয়ার সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতি।
ঘণ্টা দুই পরে পৌঁছাই ক্রোয়েশিয়ায়-বসনিয়া সীমান্তে। সাভা নদীর অচঞ্চল জলধারা সীমানা রচে দিয়েছে। নদীর এক তীরে স্তারা গ্রাদিস্কা সীমান্ত চৌকি, অন্যদিকে গ্রাদিস্কা। গাড়িতে বসেই পাসপোর্ট দেখাতে হয়, একটু দেখে মুহূর্তেই সিল। ইউরোপে রেসিডেন্স কার্ড থাকায় আমারও ভিসা লাগবে না, জানতাম। মিলেনার সার্বিয়ান পাসপোর্টে এমনিও লাগে না।
অভিবাসনকর্তা আমার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকায়। ভাবখানা এই, বাংলাদেশের এই ছোকরা মধ্য ইউরোপের সীমান্তে করছেটা কী? অনেক প্রশ্ন করছিল রুস্তম আর মিলেনাকে। সবক’টিই আমাকে নিয়ে। কী কাজ করি, কোথায় থাকি, ব্রাসেলসে কতদিন ইত্যাদি। বাংলাদেশের একজন মধ্য ইউরোপে এসে বাণিজ্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেবে, জবাবটা ঠিক জুতসই মনে হচ্ছে না তার কাছে। ততক্ষণে গাড়ির লম্বা লাইন। মিনিট দশেক লাগল অনুমতি পেতে। সাভা নদী পেরিয়ে যাচ্ছি বসনিয়ার সীমান্ত চৌকিতে, গ্রাদিস্কায়। রুস্তম মজা করে বলল, এবার যদি এত সময় লাগে, তোমাকে রেখেই চলে যাব আমরা। বললাম, তাতে আমার আপত্তি নেই। সাভা নদীর সবুজাভ জলে তাকিয়ে আর কোকিলের গান শুনে কাটিয়ে দেব বাকি জীবন।
বানিয়ে লুকা পৌঁছাতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। রুস্তম শহরের কয়েকটি রেস্তোরাঁ আর আইটিএ দফতর চিনিয়ে দিয়ে বিদায় নেয়। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে ততক্ষণে। এটিএম থেকে কিছু স্থানীয় মুদ্রা তুলে নিয়ে পাশের এক রেস্তোরাঁয় হানা দেই। মিলেনা জানিয়ে দিল, বসনিয়ার মুসলিম প্রধান হলেও বানিয়া লুকা নয়। হালাল কিছু অর্ডার করতে চাইলে ওয়েটারকে ডেকে জেনে নাও।
দু’জনেই চেভাপি অর্ডার করলাম। বিফ আর ল্যাম্ব কাবাবের মতো। আসলে সসেজের টুকরো। সঙ্গে বসনিয়ান রুটি, স্বাদে একটু মিষ্টি। সঙ্গে পেঁয়াজ, পনির আর কাইমাক। কাইমাক হলো গরু, মহিষ বা ছাগলের দুধের বিশেষ ক্ষীর। অনেক সময় ধরে অল্প আঁচে দুধ জ্বাল দিতে হবে। কয়েক ঘণ্টা বা কয়েক দিনের জন্য। এভাবেই তৈরি হয় পুরু স্তরের বিশেষ ক্ষীর কাইমাক। দুগ্ধজাত স্নেহ যেখানে শতকরা ৬০ ভাগ। খাদ্যগুণে আর স্বাদে অতুলনীয়। প্রচন্ড ক্ষুধা, সামনে সুস্বাদু খাবার। গোগ্রাসে গিললাম।
আমাদের হোটেল সিটি সেন্টারেই। স্প্রসকা সড়কে। বানিয়া লুকা হলো স্প্রসকা প্রজাতন্ত্রের রাজধানী। ডেটন চুক্তির মাধ্যমে বসনিয়া-হারজেগোভিনা ফেডারেশন এবং স্প্রসকা প্রজাতন্ত্রকে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় বসনিয়া-হারজেগোভিনা রাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং উচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি দু’অংশ থেকে নির্বাচিত হন পালাক্রমে।
কীভাবে বসনিয়া রাষ্ট্র হলো? এ গল্প লিখে ছোট করা কঠিন। শুধু এটুকুই বলি। ১৯৯১ সালে ক্রোয়েশিয়া আর স্লোভেনিয়া যুগোস্লাভ প্রজাতন্ত্র থেকে বেরিয়ে যেতেই বসনিয়াও অস্থির হয়ে ওঠে। সার্বরা যুগোস্লাভিয়ার সঙ্গে থেকে যেতে চাইলেও বসনিয়া আর ক্রোয়াটরা চাইল স্বাধীনতা। আসলে নব্বই থেকে ছিয়ানব্বই পর্যন্ত সাত বছর ক’বার যে সাবেক যুগোস্লাভিয়ার মানচিত্র বদলেছে, তার ইয়াত্তা নেই। একানব্বইয়ে স্বাধীনতা ঘোষণার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় যুদ্ধ। সার্ব নেতা স্লোবোদান মিলোসেভিচের উস্কানি আর বসনিয়ান সার্ব নেতা রাদোভান কারাদজিচের নেতৃত্বে যুগোস্লাভ সেনাবাহিনী দখল নিতে চাইল। পরপরই বসনিয়ার পূর্বাভাসে এবং স্প্রসকা প্রজাতন্ত্রে শুরু হয়ে যায় গণহত্যা। বানিয়া লুকার পথে হাঁটতে হাঁটতে দেখেছি এখনো অসংখ্য ধ্বংসাবশেষ। বোমা-গুলির দাগ এখানে-ওখানে।
আসলে ট্রাভেলগে প্রকৃতি, সমাজ, সংস্কৃতি, আচার, খাদ্যাভ্যাস এগুলো নিয়ে গল্প করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কী করি? বসনিয়ার যেদিক পানে চোখ যায়, শুধুই যুদ্ধের চিহ্ন। তার চেয়ে বরং বানিয়া লুকার গল্পই বলি। ভরবাস নদীর তীরে ছোট্ট শহরে। লাখ দেড়েক মানুষের বাস। বান নামে মধ্যযুগে হয়তো কেউকেটা কেউ ছিলেন। আর লুকা হলো উপত্যকা বা বন্দর। এভাবেই এসেছে নাম, যদিও কেউ নিশ্চিত করতে পারল না।
হোটেল থেকে গুণে গুণে বিশ কদম পেরোলেই বানিয়া লুকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থাপত্য- ‘রক্ষাকর্তা’ খ্রিস্টের গির্জা। অপূর্ব নির্মাণশৈলী। ১৯৯৩ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত সময় লেগেছে নির্মাণ শেষ হতে। সার্ডিনিয়া থেকে গ্রানাইট পাথর এনে বসানো হয়েছে ছ’টি বৃহৎ আর চারটি ছোট স্তম্ভে। মাঝে স্বর্ণালি গম্বুজ। সূর্যের আলো পড়ে রীতিমতো চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছিল। দেয়ালের তিন স্তরে মধ্যপ্রাচ্যের লাল-হলুদ ট্রাভার্টিন পাথর। রুশ প্রযুক্তিতে তৈরি মন্দিরের ধাতব অংশে নাকি কখনই মরিচা পড়ার কথা নয়। ঠিক এই জায়গাতেই হামলায় পুরোপুরি মাটিতে মিশে যায় আগেকার স্থাপনা।
মানচিত্র ধরে ধরে ভরবাস নদীর দিকে এগোচ্ছিলাম। ততক্ষণে সাঁজের আলো জ¦লতে শুরু করেছে। বাঁ পাশের মসজিদ থেকে সুরেলা ধ্বনিতে বেজে ওঠে আজান। এটিই তাহলে বিখ্যাত ফারহাত পাশা মসজিদ। বসনিয়ার প্রথম বেইলারবে ছিলেন ফারহাত পাশা সকলোভিচ। তার নির্মিত মসজিদ তো পাঁচশ’ বছরের পুরনো হওয়ার কথা। নামাজ শেষে এসব নিয়ে কথা হচ্ছিল এক মুসল্লির সঙ্গে। তিনিই জানালেন, বসনিয়া যুদ্ধের সময় যে ১৬টি মসজিদ ভেঙে দেয়া হয়েছিল, এটিও তার অন্যতম। ২০০১ সালে শুরু হয় পুনর্নির্মাণের কাজ। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের দিনে প্রায় হাজার খানেক সার্ব হামলা করে বসে অনুষ্ঠানস্থলে, যেখানে ছিল শ’তিনেক বসনিয়ান, সঙ্গে যুক্তরাজ্য, সুইডেন ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত। ইটপাটকেল নিক্ষেপ, গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, এমনকি একটি শূকর ছেড়ে দেয়া হয় ইসলাম ধর্মবোধে আঘাত করতে। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিলেও একজন মারা যান, আহত হন অনেকেই।
বসনিয়ার অধিকাংশ স্থাপনার মতোই এ মসজিদও বেশ উঁচু। ব্যাপ্তিতে মাত্র ৬০ ফুট হলেও ৪৬ ফুট উঁচুতে সিলিং। প্রধান গম্বুজটিও ৬০ ফুট উঁচু, মিনার ১৪১ ফুট। পরে যোগ করা হয় সাহাত কুলা, মানে ক্লক টাওয়ার। কিংবদন্তি আছে, ১৫৭৯ সালে যখন নির্মাণকাজ শেষ হয়, ফারহাত পাশা বন্দি করেন স্থাপত্যবিদকে। পরে নাকি মৃত্যুদ-ও দেয়া হয়, যাতে এত সুন্দর স্থাপনা আর তৈরি করতে না পারেন।
পরদিন সকালে দাফতরিক কাজ। প্রশিক্ষণ প্রদান। ভাষা একই হওয়ায় মিলেনা সহজেই মিলে গেল ওদের সঙ্গে। সার্বিয়ার, ক্রোয়েশিয়া, মন্টেনিগ্রো, বসনিয়া আর কসোভোতে ভিন্ন ভিন্ন ভাষা থাকলেও ভাবের আদান-প্রদানে অসুবিধা হয় না। শুধু কথনরীতি একটু ভিন্ন। সার্বো-ক্রোয়েশিয়ান ভাষায় সঙ্গে আরবি, অটোমান তুর্কি আর ফরাসি শব্দের বহুল ব্যবহার বসনিয়ান ভাষাকে ভিন্নতা দিয়েছে। মিলেনা একটু টেনে সুরেলা ভাষায় বললেও স্থানীয়দের ভাষা তুলনায় রুক্ষতর। সে অর্থে পুরো আয়োজনে আমি একাই ভিনদেশী। সেজন্য অবশ্য দোভাষীও ছিল একজন।
দুপুরে পাশেরই এক রেস্তোরাঁয় নিয়ে গেল জাইকা। ও এই প্রশিক্ষণ আয়োজনের ফোকাল পয়েন্ট। মধ্য চল্লিশেক বয়স। মিলেনার সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব জমে উঠতে সময় লাগল না। মূলত সার্ব ভাষায়, মাঝে মাঝে আমার সামনে ইংরেজিতে চলল আলাপচারিতা। দু’জনের অনেক মিল ওদের। সঙ্গত কারণে ডিভোর্সড। মিলেনা পুত্রকন্যাকে নিয়ে ব্রাসেলসে আর জাইকা এক পুত্র নিয়ে বানিয়া লুকায়। মিলেনা বলে, ডিভোর্সের ওই সিদ্ধান্ত ছিল তার জীবনের সেরা। জাইকা আরো এককাঠি সরেস। ও নাকি আগে থেকেই জানত, সংসার হবে না। তার সাবেক পতি ছিল রকস্টার। অনেকটা ভবঘুরে জীবনযাপন। ও ভয়ে আছে ছেলের ওপর না বাপের ছায়া পড়ে। ওদের এই ইন্টারেস্টিং আলাপে খুব বেশি রসদ জোগাতে পারলাম না। শুধু মিলেনাই বলল, আমার দুই কন্যাকে দেখতে নাকি পরীর মতো! ফেসবুকে দেখেছে।
বিকেলে বেশ সময় পাওয়া গেল। মিলেনার এক কাজিন থাকে এখানে, ডেন্টিস্ট। ওকে নিতে আসবে ডিনারের জন্য। আমাকেও যেতে বলল। কিন্তু আমি আগ্রহ দেখালাম না। তারচেয়ে শহর ঘুরে দেখাই উত্তম মনে হলো।
‘ভদ্রলোকের’ স্ট্রিট ধরে হাঁটতে থাকি। এমন নাম কেন হলো, কেউ নিশ্চিত করতে পারেনি। নামের জন্যই কিনা জানি না, জায়গাটা পর্যটকদের ভীষণ প্রিয়। পেডিস্ট্রিয়ান স্ট্রিট। দু’পাশে সারিবদ্ধ নিও-রেনেসাঁ যুগের এক বা দ্বিতল বিপণি।
ম্যাপ ধরে ধরেই পৌঁছে যাই কাস্টেল দুর্গে। ভরবাস নদীর তীরে। এই দুর্গ আর নদীর যুগলবন্দি শোভা বাড়িয়েছে এ নগরের। ভরবাস নদীর তীর ধরে দুর্গের পুরু দেয়াল কালের সাক্ষী হয়ে দন্ডায়মান। এসব দেয়াল যেন নদীকে গল্প শোনাচ্ছে যুদ্ধের, বাণিজ্যের, বিজয়ের, অপমানের, কষ্টের, বিরহের কিংবা ভালোবাসার।
কাস্টেল দুর্গের ইতিহাস রহস্যঘেরা। কারো মতে, রোমানরাই নির্মাণ করেছে এ দুর্গ। কিন্তু দেয়ালের গায়ে ব্যবহৃত পাথর আর প্রযুক্তি বলে দেয়, এসব দেয়াল আরো পুরনো। তম্র যুগের বা হয়তো আরো আগের, প্রস্তর যুগের। একপ্রান্ত দিয়ে প্রাচীরের ওপরে উঠে এলাম। হেঁটে নদীর তীর বরাবর এসে দেয়ালের ওপরের অংশে হেলান দিয়ে বসেছি। ‘ভরবা’ মানে হলো উইলো। নদীর দিকে ঝুঁকে থাকা ক্রন্দনরত উইলোবৃক্ষের নামেই কেউ নাম রেখেছে নদীর। স্বচ্ছ সবুজ পানি। স্রোত আছে, তেমন তীব্র নয়।
নদীটি বয়ে গেছে শহরের মাঝ বরাবর। নদীর অপর তীরে গড়ে উঠেছে নতুন শহর। ওদিকটা আবাসিক। কয়েকটি রেস্তোরাঁ দেখা যাচ্ছে।
ঘণ্টাখানেক ওখানে কাটিয়ে দুর্গের মধ্যাঞ্চলে ফিরে আসি। মনে প্রশ্ন জাগে, তুর্কিরা পঞ্চদশ শতকে যখন এ নগর দখল করেছিল, এই দুর্গকে কী কাজে লাগিয়েছিল?
বিশাল দুর্গ। মূল দরবার হল যেখানে ছিল, তা এখন খেলার মাঠ। মনের আনন্দে দৌড়াচ্ছিল কিশোরের দল।
দুর্গের চারপাশ ঘুরে ঘুরে সারা লাজারা সড়কে উঠে এলাম। ভরবাস নদীর ওপর সেতু। পথে সাঁজের ব্যস্ততা। পশ্চিমাকাশে সূর্যি মামার বাড়ি ফেরার অলস আয়োজন। আলো কমে আসছে। জীবনের আলোও নিভে আসে একসময়। ফিরে যেতে হয়। তবু এটুকু জীবনে এত যুদ্ধ! এত রাজ্য জয়! এত ধ্বংস! এত হাহাকার!
এমনই অর্থহীন এ মানবজন্ম? আলো ফুরালেই শেষ!
লেখক : ওয়ার্ল্ড কাস্টমস অর্গানাইজেশনে কর্মরত
ছবি : লেখক
Comments