রবীন্দ্র ভুবনে পতিসর

পতিসর ০ কিলোমিটার

 মাঠ-ঘাট পেরিয়ে ট্রেনখানা যখন আত্রাই স্টেশনে এসে থামল, তখন হাতঘড়িতে সকাল ৯টা। স্টেশনের একটি চায়ের দোকানে বসে চায়ে চুমুক দিতে দিতেই তৈরী করে নিলাম পতিসরে যাওয়ার ছক। স্টেশনটি বেশ পুরনো ও ছিমছাম; এর কাগুজে নাম আহসানগঞ্জ। তবে সবাই একে আত্রাই বলেই চেনেন। ইতিহাসখ্যাত আত্রাই নদীর কারণে এই নামকরণ। রবীন্দ্রনাথ ট্রেনে করে কলকাতা থেকে সরাসরি এখানে এসে নামতেন। এরপর তিনি তার বিখ্যাত ‘পদ্মা বোট’-এ করে নদীপথে সোজা চলে যেতেন পতিসরের কাছারিবাড়িতে। কখনো কখনো পালকি ব্যবহার করতেন। কিন্তু আমাদের না আছে নৌকা আর না আছে পালকি। তাই সময় বাঁচানোর জন্য দ্রুতযান সিএনজি অটোরিকশাই বেছে নিতে হলো। ভ্যানেও যাওয়া যায় কিলো পনের দূরের পতিসর কাছারিবাড়িতে, তবে সময় লাগে অনেকটা। এক সিএনজি অটোরিকশায় পাঁচজনের বসার ব্যবস্থা। ভাড়া জনপ্রতি ২৫ টাকা। সময়ক্ষেপণ না করে দু’জনে একটা সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া করে সোজা রওনা হলাম পতিসরের উদ্দেশে। 

রেললাইন পার হয়ে সরু পিচঢালা রাস্তা ধরে এঁকে-বেঁকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। দু’পাশে পরিত্যক্ত ফসলের মাঠ আর মাঠ। শস্যহীন, শ্রীহীন এ মাঠের ফসলের প্রাচুর্যের চিত্রকল্প অনুভব করে রবীন্দ্রসংগীতে ডুব দেয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বৃথা আয়োজন,  রাস্তার উঁচু-নিচু খানাখন্দে হেডফোনে গান শোনার সব আয়োজন ব্যর্থ হলো। ফসলের দেখা না পেলেও দেখা পেলাম তরুণী জলস্রোতের। নদীর ঘোলা জলের বানে ভেসে গেছে ধানকাটা মাঠগুলো। জলধারার সরব উপস্থিতি রাস্তার দু’ধারের নালাতেও। এখানকার লোকালয়গুলো বেশ দূরে-দূরে এবং গাছ-গাছালিও বেশ কম। রাস্তায় লোকজনের উপস্থিতিও কম দেখা গেল। সমস্ত পথে মাঝারি গোছের মাত্র দু’তিনটে মোড়ের দেখা মিলল। আমরা যে সড়ক ধরে এগোচ্ছি তা নওগাঁ জেলা পরিষদের রাস্তা। আগে এখানকার লোকদের জেলা-উপজেলার সঙ্গে চলাচলের এই রাস্তাটির অবস্থা সঙ্গীন ছিল। রবীন্দ্রনাথের কল্যাণে মোটামুটি চলাচল উপযোগী মূল সড়ক থেকে এরপর আমরা ডানের সরু সর্পিল রাস্তা ধরে এগোতে থাকি; আর সঙ্গে সঙ্গে সম্পূর্ণ বদলে যেতে থাকে প্রাকৃতিক দৃশ্যপট। রাস্তার দু’ধারে তালগাছের সারি, রোপণ করেছে বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। এসব দেখতে দেখতে মিনিট বিশেকের মধ্যে পৌঁছে যাই রবীন্দ্র-স্মৃতিধন্য পতিসরে।

সিএনজি অটোরিকশা থেকে নামতেই চোখ আটকে গেল শুভ্র রঙের বাড়িটি দেখে। সিংহদরজার ওপরের সিংহ দুটি যেন আমাদেরই সম্ভাষণ করছে। দরজার দু’পাশে আছে মার্বেল পাথরে খোদিত পতিসরে সৃষ্ট রবীন্দ্র রচনার বয়ান। পড়ে নিলাম সেসব। প্রবেশদ্বার বন্ধ, রবিবার সাপ্তাহিক বন্ধ। ভেতরে যাওয়ার জন্য মন আকুপাকু করতে লাগল। আমাদের মনে দেখা দিল কালো মেঘ। এত দূরে এসে কাছারিবাড়িটির ভেতরটা না দেখে ফিরে যেতে মন চাইছিল না। তাই ভিন্ন পথে এগোতে লাগলাম। আশপাশে খোঁজ করতেই পেয়ে গেলাম কেয়ারটেকারকে। আমাদের দূর থেকে আসার কথা শুনে দোটানায় পড়ে গেলেন। দয়াপরবশ হয়ে খুলে দিলেন বন্ধ দ্বার। সঙ্গে করে বন্ধ ঘরগুলো খুলে ঘুরে ঘুরে দেখালেন। রবীন্দ্রনাথের চেনা-অচেনা বিভিন্ন ছবি দিয়ে তিনটি ঘর সুন্দর করে সাজানো। রবীন্দ্রনাথের অন্য দুটি কুটিবাড়ি শিলাইদহ ও সাহজাদপুরের থেকে এটি অনেক বেশি গোছানো। এখানে রবীন্দ্র ব্যবহৃত আরাম কেদারা, লোহার সিন্দুক, গ্লোব, বাথটাব, বিভিন্ন চিঠিপত্রের অনুলিপি, পদ্মাবোটের নোঙর, জানালার কাচ প্রভৃতি বিভিন্ন বস্তু-সামগ্রী পরম যত্নে সংরক্ষিত আছে। সবচেয়ে বিস্মিত হলাম কলের-লাঙলের ফলা দেখে। জানা ছিল, পুত্র রথীন্দ্রনাথকে কৃষিবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষার্থে আমেরিকায় পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রথীন্দ্রনাথ দেশে ফিরে মন দিয়েছিলেন আধুনিক কৃষিকাজে। কৃষি ও কৃষকের সনাতনী চিন্তায় প্রচ- আঘাত হেনেছিল তা। এসব কারণে পতিসর তথা কালীগ্রাম পরগনার কৃষকরা অপরিসীম শ্রদ্ধা ও সম্মান করতেন রবীন্দ্রনাথ-রথীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথ এখানকার কৃষকদের মনে-প্রাণে ভালোবাসতেন। তিনি নোবেল পুরস্কারের অধিকাংশ টাকা এখানকার কৃষকদের মাঝে কৃষিঋণ হিসেবে দিয়েছিলেন। যদিও তিনি তা আর ফিরে পাননি। এ বিষয়ে অবশ্য তার কোনো দুঃখ ছিল না। বাংলাদেশের কৃষকদের মান উন্নয়নের জন্য তিনি সবসময় ভাবতেন। জাদুঘর দেখতে দেখতে রবীন্দ্রনাথের কৃষিভাবনার কথাই বেশি করে মনে পড়ল।

কাছারিবাড়িটি চতুর্ভুজাকৃতি। মাঝে স্বল্প পরিসরের খোলা লন আছে। এর তিনদিকে ঘিরে ঘরগুলো অবস্থিত। মাঝের লনে বই হাতে দাঁড়ানো রবীন্দ্রনাথের একটি ভাস্কর্য আছে। মনে হলো রবীন্দ্রনাথ মাথা উঁচু করে যেন দাঁড়িয়ে আছেন এবং আমাদের অভয়বাণী দিচ্ছেন। জাদুঘর দেখা শেষ করে সামনের পুকুরের শান বাঁধানো ঘাটে এসে বসলাম। বসার জায়গাটা  চমৎকার। এখানকার বই-হাতে আরাম কেদারায় বসা অপর রবীন্দ্র ভাস্কর্যটি দেখে মন জুড়িয়ে গেল। ভাস্কর শিল্পী কনক কুমার পাঠকের শিল্পবোধ মন ছুঁয়ে যায়। বিশ্রাম নিচ্ছি এমন সময় পরিচয় হলো রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ স্থানীয় অধিবাসী মো. খলিলুর রহমানের সঙ্গে। অবাক হলাম রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারে তার অনুসন্ধিৎসুতা জেনে। তিনি আমাদের পতিসরে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি ও এখানকার মানুষদের প্রতি তার মনোভাবের কথা বললেন। এরপর তিনি নিয়ে গেলেন আহমদ রফিক গ্রন্থাগারটি দেখাতে। স্থানীয় কয়েকজন রবীন্দ্রপ্রেমিক মিলে বছর পাঁচেক ধরে গড়ে তুলেছেন লাইব্রেরিটি। অজপাড়াগাঁয়ে এ ধরনের লাইব্রেরির কথা ভাবাই যায় না। প্রচুর সংগ্রহ, অধিকাংশই রবীন্দ্র বিষয়ক। বইয়ের প্রাচুর্য থাকলেও পাঠকের স্বল্পতার কথা বললেন। এ অবস্থা দেশের কোথায় নেই! যাক সেসব। এরপর আমরা গেলাম শতবর্ষ পুরনো রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউশন দেখতে। এর স্থাপত্যশৈলী যে কারো নজর কাড়বে। প্রথম দর্শনে আমরাও মুগ্ধ হলাম রবীন্দ্রনাথের নিজ হাতে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টি দেখে। পুরনো ঘরটির পুরোটাই টালির চমৎকার ব্যবহার করা হয়েছে, হয়ে উঠেছে দৃষ্টিনন্দন। জানা গেল, এটি প্রথম থেকেই একই রকম আছে। বিদ্যালয় দেখা শেষ করে এরপর আমরা গেলাম নাগর নদের তীরে গড়ে ওঠা পতিসর বাজারে। বাজারটি বেশ ছোট, অল্প কয়েকটি মনিহারীর দোকান আছে। দুপুর গড়িয়ে যেতে বসেছে। খাবার হোটেল খুঁজতেই পেয়ে গেলাম মাস দুয়েক পার হতে চলা একটি নামহীন হোটেলের। নাগর নদের টাটকা মিশেল মাছ, মসুরি ডাল দিয়ে যেই খাবার সারছি অমনি মাথায় একটা নতুন বুদ্ধি খেলে গেল। এই নাগর নদ ধরেই তো রবীন্দ্রনাথ তার অতি প্রিয় পদ্মা বোটে করে ভ্রমণ করেছেন। আমরাও তো তা করতে পারি। নাগর-আত্রাই-করতোয়া-গড়াই-পদ্মার স্মৃতিকথা ‘ছিন্নপত্রে’র পাতায় পাতায় যে বর্ণনা আছে তা রবীন্দ্রপ্রেমিকদের মনে সবসময়ই দোলা দেয়। আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে... খ্যাত নাগরের কথা তিনি যে কতবার তার রচনায় উল্লেখ করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। যেই ভাবনা অমনি তার বাস্তবায়ন। খলিলুর ভাই নাগরে নৌ-ভ্রমণের যাবতীয় ব্যবস্থা করে দিলেন। বেশ বড়সর একটা নৌকা ভাড়া করে আমরা বেলা ৩টার দিকে রওনা হলাম নাটোরের সিংড়ার উদ্দেশে। ইচ্ছে ছিল রবীন্দ্রনাথ যে পথে শাহজাদপুর অথবা শিলাইদহের কুঠিবাড়ীতে নৌকায় যেতেন, সেই পথ ধরে এগোনো। কিন্তু হাতে সময় ও প্রস্তুতি না থাকায় আমাদেরকে থামতে হবে আত্রাইয়ের মিলনস্থল সিংড়াতে গিয়ে। মাঝি জানাল ঘণ্টা দুয়েক লাগবে সিংড়া পৌঁছাতে। আমরা নৌকার গলুইয়ের সামনে বসে পড়লাম। শুরুতেই বিপত্তি! কচুরিপানায় নৌকার প্রপেলার আটকে গেছে। অল্প সময়ের মধ্যে কচুরির বাঁধন মুক্ত হয়ে আমাদের ইঞ্জিনচালিত শকটটি যখন এগিয়ে চলল, তখন আমাদের আর পায় কে? শরতের শুভ্র-নীল আকাশ আর নদীর অপার সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে আমরা এগিয়ে চললাম। এগোনো আর কাকে বলে! সাপের মতো এঁকে-বেঁকে চলা। এ রকম বাঁকের নদী বাংলাদেশে আর একটাও আছে বলে আমার জানা নেই। অসম্ভব সুন্দর নদীর দু’ধারে প্রাকৃতিক দৃশ্যের। চঞ্চল কিশোরদের লাগামহীন লুটোপুটি, গ্রাম্যবধূর নদী থেকে জল নেয়া, ছোট গরুর বাঁধের সবুজ ঘাস খোঁজা-এসব দৃশ্যকল্প থেকে চোখ ফেরানো দায়। শান্ত-স্নিগ্ধ অপরূপ মায়াময় নাগর কখন যে চলনবিলের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গেছে তা টের পেলাম না। একসময় নদীকে আলাদা করে চেনার আর উপায় থাকল না। মনে হলো আমরা যেন সমুদ্রে এসে পড়েছি। এরই মাঝে শুরু হলো বৃষ্টি, শরতের দুষ্টামি আর কী! এ যেন মেঘ না চাইতে বৃষ্টি! এই মেঘ এই বৃষ্টি এভাবেই খানিকক্ষণ চলল শ্রাবণের রহস্যময়তা। আমরাও উপভোগ করলাম। মন-প্রাণ উজাড় করে উপভোগ করলাম নাগরের সৌন্দর্যের সবটুকুু আর মনে বারংবার হানা দিল বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ গীতি-কারিগর আমাদের প্রাণের রবীন্দ্রনাথ।

কীভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন

ঢাকা থেকে আত্রাই যাওয়ার জন্য ট্রেনই উপযুক্ত। লালমনি, দ্রুতযানসহ রংপুর-দিনাজপুরগামী যেকোনো আন্তঃনগর ট্রেনে আত্রাই স্টেশনে নেমে সেখান থেকে সিএনজি অটোরিকশা, ভ্যানে সহজেই যাওয়া যায় পতিসরে। এছাড়া ঢাকা থেকে নওগাঁয় সরাসরি বাসে গিয়ে সেখান থেকে সিএনজি অটোরিকশা রিজার্ভ করেও যাওয়া যায় পতিসরে। পতিসরে রাত্রিযাপনের জন্য কোনো হোটেল নেই, সরকারি একটি ডাকবাংলো আছে। পূর্ব অনুমতি থাকলে এখানে রাত্রীযাপন করা যায়। আর তা না হলে নওগাঁ শহরের যে কোনো আবাসিক হোটেলে থাকতে হবে।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

ছবি : লেখক 

Comments

The Daily Star  | English

The story of Gaza genocide survivor in Bangladesh

In this exclusive interview with The Daily Star, Kamel provides a painful firsthand account of 170 days of carnage.

1d ago