আনন্দধারা

মুগ্ধতার বেঙ্গল সংস্কৃতি উৎসব

সাড়ে ৫ বছরের ছোট্ট শিশু মহাশ্বেতা দেব শশী। বাবা নাট্যকর্মী সুপ্রিয় দেব শান্ত ও মা গায়ত্রী ধরের হাত ধরে ছোটবেলা থেকেই সিলেটের সংস্কৃতি অঙ্গণে তার বিচরণ। ইতোমধ্যেই সে দেখেছে অসংখ্য মঞ্চনাটক, শুনেছে অসংখ্য গুণী শিল্পীর গান।
Sylhet
গত ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে সিলেটের আবুল মাল আবদুল মুহিত ক্রীড়া কমপ্লেক্স-এ শুরু হয়েছে ‘মানবিক সাধনায় বেঙ্গল সংস্কৃতি উৎসব সিলেট ২০১৭’; ছবি: সংগৃহীত

সাড়ে ৫ বছরের ছোট্ট শিশু মহাশ্বেতা দেব শশী। বাবা নাট্যকর্মী সুপ্রিয় দেব শান্ত ও মা গায়ত্রী ধরের হাত ধরে ছোটবেলা থেকেই সিলেটের সংস্কৃতি অঙ্গণে তার বিচরণ। ইতোমধ্যেই সে দেখেছে অসংখ্য মঞ্চনাটক, শুনেছে অসংখ্য গুণী শিল্পীর গান।

তবে সিলেটে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের ১০ দিনব্যাপী বেঙ্গল সংস্কৃতি উৎসবে এসে শশী যেমন মুগ্ধ, তেমনি মুগ্ধ তার বাবা-মা’ও।

“আমার মেয়ে তো নয়ই, আমি নিজেও কোনদিন বায়োস্কোপ দেখিনি। এ উৎসবে বাবা মেয়ে মিলে জীবনের প্রথমবারের মতো বায়োস্কোপ দেখলাম।”

শুধু বায়োস্কোপ না, দশদিনের এ আয়োজনে প্রতিদিন অসংখ্য গুণী শিল্পী, সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পীর সান্নিধ্য যেমন ‍মুগ্ধ করছে শশীকে, তেমনি কারুমেলাসহ অন্যান্য আয়োজনও মাতিয়ে রাখছে তাকে। আর তাই, প্রতিদিন বিকেল হতেই বাবা-মায়ের সঙ্গে শশী চলে আসে বেঙ্গল সংস্কৃতি উৎসবে।

কেবল শশী বা তার বাবা-মা নয়; প্রতিদিনই এমন হাজারো মানুষ স্বপরিবারে আসছেন উৎসব প্রাঙ্গণে, মিশে যাচ্ছেন গানের সুরে, নাচের ছন্দে, চিত্রকলার রঙে কিংবা সাহিত্যের সম্মিলনে।

গত ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে সিলেটের আবুল মাল আবদুল মুহিত ক্রীড়া কমপ্লেক্স-এ শুরু হয়েছে ‘মানবিক সাধনায় বেঙ্গল সংস্কৃতি উৎসব সিলেট ২০১৭’। আর এ উৎসবটি উৎসর্গিত হয়েছে জ্ঞানতাপস অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের স্মরণে।

বাঙালি সাহিত্য-সংস্কৃতির হাজার বছরের ইতিহাস, সমসাময়িক প্রেক্ষাপট ও পরিবর্তিত জীবনধারার নানান দিকই উপস্থাপিত হচ্ছে বেঙ্গলের এ উৎসবে।

যদি প্রশ্ন করা হয়, কী আছে এ সংস্কৃতি উৎসবে; তবে যেন ভুলই হবে। বরং প্রশ্ন করা উচিত, কী নেই এ উৎসবে। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সকল দ্বারই এসে উন্মুক্ত হয়েছে সিলেটের এ উৎসবে। আর কেবলমাত্র বাংলাদেশের নয়, ভারত ও নেপালও যেন এক হয়েছে এ উৎসবের প্রাঙ্গণে।

প্রবেশদ্বার পার হলেই বাঁদিকে চোখে পড়বে আয়োজনের মূল অংশ ‘হাছন রাজা মঞ্চ’, যার নামকরণ করা হয়েছে সিলেটের গুণী মরমী কবি হাছন রাজার নামে।

মূল মঞ্চের বাঁ দিকে ‘রাধারমণ দত্ত বেদী’তে বসেছে ‘সুবীর চৌধুরী আর্ট ক্যাম্প’। বাংলাদেশ ও ভারতের চিত্রশিল্পীরা এই আর্ট ক্যাম্পে এসে কথা বলছেন, ছবি আঁকছেন। এখানে রয়েছেন বিশিষ্ট চিত্রকর রফিকুন নবী, মনরিুল ইসলাম, শহিদ কবির, রোকেয়া সুলতানা, জামাল আহমেদ, শিশির ভট্টাচার্য্য, তৈয়বা লিপিসহ ২৭ জন শিল্পী।

আরেকটু সামনে এগিয়ে আসলে ডানদিকে রয়েছে বাউল শাহ আবদুল করিম চত্ত্বর। এখানে চলছে বাদ্যযন্ত্রের প্রদর্শনী। বৈশিষ্ঠ্য বিচারে আলাদা আলাদা ছোট গ্যালারিতে প্রদর্শিত হচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশসহ বিশ্বের নানা দেশের বাদ্যযন্ত্র।

এর পাশেই স্ট্যান্ডে চিত্র ও তথ্য প্রদর্শিত হচ্ছে, যাতে উঠে এসেছে বৃহত্তর সিলেটের বিলুপ্ত ও বিপন্ন লোকগান সংক্রান্ত তথ্য। যদিও খুব বিস্তারিত বর্ণনা নেই এখানে, তবে লুপ্তপ্রায় সংস্কৃতি সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ জাগানোর জন্য যথেষ্ট।

এর পাশেই রয়েছে কারুমেলা। এ অংশটির নামকরণ করা হয়েছে সিলেটের গুণী ও ব্রতচারী আন্দোলনের প্রবক্তা গুরুসদয় দত্ত চৌধুরীর নামে। বিভিন্ন ছোট ছোট কটেজে ভাগ হয়ে সিলেট, রাজশাহী, কুমিল্লা, টাঙ্গাইলসহ দেশের বিভিন্ন অংশের ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্পের প্রদর্শনী চলছে। কেবল প্রদর্শনীই নয়, বরং বলা যায় কীভাবে শিল্পীরা নির্মাণ করেন বাংলার এ সকল অনবদ্য কারুকাজ, তাও দেখতে পাচ্ছেন সবাই।

তাঁত বা খাদি, মাটির তৈজস কিংবা কাঠের খেলনা, শাঁখা চুড়ি অথবা পাটের কারু – এসবই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত এসে যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে সিলেটের একটি মাঠের এই অংশটিতে।

এছাড়াও, এ উৎসবের অন্যতম আয়োজন হিসেবে রয়েছে সাহিত্য সম্মেলন, চলচ্চিত্র ও মঞ্চনাট্য প্রদর্শনী। আর এ সবই চলছে সিলেটের খ্যাতিমান রম্য লেখকের স্মরণে সৈয়দ মুজতবা আলী মঞ্চে।

উৎসবের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম দিন সকাল থেকেই এ মঞ্চে বসেছিল সাহিত্যের সম্মিলন যাতে একত্রিত হয়েছিলেন বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের কবি-সাহিত্যিক ও সাহিত্য গবেষকরা।

এছাড়াও, প্রায় প্রতিদিনই রয়েছে বিভিন্ন চলচ্চিত্র প্রদর্শনী এবং উৎসবে খ্যাতনামা নাট্যদলের পরিবেশনায় মোট ৪টি মঞ্চনাটকও প্রদর্শিত হচ্ছে।

উৎসবের মূল মঞ্চে গান পরিবেশন করে দর্শক মাতিয়েছেন সুবীর নন্দী, চন্দনা মজুমদার, খায়রুল আনাম শাকিল, অদিতি মহসিন, শতাব্দী রায়, মনোময় ভট্টাচার্য, ইফফাত আরা দেওয়ান, লাবিব কামাল গৌরব, নবনিতা চৌধুরী, বেবী দেওয়ান, কৃষ্ণকলি ও গানের দল জলের গান।

বাকি দিনগুলোতে থাকছেন একুশে পদকপ্রাপ্ত লোকসংগীতশিল্পী সুষমা দাস, ভারতের বিখ্যাত সংগীতশিল্পী হৈমন্তী শুক্লা ও শ্রীকান্ত আচার্য, জ্যোতি চক্রবর্তী ও হাল আমলের বাউলিয়ানার ক্রেজ হয়ে উঠা পার্বতী বাউল। আর শেষ দিনের আকর্ষণ হিসেবে থাকছেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও বাউল শফি মণ্ডল।

কেবলমাত্র শিল্প-সাহিত্য কিংবা কারু নয়, বেঙ্গল সংস্কৃতি উৎসবের ভিন্ন একটি আঙ্গিক যুক্ত করেছে সৈয়দ মুজতবা আলীর মঞ্চের পাশে বাঁশ ও কালো দড়ির অস্থায়ী স্থাপত্য গ্যালারি। এর মধ্যে প্রদর্শিত হচ্ছে সিলেট শহরের নানা অংশ। উৎসবের এ অংশটির নাম কুশিয়ারা কলোনেড।

যদি এ শহরটি পরিকল্পিত হতো তাহলে দেখতে কেমন হতো সে বিষয়টিও তুলে আনা হয়েছে স্থাপত্য প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে।

স্থাপত্যের প্রদর্শনীর পাশেই রাখা হয়েছে অসংখ্য কাঁচের জার। দিঘীর নগরী নামে পরিচিত এ নগরীর নানা স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দিঘী ও পুকুর থেকে সংগৃহীত পানি রাখা হয়েছে সেগুলোতে। এর মাধ্যমে দেখানো হচ্ছে আমরা কীভাবে নষ্ট করছি আমাদের পরিবেশ ও প্রতিবেশ। বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া দিঘীর নামেও রয়েছে জার, যাতে রয়েছে কেবল মাটি।

উপস্থিত দর্শকদের কাছে বেঙ্গলের এ আয়োজনটি অনবদ্য, কারণ কেবলমাত্র শিল্প-সাহিত্য-চারু-কারু নয়, যতভাবে সম্ভব, প্রায় ততভাবেই বেঙ্গল পরিবেশন করছে এই উৎসবে। ‍তাদের এই আয়োজন মুগ্ধ করছে সিলেটের সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষকে।

এছাড়াও, যখন কানের কাছে বাজতে থাকে বাংলার সুপরিচিত জারিগান ‘সামাল সামাল সামাল ওরে সামলে তরী বাইয়ো’ কিংবা ‘বোশেখেতে রঙ মাখিয়ে, কে কে আয়’, তখন সেই মুগ্ধতা মাথায় নিয়ে ঘরে ফেরা যেন সিলেটবাসীর সংস্কৃতি প্রেমেরই অন্যতম বহিঃপ্রকাশ।

Comments

The Daily Star  | English
Sakib Jamal. Photo: Crain's New York Business. Image: Tech & Startup

Bangladeshi Sakib Jamal on Forbes 30 under 30 list

Bangladeshi born Sakib Jamal has been named in Forbes' prestigious 30 Under 30 list for 2024. This annual list by Forbes is a compilation of the most influential and promising individuals under the age of 30, drawn from various sectors such as business, technology, arts, and more. This recognition follows his earlier inclusion in Crain's New York Business 20 under 20 list earlier this year.

4h ago