এক সময় ভাই আমার বাবার ভূমিকা নিল

আমার দাদু ভাই আর আমার বয়সের পার্থক্যÑ ১২ বছর। আমি যখন একটু বড় হয়েছি, তখন আমার ভাই পড়তে চলে গেছে বাইরে। সে যখন এইচএসসি পড়ে কারমাইকেল কলেজে তখনকার স্মৃতি আমার কিছু মনে নেই। এরপর সে ঢাকায় চলে যায়। ছোটবেলায় দাদু ভাইয়ের সঙ্গে স্মৃতিগুলো সব যখন সে ঢাকা থেকে বাড়িতে আসত। এমন একটা স্মৃতি মনে পড়ছে। আমার সেদিন জন্মদিন। দাদু ভাই বাড়িতে ফিরবে। ট্রেন এসে গেল কিন্তু ভাই এলো না।

আমার দাদু ভাই আর আমার বয়সের পার্থক্যÑ ১২ বছর। আমি যখন একটু বড় হয়েছি, তখন আমার ভাই পড়তে চলে গেছে বাইরে। সে যখন এইচএসসি পড়ে কারমাইকেল কলেজে তখনকার স্মৃতি আমার কিছু মনে নেই।  এরপর সে ঢাকায় চলে যায়। ছোটবেলায় দাদু ভাইয়ের সঙ্গে স্মৃতিগুলো সব যখন সে ঢাকা থেকে বাড়িতে আসত। এমন একটা স্মৃতি মনে পড়ছে। আমার সেদিন জন্মদিন। দাদু ভাই বাড়িতে ফিরবে। ট্রেন এসে গেল কিন্তু ভাই এলো না। তখন নীলফামারী পর্যন্ত একটাই ট্রেন আসত। অপেক্ষা করতে করতে আমি ঘুমিয়ে গেলাম। রাতের বেলা ঘুম ভাঙল হইচই-এর শব্দে। দাদু ভাই সৈয়দপুর থেকে নভেম্বরের শীতে  সুটকেস নিয়ে তের মাইল হেঁটে বাসায় চলে এসেছে। আমার জন্য সে একটা পাজল ব্লক নিয়ে এসেছিল। অমন উপহার আমি এর আগে কখনও দেখিনি। মফস্বলের বাচ্চারা উপহার হিসেবে তখন সাধারণত পেত পুতুল। মনে আছে, ভাই এসে পড়ায় আর উপহার পেয়ে আনন্দে আটখানা হয়ে গিয়েছিলাম।


আমাদের বাসায় সংস্কৃতির চর্চাটা ছিল। মা-বাবা দুজনেই শিক্ষক ছিলেন। বাবা আমাদের গান, কবিতা আবৃত্তি, নাটক, বিতর্কÑ এসবে উৎসাহ দিতেন। নিজেও ভালো আবৃত্তি করতেন। আরো খেয়াল রাখতেন যেন আমরা পাঠ্যবইয়ের বাইরেও আরো ভালো বই পড়ি। আমার দুই ভাই-ই কবিতা আবৃত্তি করত। ও সবসময় বন্ধু পরিবেষ্টিত থাকত। আড্ডা দিতে ভালোবাসত। দু-ভাই-ই ছাত্র ভালো ছিল। তবে প্রথাগত পড়াশোনার দিকে দাদু ভাইয়ের আগ্রহ ছিল কম। বাবা মাঝে মাঝে এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করতেন। তবে মা বলতেন দাদু ভাই খুব ‘ব্রাইট’।


দাদু ভাই খুব আনন্দপ্রিয় ছিল। তখন মফস্বলে সন্ধ্যা মানেই দেরি। যখন ঢাকা থেকে বাড়িতে আসত, তখন আড্ডা দিয়ে দেরিতে বাড়ি ফেরার কারণে বাবার কাছে ওকে বকা খেতে হতো। দাদু ভাইয়ের এতে তেমন ভ্রুক্ষেপ না থাকলেও আমার মন খারাপ লাগত। ছোট ছিলাম বলে কিছু বলতে পারতাম না। দাদু ভাইও হয়তো তখন আমার এই আবেগ ততটা বুঝতে পারত না।


স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার কথা। ৭ই মার্চের কয়েকদিন আগে আমার নানা মারা যাওয়ায় বাবা, মাসহ পরিবারের সবাই তখন ঢাকায়। দাদু ভাই তো ঢাকাতেই থাকত। সবাই বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে গিয়েছিল। বাড়ি ফেরার পর যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। ২৫ মার্চ রাতে সৈয়দপুরে গণহত্যা হয়। সৈয়দপুর থেকে যারা নীলফামারীতে পালিয়ে আসে দাদু ভাই তাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছিল। সেনাবাহিনী ঢোকে ৭ এপ্রিল। তার আগেরদিন দাদু ভাই ভারতে চলে গিয়েছিল। সেখানে সে  ট্রেনিং নিয়েছিল এবং ক্যাম্পে সাহায্য করছিল। আমরা তখন বাড়ি ছেড়ে গ্রামে এক কৃষকের বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। বাবা রাজনীতিতে জড়িত থাকায় তাঁকে ভারতে আশ্রয় নিতে হলো। দাদু ভাইয়ের খবর নেই। মা দেশ ছাড়তে রাজি হলেন না, আমাকে আর দাদাকে নিয়ে ফিরে এলেন নীলফামারীর বাসায়। মাঝে খবর পেলাম, বাবা দাদু ভাইকে খুঁজে পেয়েছেন। পরে শুনেছি, নীলফামারীতে আক্রমণ হওয়ার খবরে দাদু ভাই শিশুর মতো কেঁদেছিল।


যুদ্ধ শেষে বাবা-ভাই ফেরত এলেন। তখন উৎসবের আমেজ। কিছুদিন পর দাদু ভাই আবার ঢাকায় ফিরে যান। আমি তখন ক্লাস টেনে পড়ি। আমরা সবাই তখন ছাত্র ইউনিয়ন করতাম। ১৯৭২ সালে ঢাকায় ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলনে আমাকে যেতে দিতে বাবা রাজি হচ্ছিলেন না। পরে দাদু ভাইয়ের কথায় রাজি হয়ে গেলেন। তার ওপর বাবার অনেক বিশ্বাস ছিল। তার যে অনেক পরিচিতি বা জনপ্রিয়তা ছিল তা সেবার ঢাকায় এসে বুঝতে পারি।


’৭৪ সালে লেখাপড়ার জন্য ঢাকায় চলে আসি। ভাইকে তখন অন্য রূপে দেখলাম। সে তখন আমার বাবার ভূমিকা নিল। আমি আর দাদা তখন দাদু ভাইয়ের সঙ্গে বকশীবাজারে একটা বাসায় থাকতাম। সে আমাদের সবকিছু খেয়াল রাখত। বিশেষ করে আমাকে আগলে রাখত। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে, নাটক, ভালো চলচ্চিত্র দেখতে ভাই নিয়ে যেত আমাকে। একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে ফুল দিতে যেতাম আমরা সবাই। পহেলা বৈশাখে যেতাম রমনা বটমূলে।


দাদু ভাইয়ের মেলামেশার পরিধিটা অনেক বড় ছিল। অভিনয় শুরু করার পর ওর অভিনয় দেখতাম। সমালোচনাও করতাম। আমি তার অনেক ছোট হলেও ভাই আমার মতামত শুনত। ওই সময় সবার মধ্যে বই পড়া এবং সাংস্কৃতিক চর্চা আরো বেশি ছিল। আমাদের নাটকও আরো সমৃদ্ধ ছিল। এখন মানটা পড়ে গেছে। খুব খারাপ লাগে। আমি চেয়েছিলাম, দাদু ভাইয়ের মতো শক্তিমান একজন অভিনেতা বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনে আরো অবদান রাখুক। আমাদের পুরো সাংস্কৃতিক জগতে যেন সে আরো অবদান রাখতে পারে এই আমার  আশা ও চাওয়া।


আমার ভাই তারকা হয়েছে তো অনেক আগেই। এজন্য গর্বিত বোধ করি অবশ্যই। তবে আমি তাকে ভাই হিসেবে, মানুষ হিসেবেই বেশি দেখি। মানুষ হিসেবে সে অসাধারণ। আশপাশের মানুষের প্রতি আগে থেকেই সংবেদনশীল ছিল। মানুষের সঙ্গে মিশতে পারত ছোটবেলা থেকেই। তার এলাকার বাল্যবন্ধুদের সঙ্গে তার এখনো সম্পর্ক আছে। অনেক বেশি দায়িত্ব নেয়। অনেক পরিশ্রম করে।


ব্যস্ততার কারণে এখন দাদু ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয় কম। তবুও আমার পরিবারের সবার অনেক খেয়াল রাখে, বিপদে ছুটে আসে। ও ঢাকায় না থাকলে আমার এখনো একটা কেমন অসহায়ত্ব বোধ হয়। আগেই বলেছি, ও তো শুধু আমার ভাই না, আমার বাবার মতো।

 

Comments

The Daily Star  | English

How Islami Bank was taken over ‘at gunpoint’

Islami Bank, the largest private bank by deposits in 2017, was a lucrative target for Sheikh Hasina’s cronies when an influential business group with her blessing occupied it by force – a “perfect robbery” in Bangladesh’s banking history.

8h ago