আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও শওকত আলী: দুই বন্ধুর আখ্যান

জন্ম তাদের বছরের একই দিনে। যদিও একই বছরে নয়। তাদের মৃত্যুও একই মাসে। বয়সে ৭ বছরের ব্যবধান থাকলেও বন্ধুত্বে খাদ পড়েনি এতটুকুও। তারা একে অপরকে ‘তুমি’ সম্বোধন করতেন। ২ জনেই পড়েছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ে। আবার শিক্ষকতাও করেছেন করেছেন একই কলেজে। এছাড়া তারা একসঙ্গে একই বাসায় ছিলেন বহুদিন। 
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ছবিটি তুলেছেন কবি ওমর শামস, শওকত আলীর ছবিটি তুলেছেন সাদিয়া মাহ্‌জাবীন ইমাম।

জন্ম তাদের বছরের একই দিনে। যদিও একই বছরে নয়। তাদের মৃত্যুও একই মাসে। বয়সে ৭ বছরের ব্যবধান থাকলেও বন্ধুত্বে খাদ পড়েনি এতটুকুও। তারা একে অপরকে 'তুমি' সম্বোধন করতেন। ২ জনেই পড়েছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ে। আবার শিক্ষকতাও করেছেন করেছেন একই কলেজে। এছাড়া তারা একসঙ্গে একই বাসায় ছিলেন বহুদিন। 

তাদের বন্ধুত্ব ছিল অনেকটা এক দেহে দুই প্রাণের মতো। তাদের বন্ধুত্ব যে কতখানি গাঢ় ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় একটি ঘটনায়।  আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের তখন এক পা নেই। ক্যান্সারে একটি পা কেটে ফেলতে হয়েছে।  ঢাকার কমিউনিটি হাসপাতালে তখন  চিকিৎসাধীন ইলিয়াস। শারীরিকভাবে বিধ্বস্ত হলেও তার মনের অবস্থা তখনো টনটনে। হাসপাতালে তাকে দেখতে গিয়েছেন  কথাসাহিত্যিক শওকত আলী। ইলিয়াসের পা নেই দেখে এক পর্যায়ে  কেঁদেই ফেলেন তিনি। ইলিয়াস অবশ্য আবেগকে তেমন একটা  পাত্তা দিতেন না। ভেতরে কোমল আর বাইরে শক্ত ইলিয়াস ধমকে উঠে বলে উঠলেন, 'আশ্চর্য পা গেল আমার, তুমি কাঁদছ কেন?'  

দুই বন্ধুর  প্রথম দেখা হয়েছিল ১৯৬২ সালের কোনো এক দিনে ।  কবি সিকান্দার আবু জাফরের সম্পাদিত সমকাল সাহিত্য পত্রিকার অফিসে তখন নতুন লেখকদের লেখা বাছাইয়ের কাজ চলছে।  সিকান্দার আবু জাফর শওকত আলীকে কিছু লেখা বাছাইয়ের জন্য দিয়েছিলেন। হঠাৎ দুইজন তরুণ অফিসে এসে  শওকত আলীর ডেস্কের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, 'আমরা সম্পাদক সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে চাই'।  শওকত আলী বুঝলেন, এরা কোনো লেখক কিংবা কবি হবেন। তাই তিনি তাদের বসতে বললেন।  কিছুক্ষণ পর আগত তরুণেরা নিজেদের মধ্যে নিচু গলায় কথা বলতে শুরু করলেন। এক তরুণ বলে উঠেলেন, 'জাফর ভাই তো এলেন না। আমরা আর কতক্ষণ অপেক্ষা করব?'  

শওকত আলী তখন তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'কোনো কাজে বোধহয় আটকে পড়ছেন কোথাও—আপনারা কেন এসেছেন তাঁর কাছে?' জবাবে একজন বললেন, 'না এমনি, দেখা করতে—তা আজ যখন দেখা হলো না, তাহলে কাল টেলিফোনে যোগাযোগ করব।' দ্বিতীয় তরুণের  কথায় প্রথমজন মাথা নাড়িয়ে বললেন 'না না, টেলিফোনে কথা নয়—আমরা আগামীকাল আবার আসব। বলবেন, আমার লেখা গল্পটা কবে ছাপানো হবে তা জানতে এসেছিলাম, আমার নাম আখতারুজ্জামান ইলিয়াস।' সেখানে উপস্থিত দ্বিতীয় তরুণ ছিলেন কবি আবুল হাসান।  সেই প্রথম দেখা শওকত আলী এবং আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের। 

প্রথমবার দেখা হওয়ার পর তাদের দ্বিতীয় সাক্ষাৎ হয়েছিল ৩ বছরের ব্যবধানে। তখন জগন্নাথ কলেজের শিক্ষক শওকত আলী। কলেজে শিক্ষক সংকট বলে শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে। প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার পর্ব চলছে। শওকত আলী ইলিয়াসকে দেখেই চিনলেন। তাকে বললেন, 'ইন্টারভিউ দেওয়ার সময় খুব ন্যাচারাল মুডে কথা বলবেন।' 

বলা বাহুল্য ইন্টারভিউ বোর্ডের তরফ থেকে দায়িত্ব দেওয়া শিক্ষকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শওকত আলী। যদিও ইলিয়াসের সাক্ষাৎকার তিনি নেননি। বিকেলের মধ্যেই সাক্ষাৎকার পর্ব শেষ হলো।  আগ্রহী প্রার্থীরা তখন ফলাফলের অপেক্ষায়। জগন্নাথ কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক অজিত গুহ শওকত আলীকে বললেন, 'তুমি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে চেনো?' শওকত আলী জবাবে বললেন, 'হ্যাঁ কিছুটা চিনি, বগুড়ায় বাড়ি, ওর বাবা প্রভিন্সিয়াল অ্যাসেম্বলির মেম্বার ছিলেন।' অজিত গুহ বললেন, 'ওর ইন্টারভিউ ভালো হয়েছে'।  

এরপর জগন্নাথ কলেজে শিক্ষকতার যাত্রা শুরু আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের। তারা দীর্ঘদিন সহকর্মী ছিলেন। ধীরে ধীরে তাদের সম্পর্ক আপনি থেকে 'তুমিতে' নেমে আসে। 

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস একসময় শওকত আলীর হাটখোলা রোডের 'বিরতি ভিলা' নামের একটি বাড়ির নিচতলায়  ভাড়া থাকতেন। তখন তিনি অবিবাহিত।  বিয়ের পর শওকত আলীর বাড়ি ছেড়ে তিনি চলে গিয়েছিলেন রোজ গার্ডেনের পাশে একটি বাড়িতে। এর কয়েক বছর পর তিনি আজিমপুরে চলে আসেন। 

গত শতকের সত্তরের দশকে প্রগতিশীল সাহিত্যিকরা মিলে  গড়ে তুলেছিলেন লেখক শিবির। লেখক শিবির গড়ার অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন দুই বন্ধু আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও শওকত আলী। লেখক শিবির থেকে প্রকাশিত  'লেখক শিবির তৃণমূল' নামের   ত্রৈমাসিক পত্রিকার  সম্পাদক ছিলেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। 

বাংলা ভাষার এই দুই শক্তিমান সাহিত্যিকের সাহিত্যই ছিল ঠাসা বুনটে তৈরি। বাস্তবতার নিপুণ চিত্রণ, ইতিহাস ও রাজনৈতিক জ্ঞান, গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও সূক্ষ্ম কৌতুকবোধ দুজনের রচনাকেই দিয়েছে ব্যতিক্রমী সুষমা।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ইতিহাস-আশ্রিত উপন্যাস 'চিলেকোঠার সেপাই' পড়লে যেমন আমাদের চোখে ভাসে ওসমান, হাড্ডি খিজির, ঠিক তেমনই শওকত আলীর 'দক্ষিণায়নের দিন'  পড়লে আমাদের চোখে ভাসে রাখী ও মনির চরিত্র। অন্যদিকে শওকত আলীর ইতিহাস-আশ্রিত উপন্যাস 'প্রদোষে প্রাকৃতজন' পড়লে যেমন  আমাদের চোখে ভেসে ওঠে শ্যামাঙ্গ, লীলাবতী, বসন্তদাসের চরিত্রগুলো। ঠিক তেমনি ইলিয়াসের 'খোয়াবনামা'  উপন্যাসে পড়লেই আমরা  দেখতে পাই তমিজের বাপ, কুলসুম বা শরাফত মণ্ডলের চরিত্র। 

আখতারুজ্জামান  ইলিয়াস অপেক্ষাকৃত বেশি মনোযোগ দিয়েছেন ছোটগল্পে। আর শওকত আলী দিয়েছেন উপন্যাসে। ইলিয়াসের প্রকাশিত ছোটগল্পের সংখ্যা ৩২টি।  বিপরীতে শওকত আলীর প্রকাশিত উপন্যাসের সংখ্যাও ৩২টি। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের উপন্যাস ও ছোটগল্পে নতুন এক দিগন্তের সন্ধান দিয়েছেন দুই বন্ধু।

শওকত আলী আখতারুজ্জামান  ইলিয়াসের তুলনায় দীর্ঘজীবী ছিলেন। ইলিয়াসের প্রয়াণ হয়েছিল মাত্র ৫৩ বছর বয়সে। অন্যদিকে শওকত আলীর প্রয়াণ হয়েছিল প্রায় পরিপূর্ণ ৮১ বছর বয়েসে। তবে  দুই বন্ধুর মৃত্যু হয় একই মাসে, অর্থাৎ জানুয়ারিতে। 

শওকত আলী ও আখতারুজ্জামান  ইলিয়াসের মধ্যে একটি ভীষণ মিল হলো, তারা দুইজনই ইতিহাসের আশ্রয়ে বেড়ে উঠেছেন। তাদের সৃষ্টিও সেই সাক্ষ্য বহন করে। শওকত আলী প্রদোষে প্রাকৃতজন লিখেছেন  সেন রাজাদের অন্তিম সময় আর তুর্কি শাসনের অত্যাসন্নের প্রেক্ষাপট নিয়ে। ইলিয়াসও লিখতে চেয়েছিলেন বিশাল এক প্রেক্ষাপট নিয়ে। উপন্যাসের নাম ঠিক করেছিলেন 'করতোয়া মাহাত্ম্য'। এই উপন্যাসটি লেখার কথা ছিল  কৈবর্ত বিদ্রোহের পটভূমি নিয়ে। ইলিয়াস নিজেই বলতেন এটি হবে তার মাস্টারপিস। কিন্তু তার অকাল প্রয়াণে সেটা আর হয়ে ওঠেনি।

প্রতিবছর আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তার লেখা ডায়েরিতে অন্য দিনগুলো নিয়ে লিখলেও কেন জানি জন্মদিন নিয়ে তেমন কিছু লিখতে চাইতেন না। তাই তার এদিনের কোনো স্মৃতিও পাওয়া যায় না। ১৯৬৮ সাল থেকে নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন ইলিয়াস। ১৯৭৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি নিজের জন্মদিনে তিনি লিখেছিলেন, '1943-1976

And lo! Jesus, son of God died when he reached this age, 33 Jesus was exhausted and he did all he could do because he was on an assignment to pomp [?] for god…'

১৯৮০ সালে জন্মদিনে ডায়েরিতে ইলিয়াস লিখেছিলেন অথর্ববেদের ১২তম খণ্ডের প্রথম স্তোত্রটি। ১৯৮১ সালে ডায়েরিতে কেবলই পাওয়া যায় '1943-1981', ১৯৮২ সালে '1943-1982 39 years passed, how many years left?'। ঠিক তেমনই ১৯৮৯ সালের ডায়েরিতে এই দিনটিতে পাওয়া যায়, '1943-1989 What to do? I would rather be guilt of what I do than what I don't do. Shouldn't?'  

এই দুই কথাসাহিত্যিকের  জীবনের প্রথমভাগ মসৃণ ছিলো না। ইলিয়াস জন্মেছিলেন তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষের সময়ে। শওকত আলীর বেড়ে উঠা বিশ্বযুদ্ধের কালে। দেশভাগ ও তার কিছুদিন পরে  মায়ের মৃত্যুর পর মাতৃভূমি পশ্চিম দিনাজপুর ছেড়ে শওকত আলীকে চলে আসতে হয়েছিল পূর্ববঙ্গের দিনাজপুরে। যে দুঃখবোধ আর বেদনার্ত স্বর দুজনেই তুলে ধরেছিলেন তাদের সৃষ্ট চরিত্রগুলোর মধ্য দিয়ে।

আজ বাংলাভাষার দুই প্রথিতযশা কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও শওকত আলীর জন্মদিন। বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই বাংলা সাহিত্যের এই দুই কিংবদন্তী স্রষ্টার প্রতি।   

সূত্র:  অবিস্মরণীয় ইলিয়াস/ শওকত আলী

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ডায়েরি/ শাহাদুজ্জামান 

 

 

Comments