সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ঢেলে সাজাবে সরকার

অলঙ্করণ: আনোয়ার সোহেল/স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আসন্ন বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নতুনভাবে সাজানোর পরিকল্পনা করছে। মূলত এসব কর্মসূচিতে স্বচ্ছতা আনতেই এই পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এতে উপকারভোগীর সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ বাড়ানো হবে, তবে বিদ্যমান প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কর্মসূচি বাতিল হতে পারে।

বর্তমানে যেখানে ১৪০টি কর্মসূচি আছে, সেখানে নতুন ব্যবস্থায় ১০০টির নিচে নামিয়ে আনা হবে। এর মধ্যে ৩৮টি কর্মসূচিকে 'দরিদ্রবান্ধব' হিসেবে ধরা হবে, যা ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের পরামর্শ অনুযায়ী করা হচ্ছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, এই ৩৮টি কর্মসূচির সহায়তা মূলত অতি দরিদ্রদের জন্য নির্ধারিত থাকবে।

অর্থনীতিবিদরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ আসলে যতটা মনে হয়, বাস্তবে ততটা নয়। কারণ এতে উন্নয়ন বাজেটের বিভিন্ন কর্মসূচিও যুক্ত থাকে। এবার সরকার এই ধরনের কর্মসূচি বাদ দিয়ে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার উদ্যোগ নিচ্ছে।

নতুন বাজেটে প্রতিটি কর্মসূচির জন্য নির্দিষ্ট বরাদ্দের বিস্তারিত তথ্য থাকবে বলে জানা গেছে।

২০২৫-২৬ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সরকার প্রায় ৯৫ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দিতে পারে, যা মোট বাজেটের ১২ দশমিক ১৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে এই খাতে বরাদ্দ ছিল ৯০ হাজার ৪৬৮ কোটি টাকা, যা ছিল মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৩৫ শতাংশ।

চলতি অর্থবছরে বিদ্যমান ১৪০টি সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির জন্য বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ৩৬ হাজার ২৬ কোটি টাকা। এই কর্মসূচিগুলো যদি আগামীতেও বহাল রাখা হয়, তবে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে মোট বরাদ্দ দাঁড়াতো ১ লাখ ৪৪ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেছেন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোর সংস্কারের দাবি অনেক দিনের।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সরকার যে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলো সংস্কারের উদ্যোগ নিচ্ছে এটি ভালো দিক, যদিও আমি নিশ্চিত নই কোন কোন কর্মসূচি বাদ পড়বে।'

তিনি বলেন, 'দরিদ্র ও প্রান্তিক পরিবারগুলোর জন্যই এই নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলো চালু হয়েছে, কিন্তু বরাদ্দ এখনও যথেষ্ট নয়। জিডিপির অনুপাতে এই খাতে বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কম ব্যয় করে বাংলাদেশ। আগামী বাজেটে এই উদ্বেগগুলো কীভাবে মোকাবিলা করা হয়, তা‌ই এখন দেখার বিষয়।'

ভাতা এবং উপকারভোগী—দুটোই বাড়ছে

মূল নগদ সহায়তা কর্মসূচিগুলোর অধীনে উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি আগামী অর্থবছরে মাসিক ভাতা মাত্র ৫০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হবে।

এই ভাতা বৃদ্ধির বিষয়ে সেলিম রায়হান বলেন, 'প্রতি বাজেটেই এ ধরনের সামান্য ভাতা বৃদ্ধি করা হয়, কিন্তু এই পরিমাণটা খুবই কম। এই বাড়তি টাকা দিয়ে তারা আদৌ কিছু কিনতে পারবেন?'

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের রাজস্ব আয় এখনও কম। অন্যদিকে সুদ, ভর্তুকি, এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হয়। এসব কারণে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ভাতার পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না।

চরম দরিদ্রদের জন্য ৩৮টি প্রকল্পে সরকার আগামী বাজেটে প্রায় ৫২ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দিতে পারে।

এই কর্মসূচিগুলোর মধ্যে ভাতার দিক থেকে সবচেয়ে বড় পরিসর বয়স্ক ভাতা কর্মসূচি, যা ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে চালু হয়েছিল দরিদ্র এবং আয়ক্ষমতা হারানো বৃদ্ধদের সামাজিক সুরক্ষা দেওয়ার জন্য।

এই কর্মসূচির আওতায় আগামী অর্থবছরে মাসিক ভাতা ৫০ টাকা বাড়িয়ে ৬৫০ টাকা করা হবে। ২০২৩ সালে এই ভাতা ছিল ৬০০ টাকা। উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যেও যা বাড়ানো হয়নি।

পরবর্তী বাজেটে বয়স্ক ভাতা কর্মসূচিতে নতুন করে ১ লাখ উপকারভোগী যুক্ত করা হবে। বর্তমানে এ কর্মসূচির উপকারভোগীর সংখ্যা ৬০ লাখ ১ হাজার। চলতি বাজেটে এই খাতে বরাদ্দ ছিল ৪ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা।

সরকারের দ্বিতীয় বৃহত্তম সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি হলো বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা ও দুস্থ নারী ভাতা।

আগামী বাজেট থেকে এই কর্মসূচিতে মাসিক ভাতা ১০০ টাকা বাড়িয়ে ৬৫০ টাকা করা হবে এবং নতুন ১ লাখ ২৫ হাজার নারী এতে যুক্ত হবেন। বর্তমানে উপকারভোগীর সংখ্যা ২৭ লাখ ৭৫ হাজার।

১৯৯৮ সালে চালু হওয়া এই কর্মসূচি গ্রামীণ দরিদ্র নারীদের দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়তা করে আসছে। চলতি অর্থবছরে এই কর্মসূচির জন্য বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ৮৪৪ কোটি টাকা।

শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিদের জন্য ভাতা কর্মসূচির আওতায় মাসিক ভাতা ৫০ টাকা বাড়িয়ে ৯০০ টাকা করা হবে। এ ছাড়া ২ লাখ নতুন উপকারভোগী যুক্ত হবেন, বর্তমানে এই সংখ্যা ৩২ লাখ ৩৪ হাজার।

চলতি বাজেটে এই কর্মসূচিতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩ হাজার ৩২১ কোটি টাকা।

অন্যদিকে বেদে, হিজড়া ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীরা মাসে ৬০০ টাকার পরিবর্তে ৬৫০ টাকা করে ভাতা পেতে পারেন।

মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচিতে মাসিক ভাতা ৫০ টাকা বাড়িয়ে ৮৫০ টাকা করা হবে। এই কর্মসূচির উপকারভোগীর সংখ্যা ১৬ লাখ ৫০ হাজার থেকে বেড়ে ১৭ লাখ ৭১ হাজারে উন্নীত হতে পারে।

খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় আগামী অর্থবছরে সরকার ৫৫ লাখ পরিবারকে স্বল্প মূল্যে চাল দেওয়ার পরিকল্পনা করছে, যেখানে ১০ লাখ টন চাল বিতরণ করা হতে পারে।

চলতি অর্থবছরে ৫০ লাখ পরিবারের জন্য ৭ লাখ ৬০ হাজার টন চাল বরাদ্দ ছিল।

পরিকল্পনা অনুসারে আগামী বছর পরিবারগুলো ৫ মাসের পরিবর্তে ৬ মাস ধরে ৩০ কেজি চাল স্বল্পমূল্যে কিনতে পারবে।

চরম দারিদ্র্যপীড়িতদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচিতে, উপকারভোগীরা বছরে সর্বোচ্চ ৪০ দিন দৈনিক ২০০ টাকা মজুরি পান। আগামী বাজেটে দৈনিক মজুরি ২৫০ টাকায় উন্নীত করা হতে পারে এবং উপকারভোগীর সংখ্যা ৫ লাখ ১৮ হাজার থেকে বেড়ে ৬ লাখে পৌঁছাতে পারে।

এ প্রসঙ্গে সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, উপকারভোগীদের জীবনমান উন্নয়নে প্রত্যেক ব্যক্তির ভাতা আরও বাড়ানো প্রয়োজন।

তিনি বলেন, 'আমাদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোর চ্যালেঞ্জ এবং সেগুলো মোকাবিলায় কী পদক্ষেপ দরকার, সে বিষয়ে ব্যাপক গবেষণা হয়েছে। আমি আশা করি, আসন্ন বাজেটের মাধ্যমে অন্তত কিছু সুপারিশ প্রতিফলিত হবে এবং আমরা সঠিক পথে এগোবো।'

Comments

The Daily Star  | English

NBR activities disrupted as officials continue work abstention

This marks the ninth day of protests since the interim government issued the ordinance on May 12

1h ago