নোনা গোলের মিষ্টি গুড়: প্রচার না পেলেও স্বাদের কমতি নেই

চলতি বছর চার কোটি টাকার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
গোলের গুড়
উপকূলের কৃষকেরা বহু বছর ধরেই গোল গাছের এই রস দিয়ে গুড় তৈরি করে আসছেন। ছবি: স্টার

নামে গোল হলেও পাতা গোলাকার নয়, লম্বা। সবুজ বর্ণের পাতা অনেকটা নারকেল গাছের পাতার মতো। সুন্দরবনসহ আশপাশের এলাকায় একটি প্রাকৃতিক অর্থকরী সম্পদ গোলপাতা।

তুলনামূলকভাবে কম দাম, শক্ত ও অধিক টেকসই হওয়ায় সুন্দরবন–সংলগ্ন এলাকায় ঘরের ছাউনির কাজে গোলপাতা ব্যবহৃত হয়। তবে এখানেই গোলের গুণাগুণের শেষ নয়।

নোনাজলের এই গাছেই মজুত থাকে সুমিষ্ট গাঢ় রস। এই রস জ্বালিয়ে তৈরি হয় সুস্বাদু গুড়। উপকূলের কৃষকেরা বহু বছর ধরেই গোল গাছের এই রস দিয়ে গুড় তৈরি করে আসছেন। এখন সেটা বাণিজ্যিক রূপ পেয়েছে।

পটুয়াখালীর কলাপাড়ার নীলগঞ্জ, মিঠাগঞ্জ, পাখিমারাসহ কয়েকটি গ্রামে গত কয়েক বছর ধরে গোলের গুড় উৎপাদিত হচ্ছে। পতিত লবণাক্ত জমিতে বেড়ে ওঠা গোল গাছ থেকে ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাস গোলের রস সংগ্রহ করা হয়। পরে তা আগুনে জ্বাল দিয়ে গুড় উৎপাদন করে প্লাস্টিকের কৌটায় ভরে বাজারজাত করা হয়।

গোলের গুড়
স্থানীয়রা গোলের গুড় তৈরি করে মৌসুম-ভিত্তিক বাড়তি উপার্জনের সুযোগ পান। ছবি: স্টার

নীলগঞ্জের নবীপুর গ্রামের বাসিন্দা পরিমল চন্দ্র হাওলাদার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ডিসেম্বর মাস এলেই গোল গাছের ফল থেকে যে কাণ্ডের বের হয় সেটির মাথা ধারালো দা দিয়ে কাটা হয়, আর কাঁটা অংশ থেকেই ফোঁটায় ফোটায় রস বের হয়।

ওই রস সংগ্রহের জন্য প্রতিটি কাণ্ডের মাথার সঙ্গে প্লাস্টিক বা মাটির তৈরি পাত্র রশি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়, আর সেখানে ফোঁটা ফোটা রস জমতে থাকে। প্রতিদিন খুব সকালে ও বিকেলে এ রস সংগ্রহ করে বাড়িতে এনে বড় উনুনে টিনের তৈরি পাত্রে রেখে আগুনে জ্বাল দেওয়া হয়।

তিন থেকে চার ঘণ্টা জাল দিলে এই রস গুড়ে পরিণত হয় এবং তা প্লাস্টিকের কৌটায় ভরে বাজারজাত করা হয়।'

গোলের রস থেকে গুড় তৈরিতে কোনো ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হয় না বলে এটি স্বাস্থ্যসম্মত এবং খেতে খুবই সুস্বাদু বলে জানান তিনি।

কলাপাড়া উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এ আর এম সাইফুল্লাহ ডেইলি স্টারকে জানান, এ উপজেলায় ৬৫ হেক্টর জমিতে গোল গাছ রয়েছে। ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে গোল গাছ থেকে স্থানীয়রা রস সংগ্রহ করে গুড় উৎপাদন করেন।

গোলের গুড়
সুন্দরবনসহ আশপাশের এলাকায় একটি প্রাকৃতিক অর্থকরী সম্পদ গোলপাতা। ছবি: স্টার

উপজেলার নীলগঞ্জ, নবীপুর, নিয়ামতপুর, পাখিমারা ও মিঠাগঞ্জসহ কয়েকটি এলাকার ৩০০ পরিবার এ গুড় উৎপাদনে জড়িত। এখানে গত বছর ৩ কোটি টাকার গুড় উৎপন্ন হয়েছে এবং চলতি বছর ৪ কোটি টাকার গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

দেশের অন্যান্য এলাকার মানুষ এ গুড় কিনে নিয়ে যান। এখানকার গোলের গুড় খুবই সুস্বাদু হওয়ায় এর চাহিদা অনেক। স্থানীয়রা এ গোলের গুড় তৈরি করে মৌসুম-ভিত্তিক বাড়তি উপার্জনের সুযোগ পান।

নবীপুর এলাকার বাসিন্দা হরি নারায়ণ মিত্র জানান, বাপ-দাদার মতো তিনিও গোলের রস থেকে গুড় উৎপাদন করছেন। তাদের উৎপাদিত গুড় স্থানীয় খুচরা বাজারে বিক্রি করতে হয়, কিন্তু সরকারিভাবে এখানে একটি বাজারের ব্যবস্থা করা গেলে তারা ভালো দাম পেতেন এবং গুড় উৎপাদনকারীরা অধিক লাভবান হতে পারতেন।

অপর এক গুড় উৎপাদনকারী সুমিত মণ্ডল জানান, তিনি ৩০০ গোল গাছ থেকে প্রতিদিন ৮-১০ কলস রস সংগ্রহ করতে পারেন এবং সেখান থেকে দৈনিক ২৫-৩০ কেজি গুড় উৎপাদন করতে পারেন। প্রতি কেজি গোলের গুড় ১৮০ টাকা থেকে ২০০ টাকায় স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেন।

গোলের গুড়
গোলের বাগান ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। ছবি: স্টার

সুমিতের স্ত্রী নমিতা মণ্ডল জানান, ঢাকা, পাবনা, বরিশাল ও খুলনাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে মোবাইলে কথা বলে তাদের গুড় কিনে নেন ক্রেতারা।

পাবনার একটি কোম্পানিকে ইতোমধ্যে ১০০ কেজি গুড় কুরিয়ারের মাধ্যমে সরবরাহ করেছেন বলেও জানান তিনি।

একই এলাকার নিঠুর হাওলাদার জানান, তিনি ২৫০টি গোল গাছ থেকে গড়ে দৈনিক ১০ কলস রস সংগ্রহ করেন। এতে তার ৩০ কেজি গুড় উৎপন্ন হয়।

তিনি বলেন, 'সরকারিভাবে একটি বাজার তৈরি করা হলে সেখানে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা গুড় কিনলে আমরা আরও ভালো দামে গুড় বিক্রি করতে পারতাম এবং আরও লাভবান হতে পারতাম।'

স্থানীয় শশধর হাওলাদার জানান, গোল গাছ থেকে শুধু রসই পাওয়া যায় না, গোল গাছের পাতা ঘরের ছাউনি ও জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। তবে এই এলাকায় গোলের বাগান ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। কারণ অনেকেই গোল গাছ ধ্বংস করে তা কৃষি জমিতে পরিণত করে ধান আবাদ করছেন।

গোলের গুড়
এ বছর থেকে পটুয়াখালীতে গোলের গুড়ের প্রচারে সহায়তা করার কথা জানিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। ছবি: স্টার

গ্রামের আরেক বাসিন্দা সজল মিত্র জানান, এ অঞ্চলের কৃষকরা তাদের অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি শীত মৌসুমে গোলের গুড় উৎপাদন করে বাড়তি আয়ের সুযোগ পাচ্ছেন এবং এ এলাকার গুড়ের চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা হচ্ছে।

প্রতি বছর কলাপাড়া উপজেলায় ম্যানগ্রোভ প্রজাতির গোল গাছ থেকে বছরে কয়েক কোটি টাকার গুড় উৎপন্ন হলেও সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা না থাকায় গুড় উৎপাদনকারীরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

তবে এ বছর থেকে পটুয়াখালীতে গোলের গুড়ের প্রচারে সহায়তা করার কথা জানিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়।

গতকাল শনিবার কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা অণুবিভাগ) মো. মাহবুবুল হক পাটোয়ারী কলাপাড়া এলাকায় মাঠপর্যায়ে কৃষি কার্যক্রম পরিদর্শন করেন।

সেসময় তিনি বলেন, 'গোলের গুড় এ অঞ্চলের একটি বিশেষ মৌসুমি কৃষিজ পণ্য হওয়ায় তা আরও স্বাস্থ্যকর পরিবেশে উৎপাদন নিশ্চিত করাসহ উৎপাদকদের কারিগরি ও মার্কেটিং সুবিধা নিশ্চিতেও কাজ করবে মন্ত্রণালয়।'

Comments