ইলিশ: রূপালি জৌলুসের বিপরীতে জেলেদের বিবর্ণ জীবন

কারওয়ানবাজারে ইলিশের মোকাম। ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার

অনেক মানুষ, ব্যাপক কোলাহল! এরই ভেতর মাছ বাজারের কোণায় মেঝের ওপর রাখা এক ঝুড়ি ইলিশ বিক্রির ডাক তুললেন চশমা পরা এক ব্যক্তি। তিনি অন্য ব্যবসায়ীদের বলা দাম ছন্দে-ছন্দে সুর তুলে বলছিলেন: 'চৌদ্দ শ… চৌদ্দ শ বিশ… সাড়ে চৌদ্দ শ…।'

নিলামকারীর সামনে দাঁড়ানো ব্যবসায়ীরা যেন ইলিশ মাছের মতোই একজন আরেকজনের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। বরফে মোড়ানো ইলিশের বড় সাদা বাক্স বোঝাই রিকশা-ভ্যানগুলো ভিড় কাটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। চাকার নিচে পা পড়ার আশঙ্কা থাকলেও সেদিকে যেন কারও খেয়াল নেই।

নিলামকারী ব্যক্তিটি সম্ভবত পঞ্চাশোর্ধ্ব। খানিক বাদে তার ডাক শেষ করে সঙ্গীদের ইলিশ ওজন করতে বললেন। পাল্লায় ২৭ কেজি দেখাতেই চশমাপরা ভদ্রলোকটি লাল টালিখাতা খুলে কী যেন লিখে নিলেন।

ইলিশগুলো শেষ পর্যন্ত বিক্রি হলো কেজিপ্রতি এক হাজার ৪২০ টাকায়। এটিই সর্বোচ্চ দর। এক কুলি এসে ইলিশের ঝুড়িটা নিয়ে মূহূর্তেই মানুষের ভিড়ে হারিয়ে গেলেন।

প্রায় একই দৃশ্য আবার দেখা গেল যখন নিলামকারী আরও এক ঝাঁক ইলিশের জন্য ডাকতে শুরু করলেন। পার্থক্য—এখনকার মাছগুলো সংখ্যায় বেশি হলেও আকারে ছোট।

কেজিপ্রতি ৮০০ টাকা দাম হেঁকে এবার নিলাম শুরু করেন তিনি।

দৃশ্যটি ঢাকার অন্যতম বড় মৎস্যকেন্দ্র কারওয়ান বাজারের। সূর্য ওঠার আগেই বাজারটি ভীষণভাবে প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠে। এখানে এলে দেখা যায় বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ মহানগরীর বাসিন্দাদের জেগে ওঠার দৃশ্য।

জলের রূপালি শস্য। ছবি: স্টার

রাজধানীর অন্যান্য এলাকা থেকে আসা ছোট ব্যবসায়ীরা পাইকারি দামে ইলিশ কিনতে ভিড় করেন কারওয়ান বাজারে।

বাজার ঘুরে ঘুরে সারাদেশ থেকে আসা মাছ দেখেন আড়তদার-মহাজনরা।

ইলিশ আসে উপকূলীয় জেলা থেকে—দক্ষিণে বরগুনা, পটুয়াখালী ও ভোলা এবং দক্ষিণপূর্বে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার।

জেলেরা সাগর, নদী, মোহনা ও উপকূল থেকে মাছ ধরে আড়তদারদের কাছে আনেন।

এভাবেই শুরু হয় ইলিশের ব্যবসা।

জীবিকার জন্য ইলিশের ওপর নির্ভরশীল ১০ লাখ জেলের একজন পটুয়াখালীর ইসলাম হাওলাদার। তিনি জানান, আড়তদারদের কাছে নিয়ে আসার পর মাছ নিলামে তোলা হয়।

দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় মাছ ইলিশের বাণিজ্য মূলত হয়ে থাকে 'দাদন'র মাধ্যমে। অর্থাৎ, জেলেদের আগেই ঋণ হিসেবে টাকা দেওয়া হয়। পরে মাছ ধরে তারা তা পরিশোধ করেন।

দেশের মোট বার্ষিক মাছ আহরণের ১২ শতাংশেরও বেশি আসে ইলিশ থেকে।

জেলেদের ট্রলার মেরামত ও মাছ ধরার সরঞ্জামের পাশাপাশি জ্বালানি, বরফ, খাবার ও অন্যান্য পণ্য কিনতে আড়াতদাররা ঋণ দেন।

এই শর্তে ঋণ দেওয়া হয় যে জেলেরা তাদের পুরো মাছ ঋণদাতাকে দেবেন। সেখান থেকে মুনাফা ভাগাভাগি হয়।

সাধারণত বড় শহরের আড়তদাররা স্থানীয় ছোট মাছ ব্যবসায়ীদের 'দাদন' ঋণ দিয়ে থাকেন। তারা স্থানীয় পর্যায়ের আড়তদার।

স্থানীয় আড়তদাররা ঋণ দেন মাছ ধরার নৌকা মালিকদের।

এসব আড়তদার স্থানীয় মাছ-ঘাট বা ঢাকায় মাছ বিক্রির টাকার ওপর কমিশন নেন।

কখনো আবার মাছ-ঘাটের কাছাকাছি প্রতিষ্ঠিত আড়তদাররা নিজেরাই 'দাদন' দিয়ে থাকেন। সে ক্ষেত্রে ঢাকায় কাউকে কমিশন দেওয়ার প্রয়োজন হয় না।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) ২০২০ সালের জুনে 'বাংলাদেশে ইলিশ গবেষণা ও উন্নয়ন' শীর্ষক গবেষণাপত্র থেকে জানা যায়, আড়তদারদের নিলামে তোলা সব মাছের ওপর দুই থেকে ছয় শতাংশ কমিশন আদায় করা হয়।

বিক্রয়মূল্য থেকে কমিশন ও প্রাথমিক ঋণ কেটে নেওয়ার পর আড়তদাররা কেজিপ্রতি ইলিশ থেকে ১০ টাকা আদায় করেন।

ইলিশ আহরণে জেলেরা। ছবি: টিটু দাশ/স্টার

বাকি টাকা নৌকা মালিক ও জেলেদের ভাগ করে দেওয়া হয়।

তবে এটি সমানভাবে দেওয়া হয় না। নৌকা মালিকরা বাকি টাকার অর্ধেক পান। বাকি অর্ধেক জেলে ও নৌকার মাঝিদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়।

এই অর্ধেকের মধ্যে প্রধান মাঝি দুটি ভাগ ও প্রত্যেক জেলে একটি করে অংশ পান বলে জানিয়েছেন পটুয়াখালীর জেলে ইসলাম হাওলাদার।

তবে প্রচুর মাছ না পেলে সবাইকে আড়তদারের কাছে ঋণী হয়ে থাকার আশঙ্কা থাকে।

একে 'দুষ্টচক্র' হিসেবে আখ্যা দিয়ে পটুয়াখালীর প্রধান মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র মহীপুর ফিশিং ট্রলার্স মালিক সমিতির সভাপতি দেলোয়ার গাজী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ইলিশ ধরার জন্য আমাদের যথেষ্ট টাকা নেই। তাই আড়তদারদের থেকে টাকা নিতে হয়।'

বিএফআরআই'র প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ইলিশ ধরা জেলেরা সবচেয়ে গরিব। তাদের অধিকাংশই ভূমিহীন। বার্ষিক আয় মাত্র ৬০ থেকে ৮০ হাজার টাকা।

এতে আরও বলা হয়—তাদের সঞ্চয় নেই। জীবনযাত্রার মান খুব নিচু। মাছ ধরার সরঞ্জাম তারা কিনতে বা ভাড়া করতে পারেন না। নদী-সাগরে মাছ ধরার নৌকা চালানোর খরচও বহন করতে পারেন না।

মৎস্যজীবী ও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন—ইলিশ হাত বদল হয় চার থেকে ছয়বার। জেলেরা প্রথমে মাছ-ঘাটের আড়তদারদের হাতে মাছ তুলে দেয়। সেখানকার আড়তদাররা পরে পাইকারদের কাছে মাছ পাঠান। পাইকাররা খুচরা বিক্রেতাদের কাছে তা বিক্রি করেন। শেষে যায় ক্রেতাদের হাতে।

ব্যবসায়ীরা ডেইলি স্টারকে জানান, বাজারে বিদ্যমান দর ও মাছের পরিমাণ বিবেচনায় নিয়ে পাইকাররা দাম নির্ধারণ করেন।

ইসলাম হাওলাদার ও দেলোয়ার গাজী জানান, মহীপুরে তাদের মাছ নিলামে তোলা হলে স্থানীয় ও আন্তঃজেলার পাইকারদের পাশাপাশি আড়তদারদের প্রতিনিধিরাও অংশ নেন।

তাদের একজন বলেন, 'অনেক সময় আড়তদাররা ইলিশ কিনে মজুদ করে রাখেন। বিশেষ করে যখন প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ে। পাইকারদের সংখ্যা যখন কম থাকে তখন এমনটি হয়।

কক্সবাজারে আড়তদার ও পাইকারদের পূর্বনির্ধারিত দামে ইলিশ বিক্রি হয়।

কক্সবাজার ফিশিং বোট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বড় মাছ-ঘাটের বাজারদরের খবর নিয়ে পাইকাররা এখানে দাম ধরেন।'

তার অভিযোগ, 'পাইকাররা দাদন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগসাজশে কম দাম ধরায় নৌকা মালিক ও জেলেরা ন্যায্যমূল্য পান না। আমাদের কাছ থেকে এক কেজি ওজনের ইলিশ ৯০০ টাকায় কিনে ঢাকায় বিক্রি করা হয় এক হাজার ৪০০ টাকায়।'

দেলোয়ার গাজীরও একই অভিযোগ। 'ঢাকায় এক কেজির বেশি ওজনের ইলিশ যেখানে বিক্রি হয় দুই হাজার টাকায়, আমাদের এখানে বিক্রি হয় দেড় হাজারে।'

এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন নয়। গত মাসে যাত্রাবাড়ীতে অভিযান চালিয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর দেখতে পায়, পাইকারি দামের চেয়ে ৫১ শতাংশ বেশি দামে ইলিশ বিক্রি হচ্ছে।

অধিদপ্তর আরও জানায়, রশিদ বা ভাউচার ছাড়াই মাছ বিক্রি হচ্ছে।

সাধারণের সাধ্যের বাইরে। ছবি: স্টার

দেলোয়ার গাজী আরও বলেন, 'জেলেরা যদি আড়তদারদের কবল থেকে মুক্ত হয়ে মাছ বিক্রি করতে পারেন তবে তারা আরও বেশি মুনাফা করতে পারবেন।'

'কিন্তু দাদনের কারণে পারছি না। মাছ তাদের কাছে বিক্রি করতেই হয়। ব্যাংক ঋণ পেলে আড়তদারদের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে পারতাম। ব্যাংক-এনজিও আমাদের ঋণ দেয় না।'

নৌকার মালিকরা আনুষ্ঠানিক ঋণের সুযোগ পেলেও মুনাফা ভাগাভাগিতে পরিবর্তন না এলে ইসলাম হাওলাদার ও তার মতো জেলেদের কষ্ট দূর হওয়ার সম্ভাবনা কম।

বিএফআরআই বলছে, ইলিশ ধরা লাভজনক। মুনাফার ভাগ পক্ষপাতদুষ্ট, অসম ও শোষণমূলক।

এর প্রতিবেদনে বলা হয়, মুনাফা বণ্টনের ফলে প্রকৃত মৎস্যজীবীদের আয় কমে গেছে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মৎস্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক মো. আব্দুল ওহাব ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ক্রেতারা চড়া দামে ইলিশ কিনলেও প্রকৃত জেলেরা সামান্যই উপকৃত হন।'

তার মতে, নৌকা মালিক ও দাদন ব্যবসায়ীরাই প্রকৃত সুবিধাভোগী।

'ইলিশ আহরণে সরকারি বিধিনিষেধ মেনে প্রতিবছর ১৪৩ দিন কর্মহীন থাকলেও প্রকৃত জেলেদের অবস্থার উন্নতি হয়নি।'

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ সাইদুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জেলেরা ঋণের দুষ্টচক্রে পড়েছেন। তাদের সন্তানরা পড়ালেখা করতে পারে না। সরকার সামাজিক সুরক্ষা বাড়ালেই তাদের জীবনমান উন্নত হবে।'

ইলিশ ধরায় ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শুরু হচ্ছে আজ শনিবার মধ্যরাত থেকে।

এমন পরিস্থিতিতে ইসলাম হাওলাদার আশা করছেন, দাদন ব্যবসায়ীর টাকা পরিশোধের পর পরবর্তী তিন সপ্তাহ তাকে হয়ত চরম কষ্টে কাটাতে হবে না।

Comments

The Daily Star  | English

CSA getting scrapped

The interim government yesterday decided in principle to repeal the Cyber Security Act which has been used to curb press freedom and suppress political dissent.

5h ago