‘জীবনধারণের মতো মজুরি নির্ধারণে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে’

ছবি: সংগৃহীত

'শিল্পের অস্তিত্ব রক্ষার দোহাই দিয়ে ন্যায্য মজুরি থেকে শ্রমিককে বঞ্চিত করা যাবে না। বরং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মালিক-শ্রমিকের অংশগ্রহণের সমতাকে বিবেচনায় রেখে জীবনধারণের মতো মজুরি নির্ধারণে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।'

নিম্নতম মজুরি বোর্ডের কার্যকারিতা বিশ্লেষণ এবং করণীয় বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) আয়োজিত এক গোল টেবিল বৈঠকে কথাগুলো বলেন বক্তারা।

মন্ডিয়াল এফএনভির সহযোগিতায় ও বিলসের উদ্যোগে সম্প্রতি সমাপ্ত 'বাংলাদেশে নিম্নতম মজুরি: প্রয়োগ ও কার্যকারিতার সন্ধানে' শীর্ষক গবেষণা কার্যক্রমের ফলাফল উপস্থাপন এবং ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারণ বিষয়ে রোববার  এই গোলটেবিল বৈঠক আয়োজিত হয়। 

বিলসের ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেনের সভাপতিত্বে বৈঠকে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নিম্নতম মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান মামুনুর রশিদ, স্বাগত বক্তব্য রাখেন বিলসের মহাসচিব নজরুল ইসলাম খান এবং সূচনা বক্তব্য রাখেন সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এনামুল হক, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের আইন কর্মকর্তা মাসুম বিল্লাহ, আইএলওর প্রকল্প কর্মকর্তা নিরান রামজুঠান প্রমুখ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বিলসের নির্বাহী পরিষদের সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ এবং গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য তুলে ধরেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মোস্তাফিজ আহমেদ।

আয়োজনে বক্তারা বলেন, শ্রমিককে বঞ্চিত করার মনোভাব কাটিয়ে তাদের জীবনমান ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, বাজার পরিস্থিতি, মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি বিবেচনায় রাখতে হবে। ঠিকাদারি ব্যবস্থার কারণে মজুরিপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে শ্রমিকের যে হয়রানি হয়, তার অবসান ঘটাতে হবে।

তারা বলেন, সমীক্ষার মাধ্যমে শ্রমিকদের চাহিদা নিরূপণ করে ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের মজুরি নির্ধারণ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ঘোষিত মজুরি বাস্তবায়ন সঠিকভাবে হচ্ছে কি না, তা মজুরি বোর্ড পরিবীক্ষণ করলে সেটি সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে তারা আশা করেন। এ ছাড়া মজুরি বোর্ডকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রেখে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে।

বক্তারা আরও বলেন, প্রতি পাঁচ বছর পর মজুরি বোর্ড গঠন না করে বরং তা প্রতি তিন বছর পর গঠন করলে সেটি সময়োপযোগী ও অধিক কার্যকরী হবে। এ ছাড়া বোর্ডের গঠন ও কার্যক্রমের সঙ্গে বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে বিবেচনায় রাখতে হবে।

তারা বলেন, তবে মালিকের সাধ্য এবং শ্রমিকের চাহিদাকে বিবেচনায় রেখে আইনগত ও যুক্তিসঙ্গতভাবে মজুরি নির্ধারণ করা প্রয়োজন। মজুরি বোর্ডে ভারসাম্যমূলক প্রতিনিধিত্ব এবং সদস্যদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা দরকার। মজুরি বাস্তবায়ন নিশ্চিতকরণের অগ্রগতি পর্যালোচনায় কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের জোরালো ভূমিকা রাখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে বক্তারা অভিমত ব্যক্ত করেন।

বক্তারা বলেন, বর্তমানে দ্রব্যমূল্য ও বাড়িভাড়া বৃদ্ধির কারণে পূর্বের মজুরিতে জীবনধারণ কঠিন হয়ে পড়েছে। মজুরি নির্ধারণে এ বিষয়টি জোরালোভাবে বিবেচনায় রাখতে হবে। এ ছাড়া বোর্ডের মানসম্পন্ন পরিচালনা পদ্ধতিও নির্ধারণ করা দরকার এবং সেক্টরের সংখ্যা সর্বোচ্চ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

বর্তমানে মোট ৫৬টি বোর্ড গঠন করা হয়েছে এবং এটির পরিবীক্ষণে পরিদর্শন অধিদপ্তরের দায়িত্ব রয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে উল্লেখ করে জানানো হয়, জাতীয় ন্যূনতম মজুরি বোর্ড গঠনের প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।

বক্তারা আরও বলেন, মজুরির বিষয়টি অর্থনৈতিক হলেও মজুরি নির্ধারণের বিষয়টি হয়ে যায় রাজনৈতিক। এ বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে। এক্ষেত্রে সামাজিক দায়বদ্ধতা কেউই এড়াতে পারেন না। অধিকার বঞ্চিত হলে জীবন বাঁচানোর তাগিদ শ্রমিককে প্রতিবাদী করে তোলে। এ বিষয়টি পুঁজি বিনিয়োগকারী, মালিকপক্ষ ও সরকারকে বুঝতে হবে।

নিম্নতম মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান মামুনুর রশিদ বলেন, বোর্ডের নিজস্ব সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় রেখেই মজুরি বোর্ডকে কাজ করতে হচ্ছে। শ্রমিকপক্ষ তাদের অধিকারের কথা মালিকপক্ষের মতো জোরালোভাবে তুলে ধরতে পারেন না—এ কথা মালিকপক্ষকে বিবেচনায় রেখে তাদের শ্রমিকবান্ধব হতে হবে।

উল্লেখ্য, গবেষণায় দেখা যায়, মজুরি বোর্ড গঠনের পর ছয় মাসের মধ্যে মজুরির ঘোষণা আসার কথা থাকলেও এ ক্ষেত্রে দুই বা তিনগুণ কিংবা তারও বেশি সময় লেগে যায়। এক্ষেত্রে বোর্ডের সদস্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে কী ধরনের নীতি রয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে যায়। গবেষণায় যে বিষয়গুলো সুপারিশ করা হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল—বোর্ডের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, সদস্যদের যোগ্যতা ও তাদের ভূমিকা নির্ধারণ, মজুরি হিসাবের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য মান নির্ধারণ ও সরকারের সদিচ্ছা।

মূলত চারটি সেক্টরের মজুরি নির্ধারণ প্রক্রিয়াকে ভিত্তি ধরে এ গবেষণা কার্যক্রমটি সম্পন্ন করা হয়। গবেষণার বিবেচিত চারটি সেক্টর হচ্ছে—তৈরি পোশাক খাত, চা, ট্যানারি ও চিংড়িখাত। গবেষণাটির উদ্দেশ্য ছিল—তৈরি পোশাক, চা, ট্যানারি ও চিংড়িখাতের মজুরি নির্ধারণ প্রক্রিয়াকে ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করে বাংলাদেশের নিম্নতম মজুরি বোর্ডের কার্যকারিতা বিশ্লেষণ করা, নিম্নতম মজুরি বোর্ডের কাঠামো, মজুরি নির্ধারণ প্রক্রিয়া, কৌশল এবং সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করা, নিম্নতম মজুরি বোর্ডের যথাযথ কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে ট্রেড ইউনিয়ন এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের প্রধান ভূমিকা চিহ্নিতকরণ, নিম্নতম মজুরি বোর্ডের যথাযথ কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় সুপারিশমালা প্রণয়ন করা।

বৈঠকে ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের মধ্যে পোশাকশ্রমিকের পক্ষে নাজমা আক্তার, ট্যানারিশ্রমিকের পক্ষে আব্দুল মালেক, চিংড়িশ্রমিকের পক্ষে শাহাদাত হোসেন এবং অন্যান্য ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন রাজেকুজ্জমান রতন, বাদল খান, নূরুল ইসলাম, বাবুল আখতার, চায়না রহমান, তৌহিদুর রহমান, সালাউদ্দিন স্বপন, শহীদুল্লাহ বাদল প্রমুখ। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন অ্যাডভোকেট এ কে এম নাসিম, শাহীনুর রহমান।

মালিকপক্ষের সংগঠনের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন মাহবুবুর রহমান ও আমিরুল ইসলাম। এছাড়াও সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, ট্রেড ইউনিয়ন নেতা, মালিক সংগঠন ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, গবেষক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন।

Comments

The Daily Star  | English

Magura child rape case trial begins; four indicted

The court has set April 27 for the next date of hearing in the case

41m ago