গোল্ডেন লাইফ ইন্স্যুরেন্সের প্রধান কার্যালয় বন্ধ, পাওনার অপেক্ষায় ১৮ হাজার গ্রাহক

ঢাকার মহাখালীতে বন্ধ হয়ে রয়েছে গোল্ডেন লাইফ ইন্স্যুরেন্সের প্রধান কার্যালয়। ছবি: রাশেদ সুমন

নগদ অর্থের সংকট, অপরিশোধিত দাবি ও পরিচালন বিপর্যয়ের কারণে সংকটে পড়েছে বেসরকারি বীমা কোম্পানি গোল্ডেন লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড।

১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিটির প্রায় ১৮ হাজার গ্রাহক এখন তাদের পাওনা পরিশোধের অপেক্ষায় আছেন।

গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ঢাকার মহাখালীর অ্যামবোন কমপ্লেক্সে বীমা কোম্পানিটির প্রধান কার্যালয় দেড় মাসেরও বেশি সময় বন্ধ থাকায় তাদের সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে।

বীমা কোম্পানিটি মোট ৩৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা দাবি নিষ্পত্তি করতে ব্যর্থ হওয়ায় কোম্পানির গ্রাহক ও কর্মীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠানটি তাদের প্রধান কার্যালয় বন্ধ করে দেয়।

পরিস্থিতির ভয়াবহতার কথা স্বীকার করেছেন গোল্ডেন লাইফের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আমজাদ হোসেন খান চৌধুরী।

তিনি বলেন, 'টানা ২০ দিনের বেশি সময় ধরে প্রধান কার্যালয় বন্ধ। বর্তমান সমস্যা সমাধানে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।'

যদিও আমজাদ হোসেন খান চৌধুরীর দাবি, কোম্পানিটির শাখা অফিসগুলোয় 'যথারীতি' কার্যক্রম চলছে, তবে প্রায় ২০০ কর্মচারীকে বেতন দিতে বা সদর দপ্তরের বকেয়া ভাড়া পরিশোধ করতে না পারার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।

দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা

বছরের পর বছর ধরে পরিচালনাগত অব্যবস্থাপনা এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণেই বীমা কোম্পানিটিতে এমন সংকট সৃষ্টি হয়েছে।

২০১১ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে পলিসি বিক্রির মানি রিসিট প্রধান কার্যালয়ে না পাঠানোসহ বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের কথা উল্লেখ করেন আমজাদ হোসেন খান চৌধুরী।

কোম্পানিটির সিইও বলেন, এই অনিয়মের কারণেই কোম্পানিটি বেকায়দায় পড়ে যায়। এ কারণে দীর্ঘদিন ধরে পরিস্থিতি জটিল হয়ে আছে এবং এই ভোগান্তি চলছে।

তিনি আরও বলেন, আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর কার্যক্রম পরিচালনার জন্য হঠাৎ অর্থায়ন বন্ধ হয়ে যায়। ফলে সেপ্টেম্বর থেকে গ্রাহকদের বীমাদাবির অর্থ দেওয়াও বন্ধ হয়ে যায় এবং কর্মীদের বেতন আটকে যায়।

সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, অ্যামবন কমপ্লেক্সের তৃতীয় ও পঞ্চম তলায় দরজা তালাবদ্ধ।

ভবনের নিচতলায় ঢোকার পথে একটি নোটিশে লেখা ছিল, 'অফিসটি বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। বোর্ড সময়মতো প্রতিশ্রুত অর্থ সরবরাহ করতে ব্যর্থ হওয়ায় ধর্মঘট চলছে। আমরা গ্রাহকদের ধৈর্য ধরতে বিনীতভাবে অনুরোধ করছি।'

ভবনটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, গোল্ডেন লাইফ ইন্সুরেন্স গত দুই মাস ধরে অফিসভাড়া, বিদ্যুৎ বা পানির বিল পরিশোধ করেনি। তবে আসন্ন ঈদুল ফিতরের পর বকেয়া মিটিয়ে অফিস খালি করার কথা জানিয়েছে বীমা কোম্পানিটি।

সদর দপ্তরের সংকটের প্রভাব গোল্ডেন লাইফের ঢাকার বাইরের শাখা অফিসগুলোতেও পড়েছে।

১৬ মার্চ কোম্পানিটির চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয় ঘুরে দেখা যায়, মাত্র একজন কর্মকর্তা উপস্থিত আছেন। অফিস প্রধানের কক্ষ তালাবদ্ধ এবং অন্য কোনো কর্মী নেই।

'একটি কোম্পানি এভাবে চলতে পারে না'

গোল্ডেন লাইফের সংকটের মধ্যে হস্তক্ষেপ করেছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)।

গত সপ্তাহে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক, হিসাব প্রধান ও কোম্পানি সচিবকে তলব করা হয় সবশেষ তথ্যের জন্য।

গতকাল বিষয়টি সমাধানের জন্য বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা কর্তৃক নির্ধারিত সময়সীমা ছিল। তবে সংস্থাটি তা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়ে আরও সময় চায়।

নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেই আবেদন মঞ্জুর করে আগামী ২০ মার্চ পরবর্তী বৈঠকের দিন ধার্য করেছে।

আইডিআরএর সদস্য মো. আপেল মাহমুদ ডেইলি স্টারকে বলেন, একটি কোম্পানি এভাবে চলতে পারে না। এভাবে কোম্পানির হেড অফিস বন্ধ রাখার এখতিয়ার তাদের নেই। কোম্পানি পরিচালনার ক্ষেত্রে তো কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে।

এদিকে গোল্ডেন লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান এ কে এম আজিজুর রহমান গতকাল এক চিঠিতে আইডিআরএকে আশ্বস্ত করেছেন, আগামী ৩০ দিনের মধ্যে জরুরি সব বকেয়া দাবি নিষ্পত্তি করা হবে।

তবে, গোল্ডেন লাইফ ইন্স্যুরেন্সের এই ধরনের অনিয়ম নতুন নয়।

২০২২ সালে আইডিআরএ কর্তৃক একটি বিশেষ নিরীক্ষায় কোম্পানিটির অনিয়মের বিষয়ে জানা যায়। সেই সময় তাদের ২২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। তবে, সেই অর্থও এখনো অপরিশোধিত রয়ে গেছে বলে আইডিআরএর নথি থেকে জানা গেছে।

এছাড়া কোম্পানিটি তাদের ১৪টি বীমা পণ্যের অনুমোদনের কাগজপত্র দেখাতে ব্যর্থ হওয়ায় এর পরিচালনা ও সুশাসন নিয়ে আরও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে বলে ওই নথিতে উল্লেখ রয়েছে।

গোল্ডেন লাইফের মোট সম্পদের পরিমাণ ৫৫ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। তাদের গ্রাহক সংখ্যা এক লাখ ৪০ হাজার।

বহুজাতিক ও স্থানীয় প্রতিষ্ঠানে ২০ বছরেরও বেশি সময় কাজ করা এক বাংলাদেশি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ও জীবন বিমা বিশেষজ্ঞ নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেইলি স্টারকে বলেন, বীমা কোম্পানি ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ উভয়ের দুর্বল নিয়ন্ত্রণের কারণেই এই ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

তিনি বলেন, 'নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে অন্যান্য কোম্পানিতেও একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। ফলে বীমা কোম্পানির প্রতি মানুষের আস্থা আরও কমবে।'

বাংলাদেশে ৮২টি ইন্সুরেন্স কোম্পানি রয়েছে। এর মধ্যে ৩৬টি জীবন বীমা খাত সংশ্লিষ্ট এবং ৪৬টি নন-লাইফ বীমা কোম্পানি।

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন দ্য ডেইলি স্টারের চট্টগ্রামের ব্যুরো চিফ মো. নজরুল ইসলাম)

Comments

The Daily Star  | English
Household duties preventing Bangladeshi women from working

Domestic chores hold women back from formal jobs

The research found that 81 percent of women cited household duties as their biggest barrier to joining the labour force

11h ago