কেন একটি পাঞ্জাবির দাম ৪ লাখ, শাড়ি দেড় লাখ টাকা

ছবি: পলাশ খান/স্টার

এ বছর ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে দেশে যে কয়েকটি বিষয় আলোচনায় ছিল, তার মধ্যে একটি হলো দামি পোশাক। কিছু পোশাকের দাম এতোটাই বেশি ছিল যে ক্রেতাদের অনেকে তা শুনে বিস্মিত হয়েছেন।

ঢাকার কিছু কিছু দোকানে ঈদের অন্যতম প্রধান পোশাক পাঞ্জাবির দাম চার লাখ টাকা—এমন খবর ছড়িয়ে পড়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এটি আলোচনার বিষয় হয়ে উঠে।

গণমাধ্যমে উঠে আসে, ঢাকার একটি ফ্যাশন আউটলেট একটি পাঞ্জাবি বিক্রি করছে চার লাখ টাকায়। এমন পরিস্থিতি স্বভাবতই অনেকের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে—পাঞ্জাবির দাম এত বেশি কেন? কী এমন বিশেষত্ব এর?

ছবি: পলাশ খান/স্টার

বিক্রেতারা বলছেন, এর পেছনে রয়েছে উন্নতমানের কাপড়, সূক্ষ্ম নকশা, হাতে তৈরি কারুকাজ এবং পরিশীলিত রং করার প্রক্রিয়া।

রাজধানীর বনানীর প্রিমিয়াম ফ্যাশন ব্র্যান্ড আনজারায় পাঞ্জাবির দাম সাড়ে চার হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৯৫ হাজার টাকা। নারীদের কাফতান শাড়ির দাম ১৪ হাজার ৮০০ থেকে ১৬ হাজার ৮০০ টাকা।

আনজারার জনসংযোগ ব্যবস্থাপক নওশিন নাওয়ার বলেন, 'ভালো মানের ফেব্রিক, নিখুঁত ডিজাইন ও ডায়িংয়ের কারণে দাম এমন। আমাদের কাপড়ে এমব্রয়ডারি মেশিনের মাধ্যমে নয়, হাতে করা হয়। আর ফেব্রিকও বেশিরভাগ ইমপোর্টেড।'

নাওয়ার বলেন, এবার কাপ্তান শাড়ি বিক্রিতে তারা বেশ ভালো সাড়া পেয়েছেন।

তিনি জানান, গত ঈদের তুলনায় এবারের ঈদে তাদের বিক্রি প্রায় ৫০ শতাংশ কমেছে। কারণ, দেশের 'বর্তমান পরিস্থিতি' তাদের ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

তিনি বলেন, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী নারী-পুরুষ থেকে শুরু করে কলেজ শিক্ষার্থীরাও তাদের ক্রেতা।

একই এলাকায় আরেকটি ব্র্যান্ড জেকে ফরেন পাঞ্জাবি ও থ্রি-পিস বিক্রি করছে সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকায়। এই দোকানে শাড়ির দাম ৩৫ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকার মধ্যে।

বনানী এলাকার একাধিক দোকানের বিক্রয়কর্মীরা জানান, ঈদকে ঘিরে অনেক ক্রেতা ভারত ও পাকিস্তানি পোশাক পছন্দ করেন। এই চাহিদা মেটাতে ব্র্যান্ডগুলো প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে প্রিমিয়াম পোশাক আমদানি করে মজুত রেখেছিলেন।

২৮ মার্চ বনানী এলাকার অভিজাত ব্র্যান্ডগুলোর বিভিন্ন আউটলেট ঘুরে কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আগে দেশের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতারাই ছিলেন এসব দামি পোশাকের অন্যতম ক্রেতা।

তারা জানান, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দামি পাঞ্জাবিসহ অন্যান্য পোশাকের ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ ক্রেতাই এখন আর নেই। তাই এসব দামি পোশাকের বিক্রি কমে গেছে। বর্তমানে বেশিরভাগ ক্রেতা পাঁচ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকার মধ্যকার পোশাকই পছন্দ করছেন।

আরেকটি ফ্যাশন ব্র্যান্ড আলিফ লিবাস আত্তাকওয়া বনানী শাখার ইনচার্জ শরীফুল ইসলাম বলেন, 'বেশি দামের পেছনে রয়েছে উন্নতমানের কাপড় ও দক্ষ কারিগরের নিপুণ কাজ।'

তিনি বলেন, 'যে পাঞ্জাবির দাম ৮৫ হাজার টাকা, সেটা তৈরি করতে এক মাস সময় লেগেছে। শুধুমাত্র অগ্রিম অর্ডার দিলে এটা তৈরি করা হয়। এর আনুষঙ্গিক সামগ্রী চীন থেকে আনা হয়।'

ছবি: পলাশ খান/স্টার

বনানীর আবায়া অ্যান্ড গাউন ব্র্যান্ডের ম্যানেজার মোহাম্মদ আবু সাঈদ সাদ্দাম জানান, তাদের পণ্যগুলো নিজেরাই তৈরি করেন। তবে কিছু পণ্য দুবাই ও চীন থেকে আমদানি করা হয়।

তিনি বলেন, উচ্চমূল্যের পোশাকগুলো মসলিন কাপড় দিয়ে তৈরি। 'এবার ঈদে বিক্রি বেশ ভালোই হয়েছে।'

একইভাবে, নারীদের জন্য প্রিমিয়াম ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড আজওয়ার ম্যানেজার মো. হাসনাত আলী জানান, দাম মূলত নির্ভর করে কাপড় ও নকশার ওপর।

এক্সক্লুসিভ শাড়ি ও লেহেঙ্গার জন্য তারা অগ্রিম অর্ডার নেন এবং যেকোনো দামের রেঞ্জে তৈরি করতে পারেন। তিনি জানান, এবারের ঈদে পাঁচ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকার পণ্য সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে।

একটি ব্র্যান্ড শপে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মারিয়া হোসেন ক্যাটালগ দেখছিলেন। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'আমার রুচির সঙ্গে মানানসই হওয়ার পাশাপাশি এখানকার পণ্যের মান অনেক ভালো। তাই একটু বেশি দাম দিয়ে হলেও কিনি।'

দেশীয় ব্র্যান্ড কে ক্রাফটের পরিচালক খালিদ মাহমুদ খান বলেন, 'এতো দামের পেছনে অন্যতম একটি কারণ হলো পারসেপশন ভ্যালু। এটা একটা মনস্তাত্ত্বিক বিষয়। এখানে শুধু উৎপাদন খরচ কত সেটা বিষয় নয়।'

তিনি বলেন, 'যদি একজন ব্যবসায়ী হাইভ্যালুতে পণ্য বিক্রয় করতে পারেন, তার মানে ওই ব্যবসায়ী ওই ক্রিয়েটিভিটির ভ্যালুটা ক্রেতার কাছ থেকে নিতে পারছেন।'

তিনি মনে করেন, 'এখানে এমন না যে উৎপাদন খরচ কত আর বিক্রির ভ্যালু কত সেটার মধ্যে সামঞ্জস্য আছে কি না। ওই ব্যবসায়ীরা যদি এটাকে কোনোভাবে ক্রেতার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারেন সেখানে সমস্যা নেই।'

জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কার্যক্রম ও গবেষণাগার বিভাগের পরিচালক ফকির মুহাম্মদ মুনাওয়ার হোসেন বলেন, 'শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা পৃথিবীতেই মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোনো লিগ্যাল ফ্রেম নেই বা বার নেই। তবে বাংলাদেশে শুধু কিছু নিত্যপণ্যের ক্ষেত্রে সরকার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। তবে এটা ব্যতিক্রম।'

কোনো ক্রেতা যদি কোনো পণ্য ক্রয় করার পর মনে করে যে দামের ক্ষেত্রে প্রতারণার শিকার হয়েছেন এবং এ বিষয়ে অভিযোগ করেন, তাহলে ওই ব্র্যান্ড বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।

বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের সদস্য ওয়াজিদ হাসান শাহ বলেন, 'এটা একটা এক্সসেপশনাল মার্কেট এবং হাইলি নিস মার্কেট। সাধারণত নিস মার্কেটে কম্পিটিশন ভেরি লিমিটেড।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, 'যখন কোনো সমাজে বৈষম্য প্রবল হয়ে ওঠে এবং সম্পদ একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির হাতে কেন্দ্রীভূত হয়, তখন তারা নিজেদের আলাদা দেখাতে দামি পণ্যের দিকে ঝোঁকে। এই চাহিদাই এ ধরনের পণ্যের বাজার তৈরি করে। যদি তারা এসব পণ্য স্থানীয়ভাবে না পান, তাহলে বিদেশ থেকে সংগ্রহ করেন।'

তিনি বলেন, 'বাংলাদেশে বিক্রি হওয়া উচ্চমূল্যের পণ্য নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। এই দামগুলো আদৌ ন্যায্য কি না, সেই প্রশ্ন রয়েছে এবং বিক্রেতারা সবসময় এর স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে পারেন না। সরকারের যথাযথ নজরদারির অভাবে কিছু ব্যবসায়ী এর সুযোগ নিচ্ছেন।'

Comments

The Daily Star  | English
AI-manipulated image of Shahbagh engineering students’ protest, DMP claims

Debunking DMP claim, frame by frame

The Daily Star photographer, who was present at the scene, described the incident as it unfolded

4h ago