ভারত-দুবাইয়ের তুলনায় বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম বেশি কেন?

বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম বেড়েই চলেছে। অনেকের প্রশ্ন স্বর্ণের দাম কেন প্রতিবেশী ভারত বা স্বর্ণ বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র দুবাইয়ের তুলনায় বেশি?

বাজার তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে প্রতি ভরি (১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) স্বর্ণ এখন এক হাজার ৪১৪ ডলারে বিক্রি হচ্ছে। ভারতে দাম এক হাজার ১৮৯ ডলার ও দুবাইয়ে এক হাজার ১৩৭ ডলার।

টাকার হিসাবে বাংলাদেশে প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম এক লাখ ৭২ হাজার টাকা। একই পরিমাণ স্বর্ণ টাকার হিসাবে ভারতে এক লাখ ৪৫ হাজার ও দুবাইয়ে এক লাখ ৩৮ হাজার টাকা।

তবে, এই পার্থক্য কোনো সাম্প্রতিক ঘটনা নয়।

এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম বেড়েই চলছে। মূলত চাহিদা-সরবরাহে অসামঞ্জস্যের কারণে এমনটি হচ্ছে।

অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা স্বর্ণের অস্বাভাবিক বেশি দামের পেছনে প্রথম কারণ হিসেবে অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও স্বর্ণের আনুষ্ঠানিক সরবরাহের মধ্যে অসামঞ্জস্যতাকে উল্লেখ করেছেন।

দেশে চাহিদা অনেক থাকলেও স্বর্ণের বৈধ আমদানি প্রায় শূন্যের নিচে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, চোরাচালানের মাধ্যমে আসা স্বর্ণের ওপর বাজার নির্ভর করছে বলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) সহসভাপতি ও মুখপাত্র মাসুদুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের তাঁতি বাজারের ব্যবসায়ীদের নির্ধারিত দাম মেনে স্বর্ণ কিনতে ও বেচতে হয়। কারণ আমরা স্থানীয় বাজার থেকে স্বর্ণ কিনি। যেহেতু আমরা বৈধভাবে আমদানি করা স্বর্ণ কিনতে পারি না।'

'এ জন্য আমরা স্বর্ণের দাম নির্ধারণে আন্তর্জাতিক বাজার মেনে চলতে পারছি না।'

এদিকে স্বর্ণের দামের সমস্যাটি আরও জটিল করে তুলেছে টাকার মান কমে যাওয়া। ২০২২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত টাকার মান প্রায় ৪০ শতাংশ কমেছে।

সর্বকালের সর্বোচ্চ

ফাইল ফটো

গত মঙ্গলবার বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম সর্বকালের সর্বোচ্চ ছিল। প্রতি ভরির দাম বেড়ে হয় এক লাখ ৭৭ হাজার টাকা। গত বুধবার তা কিছুটা কমে হয় এক লাখ ৭২ হাজার টাকা।

বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির বেঁধে দেওয়া দাম ও তা তদারকি সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির বৈঠক শেষে স্বর্ণের দাম ঘোষণা করা হয়। স্থানীয় বাজারে খাঁটি সোনার দাম বেড়েছে বলে বাজুস স্বর্ণের দাম বাড়িয়েছে।

চলতি বছর মাত্র চার মাসের মধ্যে ১৮ বারের মতো সোনার দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে বাজুস। সর্বশেষ ২১ এপ্রিল দেশের বাজারে সোনার দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে সংগঠনটি।

সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, স্বর্ণের দাম নির্ধারণের সিদ্ধান্ত মূলত পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারের ব্যবসায়ীরা নিয়ন্ত্রণ করে।

স্বর্ণ ব্যবসায় জড়িত এক সূত্র ডেইলি স্টারকে জানিয়েছে, কলকাতার ব্যবসায়ীরা সাধারণত দুপুরের দিকে স্বর্ণের দাম নির্ধারণের পর ঢাকার ব্যবসায়ীরা স্থানীয় দর ঘোষণা করেন।

এই দাম খুচরা ক্রেতাদের জন্য নয়, অলঙ্কারের দোকান মালিকদের জন্য। তারা স্থানীয় বাজার থেকে স্বর্ণ কেনেন।

এই খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার স্বর্ণ আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা না দিলেও জুয়েলারি খাত মূলত চোরাচালানের ওপর নির্ভরশীল।

মাসুদুর রহমানের ভাষ্য, বৈধভাবে আমদানি করা স্বর্ণের ওপর উচ্চ করহার এর দাম বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ।

স্বর্ণ আমদানির সময় জুয়েলারি ব্যবসায়ীদের জন্য ভরি প্রতি কর দুই হাজার টাকা, পাঁচ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর। এছাড়া, এর ওপর বিমা খরচও আছে।

আরেকটি বাধা হচ্ছে—ডলার স্বল্পতার কারণে স্বর্ণ আমদানির এলসি খুলতে আগ্রহী হচ্ছে না ব্যাংকগুলো।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, অনেক প্রতিষ্ঠান জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ব্যাগেজ রুলসের ফাঁক-ফোকর দিয়ে চোরাচালানের মাধ্যমে দেশে স্বর্ণ এনে থাকে।

চোরাচালান রোধ ও স্বচ্ছতা বাড়াতে ২০১৮ সালে স্বর্ণ নীতিমালা প্রণয়ন করে সরকার।

পরের বছর বাংলাদেশ ব্যাংক ১৮টি প্রতিষ্ঠান ও একটি ব্যাংককে স্বর্ণ আমদানির অনুমতি দেয়। লাইসেন্সের মেয়াদ ছিল গত মার্চ পর্যন্ত। ২০২০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ১২টি প্রতিষ্ঠানকে মোট ৩০৬ দশমিক ৭৬ কেজি স্বর্ণের বার আমদানির অনুমোদন দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

সেই সময় স্বর্ণ কেনা হয়েছিল মাত্র ১৬০ কিলোগ্রাম, তা বার্ষিক চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট না।

শিল্প সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশে স্বর্ণের চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ চোরাচালানের মাধ্যমে মেটানো হয়। ফলে বিপুল পরিমাণে রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে।

বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম কমেছে

ছবি: সংগৃহীত

গত মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম সর্বকালের সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছানোর পর তা আবার কমেছে।

রয়টার্সের তথ্য বলছে, স্পট গোল্ড দেড় শতাংশ কমে প্রতি আউন্স তিন হাজার ৩৭২ ডলার ৬৮ সেন্ট হয়েছে। ইউএস গোল্ড ফিউচারও শূন্য দশমিক দুই শতাংশ কমে তিন হাজার ৪১৯ ডলার ৪০ সেন্ট হয়েছে।

মার্কিন ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট চীনের সঙ্গে বাণিজ্য উত্তেজনা কমে যেতে পারে—এমন ইঙ্গিত দেওয়ার পর বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম কিছুটা কমেছে।

'দুর্বল নজরদারিতে দাম বাড়ছে'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক রুমানা হক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দেশের বাজারে স্বর্ণ আমদানি, চাহিদা ও সরবরাহ নিয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই।'

'ব্যবসায়ীরা বাজারের চাহিদা সম্পর্কে নিজেদের ধারণার ওপর নির্ভর করে। দামের সিদ্ধান্ত প্রায়ই সরকারি পরিসংখ্যানের পরিবর্তে অনানুষ্ঠানিক ভাবনার ওপর ভিত্তি করে হয়।'

স্বর্ণব্যবসা পরিচালনার পেছনে চোরাচালানকে দায়ী করে তিনি বলেন, 'সরকার কঠোর অবস্থান নিলে সুশাসন ফিরে আসবে এবং আনুষ্ঠানিক বাজার তৈরি হবে।'

ব্যবসায়ীরা দাবি করেন যে, উচ্চহারে কর দেওয়ায় বৈধ আমদানি অলাভজনক হয়েছে।

তবে রুমানা হক একে দুর্বল যুক্তি মন্তব্য করে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তার মতে, 'স্বর্ণ অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নয়। তাই উচ্চ করহার প্রত্যাশিত।'

তিনি মনে করেন, চোরাচালানের কারণে ক্রেতারা উপকৃত হন—বিষয়টি ঠিক না। বাজার অনানুষ্ঠানিক বলেই ব্যবসায়ীরা দাম কম রাখছেন, এমনটিও ঠিক নয়। অনেক ক্ষেত্রে তারা বেশি দাম নিচ্ছেন।

তবে সরকার বর্তমান কর ব্যবস্থা পর্যালোচনা করার কথা বিবেচনা করতে পারে মত দিয়ে তিনি বলেন, 'সরকার প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় করহার পর্যালোচনা করতে পারে। অসঙ্গতি পাওয়া গেলে সে অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।'

বৈশ্বিক পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সময় অনেকে স্বর্ণে বিনিয়োগ করেন। প্রতি বছর স্বর্ণের বিশ্বব্যাপী সরবরাহ প্রায় দুই থেকে তিন শতাংশ বেড়ে যায়। এটি স্বর্ণের দাম আরও বাড়িয়ে দেয়।'

'টাকার মান কমে যাওয়াও স্বর্ণের দাম বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে,' বলেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

What are we building after dismantling the AL regime?

Democracy does not seem to be our focus today. Because if it were, then shouldn’t we have been talking about elections more?

4h ago