চাহিদা কমায় ৩ বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে রডের দাম

রড
স্টার ফাইল ফটো

সরকারের খরচ কমানোর নীতি এবং দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায় নির্মাণখাতে চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে গত তিন বছরেরও বেশি সময় পর প্রথমবারের মতো রডের দাম টনপ্রতি ৯০ হাজার টাকার নিচে নেমে গেছে।

বাংলাদেশ ট্রেডিং করপোরেশনের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, নির্মাণ ও অবকাঠামো প্রকল্পে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হওয়া ৬০-গ্রেড মাইল্ড স্টিল (এমএস) রডের খুচরা দাম আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১২ শতাংশ কমে টনপ্রতি ৮৫ হাজার থেকে ৮৯ হাজার টাকায় নেমেছে গত সপ্তাহে। যেখানে এক বছর আগে এর দাম ছিল ৯৭ হাজার ৫০০ থেকে ৯৯ হাজার ৫০০ টাকা।

এখন রডের দাম ২০২২ সালের ২৩ মার্চের দামের চেয়েও কম। ওই দিন প্রতি টন রডের দাম ছিল ৯১ হাজার ৫০০ টাকা। ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে এই দাম সর্বোচ্চ প্রায় এক লাখ টাকায় পৌঁছেছিল।

বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএমএ) তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আগে দেশে প্রতি মাসে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ টন এমএস রড ব্যবহার হতো। এরপর থেকে চাহিদা কমতে কমতে সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় ৪ লাখ টনে নেমেছে। অর্থাৎ, চাহিদা প্রায় ৩৫ শতাংশ কমেছে।

বিএসএমএ জানিয়েছে, দেশের স্টিলের চাহিদার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই সরকারি বিভিন্ন নির্মাণ প্রকল্প ও বড় প্রকল্পগুলো থেকে আসে। এসব প্রকল্পের কার্যক্রম গত বছরের জুলাই থেকেই ধারাবাহিকভাবে কমছে।

বিএসএমএ মহাসচিব এবং আরআরএম গ্রুপের চেয়ারম্যান সুমন চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত ২৭ জুলাই কয়েক মিনিটের ব্যবধানে নয় শতাংশ দাম কমেছে। এ রকম অস্থির বাজারে ব্যবসা করা খুবই কঠিন।'

তিনি বলেন, 'অভ্যন্তরীণ চাহিদা প্রায় নেই বললেই চলে। শিল্পের জন্য এটা বড় উদ্বেগের বিষয়।'

তিনি উল্লেখ করেন, গত ৪৯ বছরের মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) সবচেয়ে কম বাস্তবায়ন এই মন্দার অন্যতম প্রধান কারণ।

সীমিত ব্যাংকঋণসহ বিভিন্ন কারণে বন্দর স্টিল ও মোহাম্মদী স্টিলের মতো ছোট উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো উৎপাদন স্থগিত রেখেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক মিল টিকে থাকতে পারছে না।'

বর্ষায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে উল্লেখ করে সুমন চৌধুরী বলেন, 'অনেক সরকারি-বেসরকারি নির্মাণ প্রকল্প পানিতে তলিয়ে গেছে।

যার কারণে খুব শিগগির এসব জায়গায় কাজ শুরু করতে পারবে না। অনেক উৎপাদক প্রতিষ্ঠান মাত্র ৮৫ হাজার টাকা বা তারও কম দামে রড বিক্রি করছে শুধু কারখানা সচল রাখতে।'

'আর খুচরা দাম দেখে বাজারের আসল অবস্থা বুঝতেও পারবেন না। মিলগেট মূল্য বাজারের দামের চেয়েও দুই-তিন হাজার টাকা কম। পরিস্থিতি সত্যিই বেশ খারাপ,' যোগ করেন তিনি।

বিএসআরএম-এর উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্তও অভ্যন্তরীণ স্টিল বাজারে চাহিদা ও দামের পতনের কারণে মন্দার বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, 'উৎপাদন স্থিতিশীল। কিন্তু, দামের এই পতন পুরোপুরি চাহিদা-নির্ভর। যখন চাহিদা কমে, তখন দামও কমে—এটাই বাজারের সাধারণ অর্থনীতি।'

তিনি জানান, আগে কোম্পানিগুলো লাভবান থাকলেও এখন অনেকেই বেতন, ঋণের টাকা পরিশোধ ও ইউটিলিটি বিলের মতো খরচ পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে।

তপন সেনগুপ্ত বলেন, 'অনেক কোম্পানি এখন শুধুমাত্র টিকে থাকার জন্য নামমাত্র লাভে রড বিক্রি করছে।'

শিল্পখাতের তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, 'কিছু এলাকায় চাহিদা ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। এটি শুধু মৌসুমি না, গত বছর থেকে চলমান একটানা মন্দা। এর সঙ্গে বর্ষা যোগ হয়ে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।'

তিনি মনে করেন, এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ পুরোপুরি নির্ভর করছে সরকার-নিয়ন্ত্রিত অবকাঠামো প্রকল্প বা নতুন বিনিয়োগ ফেরার ওপর।

জিপিএইচ ইস্পাতের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'সামগ্রিক পরিস্থিতি মোটেই আশাব্যঞ্জক না। নির্মাণখাতে অর্থ পরিশোধের গতি কমেছে এবং বেশিরভাগ বড় প্রকল্প বর্তমানে স্থগিত রয়েছে।'

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা 'অপেক্ষা' করার মনোভাবে রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'এর ফলে শহরাঞ্চলে নির্মাণকাজ ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। বড় প্রকল্পগুলোতে কাজ কমেছে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত।'

তবে গ্রামীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল রয়েছে বলে মনে করেন তিনি। সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ ও ছোট অবকাঠামোগত কাজগুলো এখনও চলছে, যদিও ধীরগতিতে।

তার মতে, গত ছয় সপ্তাহের টানা ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। যার ফলে সরবরাহ চেইন ও উৎপাদন কার্যক্রম আরও চাপের মুখে পড়েছে।

Comments