১৫ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ৩৩,৭৪৪ কোটি টাকা

চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে সাতটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ রেকর্ড ১৫টি ব্যাংক মূলধন ঘাটতির মুখে পড়েছে। ব্যাংকগুলোর এই পরিস্থিতি দেশের আর্থিক খাতের অস্থিরতার আরও একটি ইঙ্গিত।
১৫ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি

চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে সাতটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ রেকর্ড ১৫টি ব্যাংক মূলধন ঘাটতির মুখে পড়েছে। ব্যাংকগুলোর এই পরিস্থিতি দেশের আর্থিক খাতের অস্থিরতার আরও একটি ইঙ্গিত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত ৩০ জুন শেষ হওয়া প্রান্তিকে এই ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি ছিল ৩৩ হাজার ৭৪৪ কোটি, যা ব্যাংকিং খাতে মূলধন ঘাটতির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঘটনা।

এর আগে, ২০২১ সালের শেষ প্রান্তিকে সর্বোচ্চ ৩৪ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতির ঘটনা ঘটেছিল।

ব্যাংকের জন্য আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রক কাঠামো বাসেল থ্রি অনুযায়ী, ন্যূনতম মূলধন পর্যাপ্ততা অনুপাত (সিএআর) ১০ দশমিক ৫ শতাংশ ও অতিরিক্ত ২ দশমিক ৫ শতাংশ সংরক্ষণ বাফার। কিন্তু, এই ১৫টি ব্যাংক ন্যূনতম সিএআর ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট-২০২২ অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন সিএআর বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের। চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংকিং খাতের সিএআর ছিল ১১ দশমিক ১৯ শতাংশ।

চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে বেসিক, অগ্রণী, জনতা, রূপালী, সোনালী, বাংলাদেশ কৃষি, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, ন্যাশনাল, পদ্মা ও আইসিবি ইসলামী ব্যাংক ছাড়াও নতুন চারটি ব্যাংক এই তালিকায় যোগ হয়েছে।

ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের বর্তমান ও সাবেক সভাপতি মাহবুবুল আলম ও ভাইস চেয়ারম্যান জসীমউদ্দিনের তিন বছর বয়সী বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ৮৭ কোটি ৯৩ লাখ টাকা।

একইভাবে সিটিজেনস ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ৯৭ কোটি ১০ লাখ টাকা। এই ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান জাহানারা হক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের মা।

২০২০ সালে এই দুটি ব্যাংককে লাইসেন্স দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। উভয় ব্যাংকই মূলধন ঘাটতির জন্য ১৫ জুন থেকে ন্যূনতম পরিশোধিত মূলধন ৫০০ কোটি টাকা রাখার নতুন বাধ্যবাধকতাকে দায়ী করেছে। এর আগে যা ছিল ৪০০ কোটি টাকা।

বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তারিক মোর্শেদ বলেন, 'আমরা আসলে মূলধন ঘাটতিতে নেই। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক ন্যূনতম পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ বাড়িয়েছে, তাই এই সমস্যা দেখা দিয়েছে।'

বাংলাদেশ ব্যাংক মূলধনের চাহিদা মেটাতে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংকের কার্যত কোনো খেলাপি ঋণ নেই।'

সিটিজেনস ব্যাংকের এমডি ও সিইও মোহাম্মদ মাসুম বলেন, 'বাংলাদেশ ব্যাংক ন্যূনতম মূলধনের বাধ্যবাধকতা বাড়ানোর কারণে এই ঘাটতি দেখা দিয়েছে।'

'এ কারণে এটি আসল মূলধন ঘাটতি নয়। আমাদের ব্যাংককে মূলধন বাড়ানোর জন্য আগামী বছরের জুন পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে। এখন আমাদের মূলধন ৪০৩ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা আমাদের কার্যক্রম শুরুর সময়ের ৪০০ কোটি টাকা থেকে বেড়েছে।'

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ন্যূনতম পরিশোধিত মূলধন বৃদ্ধিতে পাকিস্তানের হাবিব ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের স্থানীয় কার্যক্রমে যথাক্রমে ৩৬ কোটি ৩৩ লাখ টাকা ও ৪২ কোটি ৪৫ লাখ টাকার মূলধন ঘাটতি আছে।

এদিকে ব্যাংকিং খাতে সবচেয়ে বেশি মূলধন ঘাটতিতে আছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের। এই ব্যাংকটির ঘাটতির পরিমাণ ১৫ হাজার ৫৪০ কোটি ৭২ লাখ টাকা।

অগ্রণী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ১২ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ৭৬৭ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।

অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক এমডি মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম বলেন, 'রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সাধারণ মানুষ ও সরকারকে বিনামূল্যে বিপুল সেবা দিয়ে থাকে। এসব ব্যাংক যদি সেবা ফি দাবি চালু করে, তাহলে মূলধন ঘাটতি থাকবে না।'

তিনি আরও বলেন, 'সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি মেটানোর উপায় খুঁজে বের করতে পারে।'

দুর্নীতি ও অনিয়মের শিকার বেসিক ও জনতা ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি বেড়েছে যথাক্রমে ২ হাজার ৩৫২ কোটি ৩৭ লাখ টাকা এবং ২ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা।

জুন শেষে রূপালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল ২ হাজার ২৩০ কোটি টাকা এবং সোনালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল ১০ কোটি ৬১ লাখ টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত বিশেষায়িত রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ঘাটতি ছিল ২ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা।

চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩১৩ কোটি ৮১ লাখ টাকা। বিলুপ্ত ওরিয়েন্টাল ব্যাংক থেকে জন্ম নেওয়া আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের ঘাটতির পরিমাণ ১ হাজার ৮১২ কোটি টাকা।

সংকটে থাকা বেসরকারি ন্যাশনাল ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংকের ঘাটতি ছিল যথাক্রমে ১ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা ও ৪৯৭ কোটি টাকা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সাধারণভাবে বলতে গেলে এই মূলধন ঘাটতির অন্যতম কারণ ঋণ অনিয়ম

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরি বলেন, 'যারা ঋণ অনিয়মের সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংককে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এ খাতের উন্নয়নে তাদের দৃঢ় অঙ্গীকার থাকতে হবে।'

Comments