আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক

আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক

তারল্য সংকটের কারণে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। ২০০৮ সালে ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের নাম পরিবর্তন করে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক করা হয়।

গত সপ্তাহে ব্যাংকটির মৌলভীবাজার শাখার গ্রাহক আব্দুল হামিদ মাহবুব টাকা তুলতে গেলে তাকে কোনো টাকা দেওয়া হয়নি। ওই শাখায় তার এক লাখ টাকা জমা রয়েছে।

শুক্রবার দ্য ডেইলি স্টারকে মাহবুব বলেন, 'মঙ্গলবার আমি ৫৫ হাজার টাকার চেক নিয়ে ব্যাংকে গিয়েছিলাম। কিন্তু, ওই শাখার ম্যানেজার আমাকে বলেন যে তাদের কাছে তখন কোনো টাকা ছিল না।'

ওই দিন মৌলভীবাজার শাখার আরও অন্তত ১৫ জন আমানতকারীর একই অভিজ্ঞতা হয়েছে বলে জানান তিনি।

মাহবুব বলেন, 'দুদিন পর স্থানীয় সাংবাদিকদের সহায়তা নিয়ে ওই শাখা থেকে মাত্র ২০ হাজার টাকা তুলতে পেরেছি।'

একই পরিস্থিতি ঢাকার পল্টন ও কারওয়ান বাজার শাখায়ও। শাখা দুটিতে টাকা তোলার জন্য আসা আমানতকারীদের ফেরত যেতে হচ্ছে খালি হাতেই। ব্যাংকটির নয়াপল্টন শাখায় ২ লাখ টাকা জমা রয়েছে জাকির হোসেনের। বৃহস্পতিবার একটি চেক নিয়ে গেলে তাকে ফেরত আসতে হয় নগদ টাকা ছাড়াই।

তিনি বলেন, 'শাখার ম্যানেজার আমাকে আশ্বস্ত করেছেন যে টাকা তুলতে পারব। কিন্তু, আমার তো মনে হচ্ছে যে ব্যাংকের ভল্ট খালি।'

গুরুতর তারল্য সংকটে পড়ে গত ৩১ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জামানতমুক্ত তারল্য সহায়তা হিসেবে ৫০ কোটি টাকা চেয়েছে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ইতোমধ্যে ব্যাংকটির ৪২৫ কোটি টাকা দেনা রয়েছে বলে আবেদনের দুই সপ্তাহ পরে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের অফ-সাইট সুপারভিশন ডিপার্টমেন্ট ব্যাংকিং রেগুলেশন অ্যান্ড পলিসি ডিপার্টমেন্টকে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের বিরুদ্ধে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিল। কারণ, এটি তারল্য সংকটের কারণে কার্যত বন্ধ রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, 'ব্যাংকটি জমাকৃত আমানত, মূলধনের ঘাটতি, উচ্চ খেলাপি ঋণ এবং তারল্য সংকটের কারণে পদ্ধতিগত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।'

ব্যাংকটি সম্পর্কে অবগত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে জানা যায়, পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ হয়েছে যে ব্যাংকটির কাছে এমন কোনো জামানত নেই, যার বিপরীতে এটি অন্যান্য ইসলামি ব্যাংক বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে নগদ অর্থ ধার করতে পারে। এমনকি ব্যাংকটির কর্মীদের বেতনও ধাপে ধাপে পরিশোধ করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা ব্যাংকটির বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত আছি।' তিনি বলেন, 'ব্যাংকের তহবিলের একটি বড় অংশ কিছু লিজিং কোম্পানির কাছে আটকে আছে, যার কারণে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে।' 'আমরা ব্যাংকের মালয়েশিয়ান শেয়ারহোল্ডারকে নতুন করে তহবিল দিতে বলেছি,' যোগ করেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এই মুখপাত্র জানান, এর আগের মালিকানাধীন কোম্পানি ওরিয়ন গ্রুপ সম্পর্কিত কিছু আইনি জটিলতার কারণে ব্যাংকটির বর্তমান মালিকানা নিয়ে কিছু অস্পষ্টতা রয়েছে। বর্তমানে এর মালিকানা সংক্রান্ত একটি মামলা আদালতে বিচারাধীন।

মেজবাউল বলেন, 'আমরা নিশ্চিত করব, আমানতকারীরা যেন তাদের টাকা ফেরত পান। কিন্তু বর্তমানে ব্যাংকটি হঠাৎ করেই সংকটের সম্মুখীন হয়েছে।' তারল্য সহায়তার জন্য আইসিবির আবেদন প্রত্যাখ্যান করার বিষয়ে তিনি বলেন, 'ব্যাংকটির কাছে কোনো মানসম্পন্ন সিকিউরিটিজ নেই, যে কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের অনুরোধে সাড়া দেয়নি।'

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের শেষের দিকে ব্যাংকটি ১ হাজার ৮২৩ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতে পরে। তাদের মোট ৭৯০ কোটি ৪০ লাখ টাকা ঋণের ৮৭ শতাংশই খারাপ ঋণ। বর্তমানে তাদের ৩৩টি শাখায় ৩৫০ জন কর্মচারী রয়েছে বলে জানান আইসিবি ব্যাংকের কর্মকর্তারা।

আইসিবির একাধিক কর্মকর্তার মতে, বেশ কিছুদিন ধরে ব্যাংকটি কর্মীদের পুরো বেতন দিতেও হিমশিম খাচ্ছে।

ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ শফিক বিন আবদুল্লাহ জানান, তারা আগে কখনো এমন সংকটে পড়েননি। তিনি বলেন, 'সব আমানতকারী একই সময়ে টাকা তুলতে আসছেন। যে কারণে আমরা তাদের টাকা দিতে হিমশিম খাচ্ছি। এ বছর আমরা গ্রাহকদের ৫০ কোটি টাকা পরিশোধ করেছি।'

তিনি আরও বলেন, 'আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে তারল্য সহায়তা চেয়েছিলাম। কিন্তু এখনো পাইনি। কারণ, আমাদের কাছে জামানত হিসেবে কোনো তরল সম্পদ নেই। তবে, আমি আশা করি যে এ মাসের মধ্যে এই সংকট কেটে যাবে।'

২০২২ সালের শেষে ব্যাংকটিতে আমানত ছিল ১ হাজার ২১২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪৪৪ কোটি টাকা ফ্রোজেন ডিপোজিট।

ব্যাংকটি যাত্রা শুরু করে ১৯৮৭ সালে, তখন এটি আল-বারাকা ব্যাংক নামে পরিচালিত হতো। ১৯৯৪ সালে এটি 'সমস্যাযুক্ত ব্যাংকে' পরিণত হয়। তখন ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ত্রুটিযুক্ত ব্যাংকগুলোতে পর্যবেক্ষক নিয়োগের প্রথা চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এরপর ২০০৪ সালে এটি ওরিয়েন্টাল ব্যাংক নামে বাণিজ্যিক ব্যাংক হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে। তবে ব্যাপক অনিয়ম ধরা পড়ার পর ২০০৬ সালের জুনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বিলুপ্ত করে দেয়।

ওরিয়েন্টাল ব্যাংক থেকে আনুমানিক ৩৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০০৫ ও ২০০৬ সালে ৩৪টি মামলা হয়েছিল।

তখন বাংলাদেশ ব্যাংক এটির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং আমানতকারীদের অর্থ সুরক্ষার জন্য ব্যাংকের প্রশাসক হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন নির্বাহী পরিচালককে নিয়োগ দেওয়া হয়।

২০০৭ সালের আগস্টে ব্যাংকটির অধিকাংশ শেয়ার বিক্রির জন্য দরপত্র আহ্বান করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

তখন এশিয়া ও আফ্রিকায় ব্যাংকিং ব্যবসা পরিচালনাকারী সুইস আইসিবি গ্রুপের সঙ্গে দরপত্রে অংশ নেন দুজন দরদাতা। ২০০৮ সালে ব্যাংকটির নাম পরিবর্তন করে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক করা হয়।

Comments

The Daily Star  | English

World bee day: The hum beneath our harvests

In a country where rice paddies stretch endlessly and mustard fields glow golden, the soft hum of bees often fills the air. These tiny creatures -- nature’s most vital workers -- are the quiet pulse beneath our harvests.

13h ago