২০২৪ সালে ১০ ব্যাংকের আমানত কমেছে ২৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা

অলঙ্করণ: আনোয়ার সোহেল/স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স

আর্থিক অনিশ্চয়তার সময়ে আমানতকারীরা সাধারণত তাদের টাকা সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংক থেকে তুলে নিয়ে অপেক্ষাকৃত ভালো ব্যাংকগুলোতে সরিয়ে নেন। ২০২৪ সালেও ঠিক তাই দেখা গিয়েছিল। গতবছর ১০টি ব্যাংক থেকে মোট ২৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা সরিয়ে নিয়েছিলেন আমানতকারীরা।

এই টাকার বেশিরভাগই অন্য ব্যাংকগুলোতে রাখা হয়েছিল। ফলে কিছু ব্যাংকে আমানতের প্রবৃদ্ধি স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমানত বেড়েছে ৩২ শতাংশ পর্যন্ত। এক্ষেত্রে ভালো ব্যাংকগুলোর আমানত বেড়েছে সবচেয়ে বেশি।

যেমন, এক ওষুধ কোম্পানির মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তা জাকির হোসেনের কথাই ধরা যাক।

গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক সংস্কারের পর তিনি আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত শরিয়াহভিত্তিক এক ব্যাংক থেকে তার সঞ্চয় করা কয়েক লাখ টাকা তুলে নিয়ে ভালো ব্যাংকে রাখেন।

এমন কাজ তিনি একাই করেননি। হাজার হাজার আমানতকারী তাদের টাকা আরও ভালো ব্যাংকগুলোয় সরিয়ে নিয়েছেন।

তবে কয়েকটি সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংক তাদের গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হওয়ায় অনেক আমানতকারী টাকা উঠিয়ে নিতে পারেননি। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জরুরি তারল্য সহায়তা দেওয়ায় অবশ্য ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতির উন্নতি হয়।

গত বছর আমানত হারানোর দিক থেকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক। এর আমানত ২০২৩ সালের ৩৫ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা থেকে ১৫ শতাংশ কমে গত বছর ৩০ হাজার ৯২১ কোটি টাকা হয়।

একই অবস্থা ছিল ন্যাশনাল ব্যাংকের। একই সময়ে প্রতিষ্ঠানটির আমানত ৪২ হাজার ৬১০ কোটি টাকা থেকে কমে ৩৬ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকা হয়েছে।

বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের আমানত কমেছে চার হাজার ২৬৪ কোটি টাকা। এটি আগের বছরের তুলনায় ১০ শতাংশ কম।

সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিউজ্জামান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত জুলাইয়ে গণঅভ্যুত্থানের পর বিতর্কিত শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের সঙ্গে ব্যাংকটির সংশ্লিষ্টতা থাকার সংবাদ আসায় করপোরেট ও সাধারণ গ্রাহকরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।'

তিনি আরও বলেন, 'গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে আমানতকারীদের মধ্যে টাকা তুলে নেওয়ার হিড়িক পড়ে। তবে ভালো খবর হলো, এটি নিয়ন্ত্রণে আনা গেছে। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত আমানত প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা কমলেও চলতি বছরের জুন পর্যন্ত তা প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকায় স্থিতিশীল আছে।'

তাদের ব্যাংকে নতুন বোর্ড ও ব্যবস্থাপনা দল কাজ করছে বলেও জানান তিনি।

শফিউজ্জামান আশা করেন, 'এখন নতুন বোর্ড ও ব্যবস্থাপনার ওপর আমানতকারীদের আত্মবিশ্বাস ফিরে আসা উচিত। তবে একটি কথা মনে রাখা উচিত যে যদি সব গ্রাহক তাদের টাকা তুলতে ব্যাংকে হাজির হন তাহলে কোনো ব্যাংকই টিকবে না। গ্রাহকদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সময়মতো ঋণের কিস্তি আদায়ের ওপর মনোযোগ দিচ্ছি। আমাদের সম্পদের শ্রেণিকৃত সম্পদগুলো গুরুতর সমস্যাগ্রস্ত নয়, এবং বেশিরভাগই আদায়যোগ্য। আমার বিশ্বাস, আগামী এক থেকে দুই বছরের মধ্যে আমাদের ব্যাংক ভালো অবস্থানে ফিরবে।'

এমনকি, দেশের সবচেয়ে লাভজনক বিদেশি ব্যাংক স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশের আমানত কমেছে নয় দশমিক ৯৭ শতাংশ। ২০২৪ সালে তা ৩৮ হাজার ১৩৬ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। যদিও এ ব্যাংকটির আমানত কমার কারণ একেবারেই ভিন্ন।

ডেইলি স্টারের এক প্রশ্নের জবাবে ব্যাংকটি বলেছে, আমানত কমে যাওয়ার পেছনে 'কিছু ব্যতিক্রমী ঘটনা' ছিল।

ইমেইলে পাঠানো বিবৃতিতে ব্যাংকটি বলেছে, 'ডলার সংকট সত্ত্বেও আমরা শুধু এয়ারলাইনস শিল্পের জন্য ৬০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছি। এগুলো ও অন্যান্য এককালীন গ্রাহকের রেমিট্যান্স সাময়িকভাবে আমানতের ব্যালেন্সে প্রভাব ফেলেছে। তবে এসব সমন্বয়ের বাইরে আমাদের আমানত প্রবৃদ্ধি প্রায় চার শতাংশ হবে বলে ধারণা করছি।'

২০২৪ সালে এবি ব্যাংকের আমানত আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় নয় দশমিক ৮৭ শতাংশ কমে হয়েছে ৩২ হাজার ২৫৩ কোটি টাকা। বেসিক ব্যাংকে আমানত কমেছে আট শতাংশ।

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক ও জনতা ব্যাংকেরও আমানত কমেছে। এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেশি হওয়ায় মুনাফা 'হারিয়ে' যাচ্ছে।

বিপরীতে, অন্য ব্যাংকগুলো নিজেদের ভালো অবস্থা দেখিয়ে নতুন গ্রাহক ধরার চেষ্টা করেছে।

একই সময়ে ব্র্যাক ব্যাংকের আমানত ৩২ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৭৭ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা। সিটি ব্যাংকের আমানত ৩১ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৫১ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা। যমুনা ব্যাংকের আমানত ২৭ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৩১ হাজার ৪০ কোটি টাকা।

দেশের ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি আমানত রাখা ব্যাংকগুলোর মধ্যে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক ও ট্রাস্ট ব্যাংক ২০ শতাংশের বেশি আমানত প্রবৃদ্ধি নিয়ে ভালো ব্যাংকের তালিকায় আছে। প্রাইম ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক ও ব্যাংক এশিয়ার শেয়ারদর বেড়েছে ১৫ শতাংশের বেশি।

বেশ কয়েকটি নতুন ব্যাংকও ভালো করার কথা জানিয়েছে। গত বছর মিডল্যান্ড ব্যাংক, বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক, মেঘনা ব্যাংক, সিটিজেন ব্যাংক ও সীমান্ত ব্যাংকের আমানত বেড়েছে ২০ শতাংশের বেশি।

এবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী (চলতি দায়িত্ব) জেড এম বাবর খান ডেইলি স্টারকে বলেন, ২০২৩ সালে ব্যাংকের আমানত প্রবৃদ্ধি হয়েছে তিন হাজার ৮০০ কোটি টাকা।

তার ভাষ্য, এই ব্যাংকটিকে 'রেড জোনে' রাখার 'গুজব' ও সম্ভাব্য মার্জারের বিষয়ে কথাবার্তার কারণে ২০২৪ সালে অনেক আমানতকারী এখান থেকে টাকা সরিয়ে নেন।

'ফলে, এবি ব্যাংকের মোট আমানত কমেছে তিন হাজার ১৮৫ কোটি টাকা। পরে রেড জোন নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এর অবস্থান পরিষ্কার করলে আমানতকারীদের আস্থা ফেরে।'

তার মতে, 'দেশের অন্যতম পুরোনো বেসরকারি ব্যাংক হিসেবে আমাদের শক্তিশালী গ্রাহক ভিত্তি আছে। আমরা তাদেরকে গুরুত্ব দিই। আমরা গ্রাহকদের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছি। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা আমানতের বুকিং পেয়েছি।'

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংক থেকে ভালো ব্যাংকগুলোয় টাকা সরিয়ে নেওয়ায় আমানতকারীদের আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে।

গত বছর ব্যাংকগুলোর উচ্চ প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের অধ্যাপক শাহ মো. আহসান হাবীব মনে করেন, 'ভালো ব্যাংকগুলোর প্রবৃদ্ধি স্বাভাবিক ছিল না। মূলত সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংক থেকে গ্রাহকরা টাকা সরিয়ে ভালো ব্যাংকে নিয়ে যাওয়ার কারণে এমনটি হয়েছে।'

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অনেক ব্যাংকের প্রকৃত অবস্থা জানাজানি হয়ে যায়। গ্রাহকরা সুদের হার বিবেচনা না করে তাদের টাকা ভালো ব্যাংকে সরিয়ে নেন।'

'কয়েকটি ব্যাংক ভালো মুনাফা করেছে। কোনো প্রতিষ্ঠান মুনাফা হারিয়েছে। কয়েকটি ব্যাংকের প্রবৃদ্ধি মাঝারি। আস্থা ও সুশাসন এখন যে আগের তুলনায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা ঘটনার মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে।'

Comments

The Daily Star  | English

Economist Barkat held in graft case

Economist Prof Abul Barkat was arrested in the capital last night in a case filed with the Anti-Corruption Commission.

5h ago