আমানতকারীদের টাকা থেকে কর্মীদের বেতন দিচ্ছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পিএলসির আর্থিক অবস্থা এতটাই ভয়াবহ যে, এখন তারা সরাসরি আমানতকারীদের টাকা থেকে কর্মীদের বেতন দিচ্ছে।
এ তথ্য উঠে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক নথিতে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংকটির ঋণ ও বিনিয়োগ থেকে আয় (অপারেটিং ইনকাম) এতটাই কম যে, তা দিয়ে অপারেটিং খরচ তো দূরের কথা বেতনই পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নথি অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির অপারেটিং ইনকাম ঋণাত্মক ৪ হাজার ৩০৮ কোটি টাকা, আর বেতন-ভাতা ব্যয় দাঁড়ায় ৬৫২ কোটি টাকা।
অর্থাৎ কর্মীদের বেতন আমানতকারীদের টাকা থেকে দেওয়া হয়েছে বলে জানায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
নথি অনুযায়ী, গত বছর ব্যাংকটির নেট লোকসান দাঁড়ায় ৫ হাজার ৪৫০ কোটি ১৫ লাখ টাকা এবং মোট অপারেটিং ব্যয় হয় ১ হাজার ৫১ কোটি ৬১ লাখ টাকা।
গত ২৬ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকটির চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়ে জানায়, তাদের পরিদর্শনে ব্যাংকটিতে 'সুশাসনে গুরুতর ব্যর্থতা' ধরা পড়েছে।
চিঠিতে বলা হয়, ভুয়া কাগজপত্র ও ত্রুটিপূর্ণ মূল্যায়নের ভিত্তিতে বিনিয়োগ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে এবং যথাযথ যাচাই-বাছাই করা হয়নি।
ওই চিঠিতে বিতর্কিত এস আলম গ্রুপকে বহু বিনিয়োগের সর্বশেষ উপকারভোগী (ইউবিও) মালিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি তহবিল আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত।
ইউবিও বা 'আলটিমেট বেনিফিশিয়াল ওনার' হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি কোনো প্রতিষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক মালিক না হলেও কার্যত এর নিয়ন্ত্রণ বা মালিকানা ভোগ করেন।
চিঠিতে বলা হয়, ব্যাংকের সুশাসন সংকট মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে—যার মধ্যে রয়েছে নিয়মভঙ্গ, ইসলামী ব্যাংকিং নীতির অপব্যবহার, নথি জালিয়াতি, তহবিল আত্মসাৎ ও প্রভাবশালী স্বার্থগোষ্ঠীর হাতে নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীভূতকরণ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক উল্লেখ করেছে, ঋণ পরিশোধে বারবার সময় বাড়ানোর আবেদন এবং সময়মতো ঋণ নিষ্পত্তিতে ব্যর্থতা ব্যাংকটির গুরুতর তারল্য সংকট তুলে ধরেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ধারাবাহিকভাবে তারল্য ও রিজার্ভের ন্যূনতম মান পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। এ বছরের এপ্রিলে এর তারল্য কভারেজ অনুপাত দাঁড়ায় মাত্র ১০ দশমিক ৫৩ শতাংশে, যেখানে প্রয়োজন ছিল ১০০ শতাংশ।
একটি আন্তর্জাতিক অডিট ফার্মের সম্পদমান পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ব্যাংকটি মারাত্মক মূলধন সংকটে ভুগছে।
গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি দাঁড়ায় ৫৩ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা, আর মূলধন-ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ অনুপাত নেমে যায় ঋণাত্মক ৬০৫ দশমিক ৮০ শতাংশে, যেখানে প্রয়োজনীয় হার ১০ শতাংশ।
ওই পর্যালোচনায় আরও দেখা যায়, ব্যাংকটির ৯৯ দশমিক ৫ শতাংশ বিনিয়োগই খেলাপি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৫৬ হাজার ৮০৫ কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতি দুর্বল ঋণ ব্যবস্থাপনা ও ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণের আরেকটি প্রমাণ।
এসব ফলাফলের ভিত্তিতে ব্যাংকটির টিকে থাকার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, 'আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা, জনআস্থা পুনরুদ্ধার ও আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সর্বোত্তম উপায় হলো অবিলম্বে কৌশলগত নিয়ন্ত্রক হস্তক্ষেপ।' এ প্রসঙ্গে ১৯৯১ সালের ব্যাংক কোম্পানি আইন ও ২০২৫ সালের ব্যাংক রেজোলিউশন অর্ডিন্যান্সের কথা উল্লেখ করা হয়।
সমস্যাগ্রস্ত এই ব্যাংক টিকে আছে ১৫ হাজার ৩৬১ কোটি টাকার জরুরি তারল্য সহায়তার ওপর। এর মধ্যে ১৪ হাজার ৩১১ কোটি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং ১ হাজার ৫০ কোটি টাকা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্যারান্টি অন্যান্য ব্যাংক।
এস আলম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ সাইফুল আলম ছিলেন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান। গত বছর রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর তাকে অপসারণ করে নতুন বোর্ড গঠন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
প্রতারণাকবলিত এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান।
যোগাযোগ করা হলে নতুন এই চেয়ারম্যান বলেন, 'ব্যাংকটির দুরবস্থার পেছনে বিশাল কেলেঙ্কারি ও ঋণ অনিয়ম দায়ী। এখানে প্রকৃত অর্থে কোনো ব্যাংকিং কার্যক্রমই হয়নি।'
তিনি উল্লেখ করেন, পৃথক অডিটে দেখা গেছে—মাত্র একজন ব্যক্তি ব্যাংকের মোট ৬০ হাজার ৯৩৩ কোটি টাকা বিনিয়োগের মধ্যে একাই তুলে নিয়েছেন ৩৮ হাজার কোটি টাকা।
'এটাই ব্যাংকটি ধসের প্রধান কারণগুলোর একটি,' দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন তিনি।
আব্দুল মান্নান আরও বলেন, 'বিনিয়োগের বাকি টাকা গেছে সিকদার গ্রুপ, নাসা গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠানের কাছে। এগুলো ছিল পারস্পরিক সমঝোতা। ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে সুদ মওকুফ পেতো এস আলম; বিনিময়ে এই ব্যাংক থেকে ৩ হাজার কোটি টাক ঋণ নিতো এবং সুদ মওকুফ করে দেওয়া হতো।'
তিনি আরও বলেন, 'কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন নিয়ন্ত্রক হস্তক্ষেপ করতে যাচ্ছে, এবং আমরা এতে একমত।'
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকসহ পাঁচটি সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে ব্যাংকের বোর্ড ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ গতকাল মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর ভার্চুয়ালি ওই বৈঠকে যোগ দেন।
Comments