পিপিপি প্রকল্পে রাষ্ট্রায়ত্ত বস্ত্রকল চালুতে ‘অনিশ্চয়তা’

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলের (বিটিএমসি) আওতাধীন বন্ধ রাষ্ট্রায়ত্ত বস্ত্র কলগুলো সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) কর্মসূচির অধীনে পুনরায় চালু করার উদ্যোগে ‘অনিশ্চয়তা’ দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার দীর্ঘ ৮ বছর পেরিয়ে গেলেও বেসরকারি খাতের আশানুরূপ সাড়া না পাওয়ায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
বস্ত্রকল
নীলফামারীর জেলায় বন্ধ থাকা দারোয়ানী টেক্সটাইল মিল। অবহেলায় পড়ে আছে কারখানার যন্ত্রপাতিগুলো। ছবি: স্টার

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলের (বিটিএমসি) আওতাধীন বন্ধ রাষ্ট্রায়ত্ত বস্ত্র কলগুলো সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) কর্মসূচির অধীনে পুনরায় চালু করার উদ্যোগে 'অনিশ্চয়তা' দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার দীর্ঘ ৮ বছর পেরিয়ে গেলেও বেসরকারি খাতের আশানুরূপ সাড়া না পাওয়ায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

বিটিএমসির আওতাধীন মোট ২৫টি বন্ধ বস্ত্রকল আধুনিকায়ন ও পুনরায় চালু করার বিষয়ে ২০১৪ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় এবং বিটিএমসি-পিপিপি উদ্যোগ নেয়। দীর্ঘদিন ধরে বস্ত্র কলগুলো বিপুল পরিমাণ লোকসান করায় সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।

২৫টি কলের  মধ্যে ৪টি দেশের উত্তরাঞ্চলে হওয়ায় সেগুলো পুনরায় চালু করার বিষয়ে কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে এলাকায় ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছিল।

উত্তরাঞ্চলের সেই বস্ত্র কলগুলো হলো— দারোয়ানী টেক্সটাইল মিল, নীলফামারী; দিনাজপুর টেক্সটাইল মিল; রাজশাহী টেক্সটাইল মিল ও কুড়িগ্রাম টেক্সটাইল মিল।

বস্ত্রকল
কুড়িগ্রাম টেক্সটাইল মিলের বন্ধ প্রধান ফটক। ছবি: স্টার

অর্থনৈতিক বিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটি (কেবিনেট কমিটি ফর ইকোনোমিক অ্যাফেয়ার) ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে প্রথম পর্যায়ে ২৫টির মধ্যে ১৬টি কল পিপিপির অধীনে চালু করার উদ্যোগটির অনুমোদন দেয়।

এই অগ্রগতি সারাদেশে, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে (যেখানে এ ধরনের শিল্পপ্রতিষ্ঠান তুলনামূলক কম) কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও ব্যাপক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সম্ভাবনায় নতুন আশার সঞ্চার করে।

বিটিএমসি সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সংস্থাটির অধীনে বিভিন্ন বস্ত্রকলের আওতায় ৬৩৬ দশমিক ৩৮ একর ভূসম্পত্তি রয়েছে। সেগুলোর রয়েছে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, যেখানে যেকোনো ধরনের শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে খুবই উপযোগী।

অন্যদিকে, বেসরকারি খাতের রয়েছে দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও কর্মশক্তি। সরকার পিপিপির মাধ্যমে বস্ত্রশিল্পের উন্নয়নের স্বার্থে এই ২ খাতকে সংযুক্ত করতে চায় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।

পিপিপির প্রকল্প পরিচালক ও বিটিএমসির বাণিজ্য শাখার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাজী ফিরোজ হোসাইন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বেসরকারি উদ্যোক্তারা অনেকেই জমি কিনতে মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে যখন শিল্প স্থাপনে অগ্রসর হয়, তখন অনেক ক্ষেত্রে অর্থ সংকটে পড়ে যায়। পিপিপি প্রকল্পের অন্যতম অংশীদার হিসেবে বিটিএমসি তাদের জমি বরাদ্দ দিয়ে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে তাদের পাশে দাঁড়াতে চায়।'

পিপিপির বেসরকারি অংশীদাররা সব প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। তারাই কলগুলো পরিচালনা করে উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করবে। ৩০ বছর মেয়াদি এ প্রকল্প ভবিষ্যতে নবায়নযোগ্য।

বস্ত্রকল
উত্তরাঞ্চলের একটি বন্ধ টেক্সটাইল মিল। ছবি: স্টার

কাজী ফিরোজ হোসাইন আরও বলেন, 'চুক্তি অনুযায়ী বেসরকারি অংশীদাররা বরাদ্দ জমিতে বস্ত্রখাত সংশ্লিষ্ট যেকোনো শিল্প যেমন: ডেনিম, কম্পোজিট, তৈরি পোশাকশিল্প, নিটিং, উইভিং ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। কিন্তু, বস্ত্রশিল্পের বাইরে সেখানে কোনোক্রমেই অন্যকোনো কিছু প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ নেই।'

'সবকিছু ঠিকমতো চললে চুক্তিবদ্ধ প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে ৫ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়ে দেশের মোট দেশীয় আয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখার সুযোগ সৃষ্টি হবে', যোগ করেন তিনি।

এ আশাবাদের মধ্যেও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার ৮ বছর পেরিয়ে গেলেও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে তেমন সাড়া না আসায় এখনো অনিশ্চিত পরিস্থিতিই বিরাজ করছে।

দীর্ঘ ৮ বছর ধরে চলমান উদ্যোগে শুধুমাত্র ১টি চুক্তি সম্পাদন করা সম্ভব হয়েছে। যেখানে বেসরকারি উদ্যোক্তা অরিয়ন কনসোর্টিয়াম বিটিএমসির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে টঙ্গীতে অবস্থিত কাদেরিয়া টেক্সটাইল মিলের দায়িত্ব পেয়েছে।

ডেমরায় অবস্থিত আহমেদ বাওয়ানী টেক্সটাইল মিলের জন্য তানজীন ফ্যাশনের সঙ্গে চুক্তি হওয়ার কথা থাকলেও এখনি তা হয়নি।

বিটিএমসি সূত্র জানিয়েছে, দ্বিতীয় পর্যায়ে সংস্থাটি আরও ৪টি বন্ধ বস্ত্রকলের বেসরকারি অংশীদার খুঁজতে সম্প্রতি আরও একটি আন্তর্জাতিক টেন্ডার অত্যাধুনিক ডিজিটাল গেটওয়ে মার্কেটের মাধ্যমে আহ্বান করেছে। সেই ৪টি বস্ত্রকল হলো— চট্টগ্রামের আরআর টেক্সটাইল মিল, ফেনীতে অবস্থিত দোস্ত টেক্সটাইল মিল, মাগুরা টেক্সটাইল মিল ও রাজশাহী টেক্সটাইল মিল।

আগ্রহী পক্ষগুলোকে ২০২২ সালের ৭ মার্চের মধ্যে নিজ নিজ প্রস্তাবনা জমা দেওয়ার আহ্বান জানালেও সাড়া না পাওয়ায় সময়সীমা বাড়িয়ে ১৯ ও ২১ সেপ্টেম্বর করা হয়।

পিপিপি প্রকল্প পরিচালক কাজী ফিরোজ হোসাইন বলেন, 'এ পর্যন্ত কোনো আগ্রহী পক্ষ একটিও শিডিউল কেনেনি। তবে, শিডিউল না কিনলেও অনেকেই গুরুত্বের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিস্তারিত তথ্য চাচ্ছেন।'

এ বিষয়ে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন পিপিপি প্রকল্পের সমালোচনা করে বলেন, 'বন্ধ বস্ত্র কলগুলোর জন্য এটা কোনো দীর্ঘমেয়াদী সমাধান এনে দিতে পারবে না। জটিল কাঠামো চাপিয়ে দেওয়ায় কোনো খ্যাতিমান প্রতিষ্ঠান এতে বিনিয়োগ করতে এগিয়ে আসেনি।'

তিনি বলেন, 'বেশিরভাগ বস্ত্রকলের অবকাঠামোগুলো পরিত্যক্ত কিংবা ব্যবহারঅযোগ্য অবস্থায় আছে। এগুলো ভেঙে ফেলা দরকার।'

তবে কোনো কোম্পানি বা গ্রুপ এ প্রক্রিয়ায় সংযুক্তির জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়ে তা করতে পারে বলে মত ব্যক্ত করেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে সমাজতান্ত্রিক শ্রমিকফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অতীতের সরকারগুলোর ভ্রান্তনীতির কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত কল-কারখানাগুলো দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। এই অশুভ প্রক্রিয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এক শ্রেণীর বেসরকারি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সেগুলোকে দখল করার চেষ্টা করছে।'

তিনি আরও বলেন, 'পিপিপি হলো সরকারি ও বেসরকারি খাতের মধ্যে একটি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা, যেখানে পারস্পরিক স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য কিছু নিয়মকানুন আছে। কিন্তু কিছু লোভী বেসরকারি উদ্যোক্তা সেই সামান্য বিধিনিষেধটুকুও মানতে চান না বলে তারা পিপিপিতে সাড়া দিতে ইচ্ছুক নন।'

'আমরা গভীর পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করে সরকারের কাছে প্রস্তাবনা রেখেছিলাম যে মাত্র ১২০০ কোটি টাকা খরচ করে পাটকলগুলোর পুরাতন যন্ত্রপাতি বদলে নতুন করে উৎপাদন শুরু করা সম্ভব। কিন্তু সরকার আমাদের প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি। বস্ত্র কলগুলোকেও একই প্রক্রিয়ায় পুনর্জীবন দেওয়া  সম্ভব,' বলেন রাজেকুজ্জামান রতন।

বিটিএমসির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সরকার ১২টি রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা টেন্ডারের মাধ্যমে বিক্রি করেছে। ৯টি মিল শ্রমিক ও কর্মচারীদের পরিচালনায় হস্তান্তর করা হয়েছে। ৩০টি কারখানা আগের মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং ৭টি লিকুইডিশান সেলের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়েছে। 

তাদের কাছে শর্ত ছিল যে তারা বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে মিলগুলোর বকেয়া পরিশোধ করবে ও পুনরায় উৎপাদন চালু করবে।

কিন্তু তাদের কেউই চুক্তি অনুযায়ী কাজ করেনি। বরং অনেকে বস্ত্রকলের জমি ব্যাংকে বন্ধক রেখে ঋণ নিয়েছে। আবার কোথাও যন্ত্রপাতি বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে বলেও জানা গেছে।

পরে বাধ্য হয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এরকম ৭টি বস্ত্রকল বেসরকারি খাতের ক্রেতার কাছ থেকে ফিরিয়ে নিয়েছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের কেন্দ্রীয় সভাপতি শহীদুল্লা চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যেহেতু বেসরকারি খাত ব্যর্থ হয়েছে, সে ক্ষেত্রে সরকারকেই রাষ্ট্রায়ত্ত পাট ও বস্ত্র কলগুলোকে আধুনিকায়ন করে উৎপাদনে যেতে হবে।'

যোগাযোগ করা হলে বিটিএমসির চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাকির হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পিপিপি ব্যবস্থা বস্ত্র কলগুলোর জন্য একটি নতুন ধারণা। তাই বেসরকারি উদ্যোক্তাদের এ বিষয়ে কিছু সংশয় থাকা অস্বাভাবিক নয়।'

'এটি বিকশিত হতে কিছু সময় লাগলেও, কলগুলো চালু করার বিষয়ে গভীরভাবে আশাবাদী,' বলেন তিনি।

Comments