মানসম্পন্ন কাঁচামালের অভাব ও উচ্চ শুল্ক আসবাবপত্র শিল্পের প্রধান বাধা

শ্রমিকের প্রাচুর্য, বিনিয়োগ, প্রযুক্তিগত সুবিধা ও বিশ্ববাজারে উচ্চ চাহিদার কারণে আসবাবপত্র শিল্পকে বাংলাদেশের একটি প্রতিশ্রুতিশীল খাত হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
আসবাবপত্র
দেশের আসবাবপত্র শিল্প আমদানি করা কাঁচামালের ওপর নির্ভরশীল। ছবি: সংগৃহীত

শ্রমিকের প্রাচুর্য, বিনিয়োগ, প্রযুক্তিগত সুবিধা ও বিশ্ববাজারে উচ্চ চাহিদার কারণে আসবাবপত্র শিল্পকে বাংলাদেশের একটি প্রতিশ্রুতিশীল খাত হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

তবে এখনো এ শিল্প আমদানি করা কাঁচামালের ওপর নির্ভরশীল।

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমদানিতে উচ্চ শুল্ক ও মানসম্পন্ন কাঁচামালের অভাবে বিদেশে প্রতিযোগিতাপূর্ণ মূল্যে আসবাবপত্র রপ্তানিতে দেশ ব্যর্থ হচ্ছে। এ কারণে এ শিল্প এখনো দেশে আশানুরূপভাবে বিকশিত হয়নি।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, চাহিদা অনুযায়ী মানসম্পন্ন পণ্য সরবরাহ করতে না পারায় শিল্পটি সঠিকভাবে বিকশিত হয়নি।

আসবাবপত্র শিল্পে বিনিয়োগের সম্ভাবনা ও আমদানি করা কাঁচামালের শুল্ক কাঠামো পর্যালোচনার উদ্দেশ্যে বিডার একটি ওয়ার্কিং কমিটি এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে।

আসবাবপত্র খাতের সমস্যা চিহ্নিত করে এ শিল্পে বিনিয়োগ আকৃষ্টের লক্ষ্যে সেগুলো সমাধানের সুপারিশ করারও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।

গতকাল বুধবার বিডা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। এটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোসহ আরও কয়েকটি সরকারি সংস্থার কাছে পাঠানো হয়েছে।

বাংলাদেশে গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল খাতের পরেই আসবাবপত্র খাতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কর্মী নিয়োজিত। প্রায় ২০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান এ খাতে। এ ছাড়া, মোট দেশজ উৎপাদনের বা জিডিপিতে এ খাতের অবদান প্রায় ১ দশমিক ২ শতাংশ।

দেশে ৪০ হাজারের বেশি ছোট-বড় প্রতিষ্ঠান আসবাবপত্র উৎপাদন ও বিপণনের সঙ্গে জড়িত। এদের অধিকাংশই কুটির, মাঝারি বা ক্ষুদ্র শিল্পের আওতায় ব্যবসা করে।

এর বাইরে দেশে হাতিল, আখতার, পারটেক্স, রিগ্যাল, অটবি, ব্রাদার্স, নাভানা ও নাদিয়াসহ শতাধিক ব্র্যান্ডের ফার্নিচার আছে।

বিডার প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের আসবাবপত্রের বাজারের মোট আকার প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। এর ৬৫ শতাংশই নন-ব্র্যান্ডেড।

তবে শুধু নিম্নমানের দেশীয় কাঠে দিয়ে দীর্ঘস্থায়ী ও মানসম্পন্ন আসবাবপত্র তৈরি করা সম্ভব নয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

রপ্তানি বাড়াতে এ খাতে ১৫ শতাংশ নগদ আর্থিক সহায়তা দেওয়ার কথা উল্লেখ করে বিডার প্রতিবেদনে শুল্ক ও করের বিপরীতে এই সহায়তা অপর্যাপ্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

১৯৬৯ সালের শুল্ক আইনে সব শিল্প প্রতিষ্ঠানে বন্ডেড গুদাম সুবিধা দেওয়ার শর্ত আছে। আসবাবপত্র খাত এখনো এই সুবিধা পায়নি। এতে ফার্নিচার শিল্পের জন্য উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়।

একইভাবে, আসবাবপত্র নির্মাতারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল থেকে ঋণ নিতে পারেন না। অথচ এ তহবিল থেকে পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা কাঁচামাল কেনার জন্য স্বল্প সুদে ঋণ নিতে পারেন।

এতে আসবাবপত্র খাতের কাঁচামাল আমদানিতে খরচ বেড়ে যায়।

এছাড়া আসবাবপত্র খাতে দক্ষ জনবলের অভাব আছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, দক্ষ কর্মী তৈরির প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা অপর্যাপ্তের পাশাপাশি দেশে এ শিল্পে গবেষণারও অভাব আছে।

বাংলাদেশেও ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প গড়ে ওঠেনি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, 'এ খাতে যান্ত্রিকীকরণ এবং অটোমেশনের অভাব আছে। এছাড়া ব্র্যান্ডিংয়ের অভাবের পাশাপাশি সরবরাহের ক্ষেত্রে সময়ানুবর্তিতারও অভাব আছে।'

আরও বলা হয়, যদিও আসবাবপত্রের ক্ষেত্রে নকশা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোর একটি, কিন্তু, প্রচলিত নকশা গ্রাহকদের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে পারে না।

আসবাবপত্রের জন্য যখন কাঠের প্রয়োজন, তখন পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি দিনদিন বিশ্বব্যাপী গুরুত্ব পাচ্ছে। আবার রপ্তানির ক্ষেত্রে আসবাবপত্র তৈরিতে ব্যবহৃত কাঠ ও বোর্ডের সার্টিফিকেশন প্রয়োজন।

স্থানীয়ভাবে সার্টিফিকেশন দেওয়ার জন্য যথাযথ পদ্ধতি তৈরি করা যায়নি।

হাতিল ফার্নিচারের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম এইচ রহমান এই প্রতিবেদন তৈরিতে বিডার ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য হিসেবে কাজ করেন।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সরকার রপ্তানি বহুমুখীকরণের কথা বলছে। এই খাত সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।'

'অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বেশ কিছু ব্র্যান্ড ফার্নিচারও রপ্তানি করছে। গত ৬ বছরে রপ্তানি দ্বিগুণের বেশি হয়েছে,' বলেন তিনি।

২০২১-২২ অর্থবছরে বিদেশে ১১০ দশমিক ৩৬ মিলিয়ন ডলারের আসবাবপত্র রপ্তানি হয়েছে, যা ২০১৬-১৭ সালের চেয়ে ৫২ দশমিক ৫৩ মিলিয়ন ডলার বেশি।

রপ্তানি আরও বাড়াতে ১৯টি সুপারিশ করেছে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।

এর মধ্যে আছে, শুল্ক উঠিয়ে নেওয়া বা কমানো, কাঁচামাল আমদানিতে সম্পূরক ও নিয়ন্ত্রক শুল্ক, বন্ডেড গুদাম সুবিধা দেওয়া, সার্টিফিকেশনের মাধ্যমে কাঠের সরবরাহ নিশ্চিত করা, দক্ষ জনবল তৈরি করা এবং সরবরাহের সময় কমানো।

প্রতিবেদনে এ খাতে বিনিয়োগ আকর্ষণে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে।

Comments