প্রথম বেসরকারি সাবমেরিন ক্যাবল

৩ কোম্পানির বিনিয়োগ ১ হাজার কোটি টাকা, সক্ষমতা ৪৫ হাজার জিবিপিএস

বাংলাদেশের প্রথম বেসরকারি সাবমেরিন ক্যাবল নির্মাণে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করছে দেশীয় তিনটি কোম্পানি।
সামিট কমিউনিকেশনস, সিডিনেট কমিউনিকেশনস, মেটাকোর সাবকম লিমিটেড, দেশের প্রথম বেসরকারি সাবমেরিন ক্যাবল, সামিট,
প্রতীকী ছবি/রয়টার্স

বাংলাদেশের প্রথম বেসরকারি সাবমেরিন ক্যাবল নির্মাণে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করছে দেশীয় তিনটি কোম্পানি।

তিন বেসরকারি লাইসেন্সধারী কোম্পানি যথাক্রমে সামিট কমিউনিকেশনস, সিডিনেট কমিউনিকেশনস এবং মেটাকোর সাবকম লিমিটেড এই ক্যাবল স্থাপনে একটি জোট গঠন করেছে। এই ক্যাবলটি ৪৫ হাজার জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ সরবরাহ করতে সক্ষম হবে।

রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত পাইকারি ব্যান্ডউইথ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবলস পিএলসির (বিএসসিপি এলসি) একচেটিয়া আধিপত্য কমাতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাছাড়া বেসরকারি সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে ব্যান্ডউইথ সরবরাহ বাড়বে এবং ইন্টারনেটের দাম কমবে বলে আশা করা হচ্ছে।

সিডিনেট কমিউনিকেশনসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মশিউর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা তিনটি প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে সিঙ্গাপুরভিত্তিক ক্যাম্পানার সঙ্গে একটি চুক্তি করেছি।'

তিনি আরও বলেন, 'সিঙ্গাপুর থেকে তিনি হাজার কিলোমিটার সাবমেরিন ক্যাবলটি বাংলাদেশের কক্সবাজারের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। আর ফাইবার স্থাপনের প্রক্রিয়া দুটি ধাপে পরিচালিত হবে।'

ক্যাম্পানা সিঙ্গাপুর ও মিয়ানমারকে সংযুক্তকারী ১ হাজার ৯০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সিগমার কেবল সিস্টেমের সঙ্গে সংযোগ সরবরাহ করবে। এজন্য তিনটি কোম্পানি প্রায় ৩৫ মিলিয়ন ডলার দেবে এবং ২৫ বছরের জন্য ব্যবহারের সুযোগ পাবে।

দ্বিতীয় ধাপে কক্সবাজার থেকে মিয়ানমারে ফাইবার স্থাপনে সাবমেরিন ক্যাবল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এইচএমএনের সঙ্গে চুক্তি চূড়ান্ত করছে তিন প্রতিষ্ঠানের জোট। এ জন্য তিন প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ৪৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হবে।

মশিউর রহমান বলেন, 'এইচএমএনের সঙ্গে চলতি বছরের ডিসেম্বরে চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে।'

কেবলটিতে তিন জোড়া ফাইবার থাকবে এবং প্রতিটি জোড়ার মাধ্যমে প্রায় ১৫ হাজার জিবিপিএস ডেটা ট্রান্সমিশন ক্ষমতা থাকবে।

ক্যাবলটি সিঙ্গাপুরের তানজং ক্লিংয়ে অবস্থিত টেলিন-৩ নামের একটি ডাটা সেন্টারের সঙ্গে বাংলাদেশকে সংযুক্ত করবে।

বর্তমানে মোট ব্যান্ডউইথের ব্যবহার প্রায় ৫ হাজার জিবিপিএস। এর অর্ধেকেরও বেশি প্রায় ২ হাজার ৭০০ জিবিপিএস আন্তর্জাতিক টেরেস্ট্রিয়াল কেবল (আইটিসি) লাইসেন্সের মাধ্যমে আসে, যা ভারত থেকে স্থলপথে ব্যান্ডউইথ আমদানি করতে ব্যবহৃত হয়।

বাকি ২ হাজার ৩০০ জিবিপিএস সরবরাহ করে বিএসসি পিএলসি, যা দেশকে দুটি সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে সংযুক্ত করেছে।

বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া-মধ্যপ্রাচ্য-পশ্চিম ইউরোপ-৪ (সিমিউই-৪) কনসোর্টিয়ামের সদস্য। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। এটি প্রায় ৮০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ সরবরাহ করে।

বিএসসি পিএলসি সিমিউই-৫ এর মাধ্যমে ১ হাজার ৫০০ জিবিপিএস সরবরাহ করে, এটি ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

প্রতিষ্ঠানটি ২০২৫ সালের মধ্যে তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবল সিমিউই-৬ থেকে ১৩ হাজার ২০০ জিবিপিএস পেতে যাচ্ছে।

এছাড়াও, বিএসসি পিএলসি তাদের প্রথম সাবমেরিন ক্যাবলের সক্ষমতা প্রায় ছয় গুণ বাড়িয়ে ৪ হাজার ৬০০ জিবিপিএস করতে ৩ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে যাচ্ছে।

বিএসসি পিএলসির তৃতীয় ক্যাবল সিমিউই-৬ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৫৫ কোটি টাকা।

মশিউর রহমান মতে, প্রাইভেট ক্যাবলটি বিএসসি পিএলসির তুলনায় কম সময় নেবে, কারণ এটির দূরত্ব যথেষ্ট কম হবে।

বিএসসি পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মির্জা কামাল আহমেদ বলেন, তৃতীয় ক্যাবলটি শুধু সিঙ্গাপুর নয়, সৌদি আরব, মিশর, ফ্রান্স ও ভারতের মতো আরও অনেক দেশকে সংযুক্ত করবে।

'এ কারণেই এটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ব্যয়বহুল হবে,' যোগ করেন তিনি।

এদিকে পাইকারি ব্যান্ডউইথ ব্যবসায় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের একচেটিয়া আধিপত্য থেকে বের হয়ে গত বছরের সেপ্টেম্বরে সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপন, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার লাইসেন্স পায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।

করোনা মহামারির আগে বিএসসি পিএলসি তার সাবমেরিন ক্যাবল দিয়ে ব্যান্ডউইথ সরবরাহে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। কিন্তু, মহামারির কারণে ইন্টারনেটের ব্যবহার কয়েকগুণ বেড়ে যায়, ফলে আইটিসি অপারেটররা ভারত থেকে আরও বেশি ব্যান্ডউইথ আনতে বাধ্য হয়।

ব্যান্ডউইথের সহজলভ্যতা ও রিডান্ডেন্সি নিশ্চিত করতে এবং সাবমেরিন ক্যাবলের রক্ষণাবেক্ষণ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের ঝুঁকি কমাতে বাংলাদেশ ২০১১ সালে প্রথম আইটিসি লাইসেন্স চালু করে।

ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি আমিনুল হাকিম বলেন, জাতীয় স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে ব্যান্ডউইথ সরবরাহ বেশি উপযোগী।

সাবমেরিন ক্যাবলে বিনিয়োগ এককালীন ব্যয়, কিন্তু আইটিসি কোম্পানিগুলোকে প্রতি মাসে ব্যান্ডউইথের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হয়।

মেটাকোর সাবকমের পরিচালক আমিনুল হাকিম বলেন, 'নতুন সরকারি ও বেসরকারি সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপনের পর আইটিসি লাইসেন্স চালু রাখার কোনো যৌক্তিকতা নেই।'

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইটিসি পেমেন্টের বার্ষিক ব্যয় এ বছর ৩০ মিলিয়ন ডলার অতিক্রম করবে।

তবে টেলিকম বিশেষজ্ঞ আবু সাঈদ খান কিছু উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

তিনি বলেছেন, 'ক্যাম্পানা আর্থিকভাবে লাভজনক কোম্পানি নয় এবং এটি এখনো ক্যাবল ব্যবসায় তেমন কোনো সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। এর অন্তর্নিহিত কারণও আছে, এটি সিঙ্গাপুরে অবস্থিত হলেও মিয়ানমারের নাগরিকদের মালিকানাধীন। এই বিষয়টি নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন।'

এলআইআরএন এশিয়ার সিনিয়র পলিসি ফেলো আবু সাঈদ খান বলেন, 'তিনটি কোম্পানি একই ক্যাবল ব্যবহার করবে এবং তাদের সব বিনিয়োগ এক ঝুড়িতেই করছে। এটি খুব বুদ্ধিমান সমাধান নয়। যদি কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে, তবে তিন পক্ষই একসঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই আমি মনে করি এটি একটি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ উদ্যোগ হবে।'

কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা প্রাথমিকভাবে পৃথক ক্যাবল বেছে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু, মার্কিন ডলারের ঘাটতির কারণে তারা পিছু হটেন।

আমিনুল হাকিম বলেন, 'ডলারের বর্তমান দাম বিবেচনায় এটি সম্ভব হবে না। তাছাড়া, আমরা যদি আলাদা ক্যাবল বেছে নিই, তবুও আমাদের একই পথ অনুসরণ করতে হবে। অতএব, একক ক্যাবল বা একাধিক ক্যাবলে সহযোগিতার ক্ষেত্রে একই রকম ঝুঁকি থাকবে।'

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) হিসাব অনুযায়ী, দেশের সব শ্রেণির মানুষ যদি উচ্চগতির ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত হয়, ডিজিটাল প্রবৃদ্ধির গতি অব্যাহত থাকে এবং ফাইভজি চালু হয়, তাহলে ২০২৫ সালের মধ্যে ব্যান্ডউইথের ব্যবহার বেড়ে ৩৪ হাজার জিবিপিএসে উন্নীত হতে পারে।

টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার সম্প্রতি বলেছেন, আগামী সাত বছরে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের ব্যবহার ৬০০ শতাংশ বেড়ে ৩০ হাজার জিবিপিএসে উন্নীত হবে।

Comments