সরকারি চিনিকলে ২৩ বছরে সর্বনিম্ন উৎপাদন

রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলে চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত ২১ হাজার ৩১৩ টন চিনি উত্পাদন হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের উৎপাদন ২৪ হাজার ৫০৯ টন থেকে প্রায় ১৩ শতাংশ কম।
ছবি: স্টার

বাজারে বর্তমানে চিনির দাম কেজিপ্রতি ১৪০ টাকা। অথচ, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) মিলগুলোতে আখের সরবরাহ কমে যাওয়ায় চিনি উৎপাদন ২৩ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলে চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত ২১ হাজার ৩১৩ টন চিনি উত্পাদন হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের উৎপাদন ২৪ হাজার ৫০৯ টন থেকে প্রায় ১৩ শতাংশ কম।

বিএসএফআইসি ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪৮ হাজার টন চিনি উত্পাদন করেছিল। ওই সময়ে লোকসান কমাতে ৬টি মিল বন্ধ করে দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক পর্যালোচনা ২০২২ অনুসারে, ২০২১-২২ অর্থবছরে বিএসএফআইসি ৮৮০ কোটি টাকার লোকসানে রয়েছে। যদিও তা আগের বছরের ১ হাজার ৩৬ কোটি টাকার চেয়ে প্রায় ১৫ শতাংশ কম।

বিএসএফআইসি কর্মকর্তারা বলছেন, মিলের আশেপাশের এলাকায় আখ চাষের জমি দীর্ঘদিন ধরে কমছে। চলতি অর্থবছরে যা ৫০ হাজার একরে পৌঁছেছে। কারণ, ভুট্টা চাষ তুলনা মূলক সহজ ও বেশি লাভজনক হওয়ায় কৃষক আখের বদলে ভুট্টা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।

বিএসএফআইসি চেয়ারম্যান মো. আরিফুর রহমান অপু বলেন, এ কারণে আমরা কৃষকের কাছ থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ আখ পাচ্ছি না।

আন্তর্জাতিক বাজারে রেকর্ড দামের মুখে বেসরকারি খাতের আমদানি কমে যাওয়ায় প্রতিকেজি চিনি রেকর্ড সর্বোচ্চ ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ, এমন সময়েও দেশে চিনির উৎপাদন কমছে।

ট্রেডিং করপোরেশন বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে ঢাকায় খুচরা বাজারে প্রতি কেজি চিনির দাম ৬৬ শতাংশ বেড়েছে।

জানতে চাইলে বিএসএফআইসি চেয়ারম্যান বলেন, বিএসএফআইসি মিলের সরাসরি আমদানির সুযোগ না থাকায় অভ্যন্তরীণ বাজারে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখার মতো পর্যাপ্ত চিনি তাদের কাছে নেই।

বর্তমানে, বিএসএফআইসির কাছে ৯ হাজার ৬৩৩ টন চিনির মজুদ রয়েছে। ডিসেম্বরে মিলগুলোতে নতুন আখ মাড়াই শুরু হওয়ার আগেই এগুলো বাজারে ছাড়া হবে।

মোট মজুতের মধ্যে আগামী জুনের মধ্যে বাজারে ছাড়া হবে মাত্র ১ হাজার ৩০০ টন।

বিএসএফআইসি কর্মকর্তারা বলছেন, তারা ডিলারদের প্রতি কেজি ১০০ টাকা দরে খোলা চিনি সরবরাহ করেন এবং প্যাকেটজাত চিনির দাম প্রতি কেজি ১০৫ টাকা।

তারা সারা দেশে ২ হাজার ৫০০ সক্রিয় ডিলারের মাধ্যমে চিনি বিতরণ করে। প্রতি ডিলার বছরে মাত্র ৫০০ কেজি চিনি পান।

এ ছাড়া, বছরের শুরুতে চিনি পরিশোধনের পরপরই বিএসএফআইসিকে কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানে চিনি সরবরাহ করতে হয়। সরকারি সংস্থাগুলোতে চিনি বিতরণের পরে ডিলারদের সরবরাহের জন্য খুব কমই অবশিষ্ট থাকে বলে জানান তারা।

বিএসএফআইসি স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত আখ থেকে চিনি উৎপাদন করে। ইতোমধ্যে ৫টি বেসরকারি সংস্থা দেশের বার্ষিক প্রায় ২০ লাখ টন চাহিদার সিংহভাগ মেটাতে চিনি আমদানি করে পরিশোধনের পর বাজারজাত করে।

বর্তমানে বিএসএফআইসির অধীনে ১৫টি চিনিকলের মধ্যে মাত্র ৯টি চালু রয়েছে। ক্রমাগত লোকসানে থাকা বাকি ৬টি চিনিকল সরকার ২০২০ সালের ডিসেম্বরে বন্ধ করে দেয়।

বিএসএফআইসি চেয়ারম্যান জানান, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর (বিএটি) সহায়তায় উচ্চ ফলনশীল আখের বীজ সরবরাহ করায় আগামী ২ বছরের মধ্যে চিনির উৎপাদন বাড়বে।

তিনি বলেন, বিএসএফআইসি কৃষকদের উৎসাহিত করার জন্য আখের দাম ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৮০ টাকা করেছে।

বিএসএফআইসি চেয়ারম্যান জানান, তারা প্রতি একর জমি থেকে ৫০ টন আখ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন। বর্তমানে প্রতি একরে সর্বোচ্চ ২০ টন আখ পাওয়া যায়।

'আমাদের মিলগুলোর যন্ত্রপাতি আধুনিকীকরণ করতে হবে' উল্লেখ করে তিনি জানান, রাতারাতি উৎপাদন বাড়ানোর কোনো উপায় না থাকায় আগামী ২ বছর চিনির উৎপাদন কম থাকবে।

বাংলাদেশের বার্ষিক চিনির চাহিদার প্রায় ৯৮ শতাংশ পূরণ হয় আমদানির মাধ্যমে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, প্রতিযোগিতামূলক মূল্য নিশ্চিত করতে হবে, যাতে চিনিকলগুলো টিকে থাকতে পারে।

তিনি বলেন, 'যদি দাম প্রতিযোগিতামূলক করা না যায়, তাহলে এসব মিল বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রতি বছর শত শত কোটি টাকা করদাতার অর্থ থেকে দেওয়ার কোনো মানে হয় না।'

তিনি আরও পরামর্শ দেন, মিলগুলো বেসরকারি খাতে হস্তান্তর করা যেতে পারে কিংবা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের অধীনে চালানো যেতে পারে।

Comments