অর্থবছর নতুন, চ্যালেঞ্জ পুরোনো

‘আগামী মাসগুলোতেও সাধারণ মানুষের কষ্ট থেকেই যাবে’
অর্থনীতি
ফাইল ইলাস্ট্রেশন: বিপ্লব চক্রবর্তী

যখন একটি বছর চলে যায়, তখন যারা ভালো সময় কাটিয়েছেন তারা পরবর্তী বছরটিকেও ভালোভাবে কাটানোর চিন্তা করেন। তবে, যারা সমস্যার মধ্যে আকণ্ঠ নিমজ্জিত তারা চেষ্টা করেন স্বস্তির শ্বাস ফেলতে।

কিন্তু সমস্যায় জর্জরিত মানুষগুলো যখন দেখতে পান যে বিগত বছরের চ্যালেঞ্জগুলো আগামী বছরেও থাকছে তখন তাদের সেই স্বস্তির শ্বাস দীর্ঘ হয় না।

মূল্যস্ফীতি কমার লক্ষণ না থাকায় বেশিরভাগ বাংলাদেশিই সমস্যাক্লিষ্ট মানুষদের দলেই পড়বেন।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সদ্য শুরু হওয়া নতুন অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে। যে যে কারণে উচ্চ মূল্যস্ফীতি যেমন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতা ও দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ এখনো অব্যাহত আছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিস্টিংগুইশড ফেলো মুস্তাফিজুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন '২০২৩-২৪ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির চাপ কিছুটা কমতে পারে। তবে ভোক্তাদের জন্য উল্লেখযোগ্য স্বস্তি নাও থাকতে পারে।' তার মতে, 'নতুন অর্থবছরটি কঠিন হতে যাচ্ছে।'

সাম্প্রতিক মাসগুলোয় বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি গড়ে প্রায় ৯ শতাংশ। অন্যান্য দেশও উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে।

বিশ্বব্যাংকের মতে, বেশিরভাগ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে। ৬৬ দশমিক ৭ শতাংশ নিম্ন আয়ের দেশে মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশের বেশি, ৮১ দশমিক ৪ শতাংশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ ও ৭৭ শতাংশ উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ এই সমস্যায় জর্জরিত। কোনো কোনো দেশে মূল্যস্ফীতি ২ অঙ্কে পৌঁছেছে।

গত সপ্তাহে বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সংস্থা ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্টসের (বিআইএস) মহাব্যবস্থাপক অগাস্টিন কারস্টেনস বলেছিলেন, 'মূল্যস্ফীতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখাই এখন মূল নীতিগত চ্যালেঞ্জ।'

তিনি আরও বলেন, 'এই বোঝা অনেকের কাঁধে পড়ছে। তাত্ক্ষণিকভাবে উদ্যোগ না নেওয়ার ঝুঁকি দীর্ঘমেয়াদে আরও জোরালো হবে।'

বিআইএস'র মতে, সরকারগুলোর উচিত তাদের বাজেটকে আরও সীমিত করা। সবচেয়ে অসহায়দের সহায়তা করা এবং দীর্ঘমেয়াদে তাদের ব্যয়ের সমন্বয় করা।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ব্যালেন্স অব পেমেন্ট সমস্যা, মুদ্রা বিনিময় হারের অস্থিতিশীলতা এবং সুদের হারের সীমাবদ্ধতার কারণে সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে। এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতি দিন দিন মানুষকে নাজেহাল করছে।'

তিনি মনে করেন, আগামী মাসগুলোতেও সাধারণ মানুষের কষ্ট থেকেই যাবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ মুদ্রানীতিতে নিয়ন্ত্রিত বিনিময় হার ও সুদের হার থেকে সরে আসার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। বাস্তবে তা দেখা যাবে কি না বা মুদ্রা বিনিময় ও সুদের হার প্রকৃত অর্থেই বাজারের চাহিদার ওপর নির্ভর করে পরিচালিত হবে কি না তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েই গেছে।

কারণ, ঋণের সুদের হার নির্ধারণের ফর্মুলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রভাব থাকবে বলে মনে করেন সেলিম রায়হান।

একইভাবে, একটি অভিন্ন বিনিময় হার ততক্ষণ পর্যন্ত সম্ভব নাও হতে পারে যতক্ষণ পর্যন্ত রপ্তানিকারক ও রেমিট্যান্স প্রেরণকারীদের প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে।

রপ্তানিকারকরা তাদের রপ্তানির ওপর সর্বনিম্ন ৪ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ প্রণোদনা পান। তাই আমদানিকারকরা ডলার কেনার সময় সর্বদা সুবিধাবঞ্চিত হয়েই থাকবেন।

সেলিম রায়হান মনে করেন, মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের চাহিদার ওপর ছেড়ে দিলে রেমিট্যান্সে আড়াই শতাংশ প্রণোদনার প্রয়োজন হবে না।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৬ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এটি অর্জন করা গেলে তা হবে বিশ্বের অন্যতম ও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ।

সরকারের জন্য অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হবে কর ও জিডিপি অনুপাত বাড়ানো। এটি বিশ্বে সর্বনিম্ন। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সরকার নির্ধারিত কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা গত ১১ বছরেও অর্জন করতে পারেনি।

গত এপ্রিলে বিশ্বব্যাংক জানিয়েছিল, রপ্তানি প্রবৃদ্ধি মাঝারি ধরনের হতে পারে বলে।

গত বছর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশের রপ্তানিতে আঘাত হানে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সবচেয়ে বড় উৎসগুলো ধাক্কা খায়। তবে সেখানে মূল্যস্ফীতি কমে যাওয়ায় তা রপ্তানিকারকদের জন্য 'শাপে বর' হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি এর আগের ১২ মাসের তুলনায় গত মে মাসে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়েছে। অন্যদিকে, ইউরোজোনের বার্ষিক মূল্যস্ফীতির হার গত জুনে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি কমে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ হয়েছে।

২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-মে মাসে দেশের রপ্তানি বেড়েছে ৭ দশমিক ১১ শতাংশ, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৩৪ দশমিক ০৯ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রপ্তানি ১০ শতাংশ বাড়তে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

আমদানির জন্য বেশি অর্থ দেওয়া এবং ডলারের বিপরীতে টাকার মান ২৫ শতাংশ কমে যাওয়ার কারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিলে আমদানি কমেছে ১৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এটি ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছিল ৪১ দশমিক ৪০ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি অর্থবছরে ৮ শতাংশ আমদানি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে বাজারে সরকারের হস্তক্ষেপ বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, 'মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কোনো উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ এ বছরের বাজেটে দেখিনি। কিন্তু কোনো উদ্যোগ না নিলে মূল্যস্ফীতি কমবে না।'

'নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির জন্য পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা দিতে হবে। দরিদ্র ও নিম্নআয়ের মানুষের মধ্যে ভর্তুকি মূল্যে এসব পণ্য বিক্রি করতে হবে,' যোগ করেন তিনি।

চলতি অর্থবছরে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা ও যুদ্ধ পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা করেন না সিপিডির মুস্তাফিজুর রহমান। অর্থাৎ, দেশের রপ্তানি মন্দার মুখে পড়তে পারে।

তিনি বলেন, 'কর ও জিডিপির মধ্যে আনুপাতিক হারের উন্নতি এবং বাজেট ঘাটতি কমানো সম্ভব হবে যদি সরকার দৃঢ়ভাবে কাজ করে।'

'সামষ্টিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, খেলাপি ঋণ কমানো এবং ব্যাংকিংখাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে অনেক প্রচেষ্টার প্রয়োজন,' যোগ করেন তিনি।

২০২৩ সালের প্রথম ৩ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা। মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২১ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ ৩ মাস আগের তুলনায় ৯ শতাংশ এবং আগের বছরের তুলনায় ১৬ শতাংশ বেড়েছে।

সিপিডির মুস্তাফিজুর রহমান উল্লেখ করেন যে, সরকার এক বছরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ২৭ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।

তার মতে, এর জন্য আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। কেননা, বেসরকারি বিনিয়োগ বহু বছর ধরে আটকে আছে। তিনি বলেন, 'সব পর্যায়ে সুশাসন থাকতে হবে, প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বাড়াতে হবে এবং জনসেবা নিশ্চিত করতে হবে।'

সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, 'কর-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধি, ব্যাংকিং খাতকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা এবং সরকারি ব্যয় ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা নিশ্চিত করতে ২০২৪ অর্থবছরে সরকার কী উদ্যোগ নেয় তা দেখতে চাই।'

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি সমীর সাত্তার ডেইলি স্টারকে বলেন, উৎপাদনশীলতা বাড়াতে এবং মূল্যস্ফীতির সমস্যা এড়াতে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ এবং সাশ্রয়ী মূল্য নির্ধারণ করা প্রয়োজন।

 

Comments

The Daily Star  | English
Asif Nazrul

CSA must be repealed: Law Adviser Asif Nazrul

Law Adviser Asif Nazrul today said the government will scrap the controversial Cyber Security Act and formulate a new one to ensure citizens’ safety in cyberspace

20m ago