‘ব্যবসা নাই’

কিস্তি দিতে হিমশিম খাচ্ছেন ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোক্তারা
এসএমই

ভৈরবের কমলপুর এলাকায় জুতার বাক্স তৈরির ছোট প্রতিষ্ঠান আছে জাহাঙ্গীর আলমের। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি চালাচ্ছেন তিনি। গত ১২ নভেম্বর ছিল তার ব্যাংক ঋণের সর্বশেষ কিস্তি হিসেবে ১৮ হাজার টাকা পরিশোধের কথা। কিন্তু, শেষ কিস্তি পরিশোধ করতে পারেননি জাহাঙ্গীর।

পরে তিনি ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে কিস্তি পরিশোধের সময় বাড়িয়ে নেন। ব্যাংক তাকে ২০ নভেম্বরের পর্যন্ত সময় দিয়েছিল। কিন্তু, জাহাঙ্গীর আলম ওই সময়ের মধ্যেও কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে পারেননি।

তিনি আবার ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছে নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত সময় বাড়ানোর অনুরোধ করেন। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাকে সময় দিয়েছে, কিন্তু তিনি ওই সময়ের মধ্যে টাকা দিতে পারবেন কি না তা নিয়ে উদ্বিগ্ন।

জাহাঙ্গীর আলম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কিস্তি পরিশোধের জন্য ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বারবার তাগাদা দিচ্ছে। তাই ঋণ করে হলেও এ মাসের মধ্যে শেষ কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। এ ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না।'

২০২২ সালের জানুয়ারিতে তিনি ব্র্যাক ব্যাংকের ভৈরব বাজার শাখা থেকে দুই বছর মেয়াদে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) ক্যাটাগরিতে ছয় লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন।

ফারিয়া বক্স হাউজের মালিক জাহাঙ্গীর আলম আরও বলেন, 'দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে আগে থেকেই ব্যবসা ভালো চলছে না। এর মধ্যে যোগ হয়েছে হরতাল-অবরোধ। এটি পরিস্থিতি আরও কঠিন করে তুলেছে।'

গত ৩১ অক্টোবর অবরোধ শুরু হয়। ইতোমধ্যে ১৪ দিনের অবরোধের কবলে পড়েছে দেশ।

জুতার বিক্রি কমে যাওয়ায় তার ক্রেতারা তার চাহিদা অনুযায়ী বকেয়া শোধ করতে পারছেন না বলে জানান জাহাঙ্গীর।

'গতকাল বাজার ঘুরে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বকেয়া ৩ হাজার টাকা সংগ্রহ করতে পেরেছি। এই টাকা দিয়ে আমি কী করব? শ্রমিকদের মজুরি দেব নাকি পরিবারের খরচ চালাব? নাকি ব্যাংকের কিস্তি শোধ করব?' বলেন তিনি।

শুধু জাহাঙ্গীর আলম নয়, আরও অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সময়মতো ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছেন না।

বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তা ডেইলি স্টারকে জানান, ব্যাংক ঋণের বোঝা এড়াতে তারা বন্ধু-স্বজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে কিস্তি পরিশোধ করছেন।

এসএমই খাতকে দেশের 'লাইফ লাইন' হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই খাতটি দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ২৫ শতাংশ অবদান রাখে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর অর্থনৈতিক শুমারি-২০১৩ অনুসারে, দেশে ৭৮ লাখ আট হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে।

এগুলোর মধ্যে ৮৭ দশমিক ৫২ শতাংশ কুটির, এক দশমিক ৩৩ শতাংশ ক্ষুদ্র, ১০ দশমিক ৯৯ শতাংশ ছোট, শূন্য দশমিক ০৯ শতাংশ মাঝারি ও শূন্য দশমিক ০৭ শতাংশ বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

উদ্যোক্তারা বলছেন, মূল্যস্ফীতির চাপে যখন উৎপাদন খরচ বেড়েছে, তখন দেশে ছোট আকারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বিক্রির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।

তারা বলেছেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়া ও একাধিক সংকটে তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে ক্রেতারা চাহিদার তুলনায় কম পণ্য কিনছেন।

এ ছাড়া, কাঁচামাল ও পরিবহন খরচ বেশি হওয়ায় ছোট ও মাঝারি ব্যবসাগুলোর মুনাফা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। অনেকে শুধু টিকে থাকতে কর্মচারীদের ছাঁটাই করতে বাধ্য হচ্ছেন।

চট্টগ্রামের পূর্ব মাদারবাড়ি এলাকার নুরুল হক মাস্টার লেইনের আবির সুজের মালিক মোহাম্মদ স্বপন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বর্তমানে ব্যবসা খুবই খারাপ যাচ্ছে। ব্যবসা নাই বললেই চলে।'

তিনি আগে প্রতি মাসে তিন থেকে চার লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করতেন। এখন তা কমে অর্ধেকেরও নিচে নেমে এসেছে।

উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় মুনাফা অনেক কমেছে বলে জানান তিনি।

স্বপন আরও বলেন, 'ব্যবসার যে পরিস্থিতি তাতে সময়মতো ঋণ শোধ করা বেশ কষ্টসাধ্য। গত তিন মাস ধরে ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে টাকা ধার করে ব্যাংকের ঋণ শোধ করছি।'

তিনি আরও জানান, পাঁচ মাস আগে চট্টগ্রামের কদমতলির সিটি ব্যাংকের শাখা থেকে ১৮ মাস মেয়াদে চার লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। ঋণের প্রথম দুই কিস্তি কেবল ব্যবসার আয় থেকে দিতে পেরেছেন।

ব্র্যাক ব্যাংক পিএলসির এসএমই প্রধান সৈয়দ আবদুল মোমেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা এখন নির্ধারিত সময়ে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছেন না।'

তিনি আরও বলেন, 'আমরা এ ধরনের উদ্যোক্তাদের সুযোগ দেওয়ার চেষ্টা করছি। তারা যেন একটু বেশি সময় লাগলেও মাসের কিস্তি মাসেই পরিশোধ করতে পারেন।'

তার মতে, ঋণ শোধে যদি তাদের আরও বেশি সময় লাগে, তাহলে সুদ বাড়বে। এটি তাদের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করবে।

আবার যারা সময়মতো ঋণ শোধ করছেন তাদেরও অনেক ধরনের কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন সৈয়দ আবদুল মোমেন।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যখন মানুষের চলাচল ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কমে যায় তখন এর প্রভাব ব্যবসায়ীদের ওপর পড়ে। এর একটি প্রতিফলন হলো এসএমই ব্যবসায়ীদের সময়মতো ঋণ শোধ করতে না পারা।'

এই কারণেই অনেক এসএমই মালিক সময়মতো কিস্তি শোধ করতে পারছেন না বলে মনে করেন তিনি।

তার মতে, 'দেশের এসএমই ব্যবসায়ীরা এই চ্যালেঞ্জের প্রাথমিক পর্যায়ে আছেন। কারণ ব্যাংকগুলো এখনো গ্রাহকদের ঋণ পরিশোধে বাড়তি সময় দিতে পারছে। তাছাড়া ব্যবসায়ীরা অনানুষ্ঠানিক উৎস থেকে এখনো সহযোগিতা পাচ্ছেন।'

তিনি বলেন, 'ব্যবসায়িক অনিশ্চয়তা যখন আরও বাড়বে, তখন ব্যাংক ও অনানুষ্ঠানিক উৎস থেকে এই সহায়তাগুলো তারা আর পাবেন না। তখন তারা উৎপাদন ও ব্যবসার পরিসর কমিয়ে আনবেন।'

'একটি দেশে নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক টানাপোড়ন থাকবে। তবে, স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যতটুকু সম্ভব সচল রাখা যায় সেই উদ্যোগ নিতে হবে। সেজন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে সবকিছু ভেবেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে,' বলেন তিনি।

বর্তমান পরিস্থিতিতে এসএমই খাতের ব্যবসায়ীদের ঋণ পরিশোধের বিষয়টিকে সহনীয় রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।

Comments