৪ প্রতিষ্ঠানের হাতে ভোজ্যতেলের বাজার

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালে প্রায় ২৫ লাখ সাত হাজার টন সয়াবিন ও পাম তেল আমদানি করা হয়। এর ৮০ শতাংশই চার প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে।
ভোজ্যতেল
ভোজ্যতেলের বাজারে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে সরকারের ভূমিকা জরুরি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। ছবি: সংগৃহীত

ক্রমবর্ধমান জনচাহিদা মেটাতে গত দুই দশকে দেশে ভোজ্যতেল শিল্পে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।

ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এক তৃতীয়াংশ কমেছে। কারণ, অনেকে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারেননি। বর্তমানে ভোজ্যতেলের বাজারে ১১ প্রতিষ্ঠান কাজ করছে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাজার মুষ্টিমেয় প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। শীর্ষ ব্যবসায়ীরা পণ্যের দামকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন যা ক্রেতাদের স্বার্থকে প্রভাবিত করে।'

দেশে ১১ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে টিকে গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ ও মেঘনা গ্রুপ আমদানি করা ভোজ্যতেলের বাজারের সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ করছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালে প্রায় ২৫ লাখ সাত হাজার টন সয়াবিন ও পাম তেল আমদানি করা হয়। এর ৮০ শতাংশই এই চার প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে।

মাত্র ১০ বছর আগে এই চার প্রতিষ্ঠান সম্মিলিতভাবে ভোজ্যতেলের চাহিদার প্রায় এক চতুর্থাংশ পূরণ করতো। বাজারে তাদের সম্মিলিত অংশীদারিত্ব এখন তিনগুণ বেড়েছে।

কেন এমন পরিবর্তন?

এর প্রধান কারণ বিশ্ববাজারে দামের অস্থিতিশীলতা।

দেশের অন্যতম বৃহৎ পাইকারি বাজার ঢাকার মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ী গোলাম মাওলা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আন্তর্জাতিক বাজারে দামের অস্থিরতার কারণে লোকসান হওয়ায় অনেকে ভোজ্যতেলের ব্যবসায় টিকে থাকতে পারেননি।'

তবে, এটি পুরো চিত্র না।

মালয়েশিয়ান পাম অয়েল কাউন্সিলের সাবেক আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক এ কে এম ফখরুল আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ভালো মুনাফার আশায় ব্যবসায়ীদের একটি অংশ জমি কিনে তেল পরিশোধন প্ল্যান্ট করতে ব্যাংক ঋণ নিয়েছিলেন।'

'তারা সেই প্রত্যাশিত মুনাফা পাননি, উল্টো ক্ষতির মুখে পড়েছেন,' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'অসুস্থ প্রতিযোগিতাও অনেককে ব্যবসা থেকে সরিয়ে দিয়েছে।'

গত দুই দশকে দেশে ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা দ্বিগুণের বেশি বেড়ে ৩০ লাখ টনে দাঁড়িয়েছে। ২০০৮ ও ২০১২ সালে বিশ্ব বাজারে ভোজ্যতেলের দামের অস্থিরতার কারণে অনেক আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীর ব্যাপক ক্ষতি হয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

বন্দর সুবিধা থাকায় ভোজ্যতেল বাণিজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা ডেইলি স্টারকে জানান, ২০০৭ ও ২০০৮ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমদানি খরচের চেয়ে কম দামে পণ্য বিক্রিতে বাধ্য করলে সমস্যার শুরু হয়। ফলে ৩২ দেশীয় ভোজ্যতেল প্রক্রিয়াজাতকারীর মধ্যে ১৭টি বন্ধ হয়ে যায়।

২০১২ সাল থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে নূরজাহান গ্রুপ, এসএ গ্রুপ, ইলিয়াছ ব্রাদার্স ও মোস্তফা গ্রুপসহ অর্ধ ডজনেরও বেশি প্রধান ভোজ্যতেল প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই শিল্পে বিপর্যয় দেখা দেয়।

ঢাকার মৌলভীবাজারের ভোজ্যতেলের পাইকারি বিক্রেতা আবুল হাশেম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এ শিল্পে প্রচুর পুঁজির প্রয়োজন। আবার ঝুঁকিও অনেক।'

'বিপুল পরিমাণ লোকসান কাটিয়ে উঠতে না পেরে ২০০৮ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে ভোজ্যতেলের ব্যবসা বন্ধ করে দেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী।'

ঋণখেলাপি ও অন্যান্য কারণে আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায় বলে জানান তিনি।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, কয়েকজন আমদানিকারক জমি কিনে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ না করে অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করায় শেষ পর্যন্ত এই শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ভোজ্যতেলের বাজারে টিকে গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, সিটি গ্রুপ ও এস আলম গ্রুপের বড় ভূমিকা আছে। তারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও লাতিন আমেরিকা থেকে আমদানির ওপর বেশ নির্ভরশীল।

বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের সরে যাওয়ার সুযোগে এই প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের অবস্থান শক্ত করে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৬ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বসুন্ধরা মাল্টি ফুড প্রোডাক্টস, স্মাইল ফুড প্রোডাক্টস, সেনা এডিবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ, ডেল্টা এগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজসহ কয়েকটি নতুন প্রতিষ্ঠান বাজারে এলেও তারা এখনো তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি।

হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দেশের বাজার নিয়ন্ত্রণ করলেও অতিরিক্ত মুনাফার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন টি কে গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবুল কালাম।

তিনি বলেন, 'অতিরিক্ত মুনাফার সুযোগ নেই। সরকারের সংস্থাগুলো সার্বক্ষণিক বাজার নজরদারিতে রাখছে।'

'এমনকি, সরকারি নীতির কারণে অনেক বড় প্রতিষ্ঠান বাজার থেকে উধাও হয়ে গেছে' বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

'আমরা খোলা বাজার থেকে তেল কিনি। সেখানে সকালে এক দাম এবং বিকেলে আরেক দাম। কিন্তু নানান সময় সরকার আমাদের নির্ধারিত মূল্যে পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য করে। এর ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান ভোজ্যতেলের ব্যবসা থেকে সরে গেছে,' যোগ করেন মোহাম্মদ আবুল কালাম।

তার পরামর্শ—এসব পণ্যের দাম সরকারের নিয়ন্ত্রণ করা উচিত নয়। বাজার ব্যবস্থার ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত।

শুধু বাংলাদেশেই কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ভোজ্যতেল শিল্পকে নিয়ন্ত্রণ করে, বিষয়টি এমন নয়।

জার্মান পরিসংখ্যান প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টার তথ্য অনুসারে—ভারতের ভোজ্যতেলের বাজারে আদানি উইলমার, পতঞ্জলি ফুডস ও অ্যাগ্রো টেক ফুডসের মতো পুরোনো প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাধান্য আছে।

পাকিস্তানের বাজারের ৭৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে ১১ প্রতিষ্ঠান।

ক্যাব সভাপতির মতে, সব প্রতিষ্ঠান বাজারে অংশীদারিত্ব বাড়ানোর চেষ্টা করলে ক্রেতারাও উপকৃত হবেন।

তিনি মনে করেন, 'তবে প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমঝোতা হলে ক্রেতাদের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে সরকারের ভূমিকা জরুরি।'

Comments