‘এক শ্রেণির মানুষ কেবল রাষ্ট্রকে হাতের মুঠোয় নেয়নি, নিজেরা রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে’

রেহমান সোবহান, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ, বিরূপাক্ষ পাল, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, এমএম আকাশ, খেলাপি ঋণ, সেলিম রায়হান,
রেহমান সোবহান। ফাইল ছবি

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান বলেছেন, বাংলাদেশে এক শ্রেণির মানুষের বিকাশ হয়েছে, যারা শুধু রাষ্ট্রকে হাতের মুঠোয় নেয়নি, নিজেরাই রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে।

গতকাল 'বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের রাজনৈতিক অর্থনীতি' শীর্ষক এক সেমিনারে তিনি বলেন, 'এ বিষয়ে কিছু করা খুব কঠিন হতে যাচ্ছে, কারণ এই শ্রেণিটি এখন আমলাতন্ত্রের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে।'

সমাজ গবেষণা কেন্দ্র এই ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

রেহমান সোবহান বলেন, 'বাংলাদেশ সৃষ্টির সময় আমরা যাকে মধ্যবর্তী শাসনব্যবস্থা হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করেছিলাম, তা এখন পূর্ণাঙ্গ পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। আর শুধু সাধারণ পুঁজিপতিরা নয়, বরং ওই বিশেষ শ্রেণির একটি অংশ সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রকে হাতের মুঠোয় নিয়েছে।'

রেহমান সোবহান কার্যকর সুদহার নিয়েও আলোকপাত করেন।

তিনি বলেন, 'যদি ১০ বা ১৫ বছরের মধ্যে ঋণ পরিশোধ না করা হয়, তাহলে প্রকৃত সুদের হার অনেক কমে যায়। কেউ আসলে তার ঋণ পরিশোধ করছেন কিনা তার উপর নির্ভর করে সুদের হার ব্যাপক অসম।'

তিনি মন্তব্য করেন, খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি সুদহার নির্ধারণে একটি বিকৃতি তৈরি করেছে।

'রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতাই ঋণ দেওয়ার প্রধান মাপকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপনি যদি রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা থেকে একটি শ্রেণিকে ঋণ দেন, তাহলে সেই পৃষ্ঠপোষকতা রাজনৈতিক সম্পদে পরিণত হয়। তখন ঋণ যেন আদায় না হয় তা নিশ্চিত করতে ওই রাজনৈতিক সম্পদ ব্যবহৃত হয়। এতে ওই শ্রেণি আরও ক্ষমতাশীল হয়ে ওঠে।'

এরপর তারা রাজনৈতিক সক্ষমতা ও শক্তি অর্জন করে।

'তারপর একটি মনগড়া পুঁজিবাদী শ্রেণি থেকে পুরোপুরি শক্তিশালী ও সুপ্রতিষ্ঠিত পুঁজিবাদী শ্রেণির বিকাশ হয়। যারা রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে। এখানে ক্রোনিজম একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে ওঠে, কারণ সকল পুঁজিবাদী শ্রেণি প্রভাবশালী হয়ে গড়ে ওঠে। তাদের মধ্যে কিছু আবার অন্যদের চেয়ে বেশি প্রভাবশালী, আর এটাই সমস্যার ধরন।'

কর্টল্যান্ডের স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের অর্থনীতির অধ্যাপক বিরূপাক্ষ পাল বলেন, ধনী ও প্রভাবশালীদের প্রতি রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের শিকার বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত।

'ব্যাংকিং খাত অতি ধনীদের প্রতি রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের মাসুল দিচ্ছে,' বলেন তিনি।

এটি ২০২০ সালের এপ্রিলে আরোপিত সুদের হারের সীমা দিয়ে শুরু হয়েছিল।

'করোনার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক না থাকলেও মহামারির সময় সুদের হারের ঊর্ধ্বসীমা কার্যকর করা হয়। ব্যবসায়ীদের গোপন এজেন্ডা ছিল কার্যকরভাবে শূন্য সুদহারে ঋণ পাওয়া এবং তারা সেটাই করেছে।'

তিনি বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় বেসরকারি বিনিয়োগের নামে ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দেওয়ার ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। অথচ ঋণের হারের ঊর্ধ্বসীমা চালুর পর যুক্তিসঙ্গত কোনো উন্নতির লক্ষণ দেখা যায়নি। বেসরকারি বিনিয়োগ-জিডিপি অনুপাতে তারই প্রতিফলন দেখা গেছে।

'বাংলাদেশ'স ব্যাংকিং সেক্টর: দ্য ইন্টারেস্ট রেট ক্যাপ, অ্যান্ড গভর্নমেন্ট ব্রোয়িং ফ্রম দ্য ব্যাংকিং সেক্টর' শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে তিনি বলেন, 'এটি অতি ধনীদের প্রায় শূন্যের কাছাকাছি প্রকৃত সুদহারে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।'

৯ শতাংশ সুদের হারের সীমা প্রকৃত সুদের হারকে নেতিবাচক করে তোলে এবং শেষ পর্যন্ত তার কিছু প্রভাব পড়েছে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যের আর্থিক হিসাবের ওপর।

বিরূপাক্ষ পাল বলেন, আর্থিক হিসাবে প্রভাব পড়ায় রিজার্ভ সংকট আরও বেড়েছে, অবাধে টাকার দরপতন হয়েছে, আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমেছে।

তিনি আরও বলেন, টাকার অবমূল্যায়নে আমদানি খরচ অনেক বেড়েছে, যা উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে গতিশীল করে।

হ্রাসমান কর-জিডিপি অনুপাত এবং উচ্চাভিলাষী উন্নয়ন ব্যয়- বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকারের সক্ষমতা সংকুচিত করেছে। ফলে সরকার ক্রমবর্ধমান ঋণের চাহিদা অনুযায়ী ব্যাংকগুলোর ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা সীমিত করে ব্যাংকের অর্থ মরিয়াভাবে ব্যবহার করে।

তিনি বলেন, প্রত্যাশিত রাজস্ব আদায় না হওয়া ও প্রত্যক্ষ করের জন্য ধনী অভিজাতদের ওপর চাপ সৃষ্টি না করে রাজনৈতিক দর্শনের কারণে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়া অব্যাহত থাকে।

২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে সরকার ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। এর মধ্যে ৭৯ শতাংশ সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেওয়া।

বিরূপক্ষ পাল বলেন, অর্থনীতিতে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা অর্থ ঢালা হয়, যা মূলত উচ্চ মূল্যস্ফীতি বাড়িয়েছে।

'যেহেতু এই অর্থ বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নেওয়া হয়নি, তাই এটি ব্যাংকগুলোর তারল্য কমানোর পরিবর্তে বরং বৃদ্ধিতে ইন্ধন জুগিয়েছে।'

'এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন ঋণ এর আগে কখনো দেখেনি দেশ।'

'সামগ্রিকভাবে, নীতি সুদহার বাড়ানোর মাধ্যমে সময়োপযোগী আর্থিক কড়াকড়ির অভাব ছিল। এছাড়া ধনীদের ওপর কর বাড়ানো এবং সরকারি ব্যয় কমাতে আর্থিক কঠোরতার নীতি মানা হয়নি, যা দেশের মূল্যস্ফীতি বাড়িয়েছে,' বলেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এমএম আকাশ বলেন, খেলাপি ঋণের পরিমাণ মোট ঋণের ১১ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এর মধ্যে রাইট-অব ঋণ অন্তর্ভুক্ত নেই।

মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা।

'কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। এর সঙ্গে পুনঃতফসিল ও রাইট-অব ঋণ যোগ করলে কার্যত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে চার লাখ কোটি টাকার বেশি,' বলেন তিনি।

তবে খেলাপি ঋণের প্রকৃত হিসাব গোপন করা রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক বলে মন্তব্য করেন তিনি।

'অসাধু ব্যবসায়ী, আমলা ও রাজনীতিবিদদের যোগসাজশে অনাদায়ী ঋণ ইস্যুকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করতে পারে এমন সব প্রতিষ্ঠান দখল করে নিয়েছে।'

তার ভাষ্য, কিছু শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক তাদের মালিকদের কারণে দুর্বল হয়ে পড়ে। তবুও কেন্দ্রীয় ব্যাংক তারল্য সহায়তা দিয়ে সেগুলোকে উদ্ধার করতে চেয়েছিল।

'এটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। সরকার কেন ব্যাংকগুলোকে উদ্ধার করতে চাইল? এগুলোর দুর্বলতার জন্য মালিকরাই দায়ী।'

তিনি পরামর্শ দেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর পদকে সাংবিধানিক পদ করা হোক। বর্তমানে অর্থ মন্ত্রণালয় গভর্নর নিয়োগ দেয়।

'ব্যাংকিং খাতের জন্য দুটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা আছে- ব্যাংকের ওপর অর্থ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ বন্ধ করতে হবে।'

এমএম আকাশ বলেন, 'ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে শীর্ষ ১০০ ঋণখেলাপির তালিকা প্রকাশ করতে হবে।'

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা দরকার।

'কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, রাজনৈতিক এলিটরা কি স্বাধীনতা দিতে ইচ্ছুক? রাজনৈতিক এলিটরা তা চায় না।'

সুদের হারের ঊর্ধ্বসীমা নিয়ে তিনি বলেন, 'সিঙ্গেল ডিজিট ঋণের সুদহার থেকে সবাই লাভবান হয় না। শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট অংশ এতে উপকৃত হয়েছে এবং ঋণের একটি অংশ খেলাপি হয়েছে।'

Comments

The Daily Star  | English

Enforced disappearances: Eight secret detention centres discovered

The commission raised concerns about "attempts to destroy evidence" linked to these secret cells

6h ago