ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কর্মীরা

গত ৪ আগস্ট থেকে ২৭ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় তিন ডজন কারখানা ভাঙচুরের পর লুটপাট ও আগুন দেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন আমাদের সংবাদদাতারা।
ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা
নারায়ণগঞ্জে গাজী গ্রুপের টায়ার কারখানায় হামলা। ছবি: সৌরভ হোসেন সিয়াম/স্টার ফাইল ফটো

চলতি মাসের শুরুতে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর বেশ কয়েকটি কারখানায় ভাঙচুর ও আগুনের ঘটনায় ব্যবসায়ীরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এসব প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার শ্রমিকের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।

গত ৪ আগস্ট থেকে ২৭ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় তিন ডজন কারখানা ভাঙচুরের পর লুটপাট ও আগুন দেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন আমাদের সংবাদদাতারা।

যেসব কারখানা ভাঙচুর করা হয়েছে সেগুলোর বেশিরভাগের মালিক তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন। ছাত্র-জনতার প্রাণঘাতী আন্দোলনে আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসন শেষ হয়। গত ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সরকার পতনের পর আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়লে যেসব ভাঙচুর ও আগুনের ঘটনা ঘটে। ব্যবসায়ী নেতারা একে নজিরবিহীন বলে মন্তব্য করেছেন।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অতীতে সরকার পরিবর্তনের পর অনেক প্রতিহিংসার ঘটনা দেখেছি। তবে এবারের ঘটনা সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে।'

'অতীতে শিল্প কারখানায় এ ধরনের হামলা, আগুন ও লুটপাট দেখিনি,' যোগ করেন তিনি।

উদাহরণ হিসেবে সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর মালিকানাধীন গাজী গ্রুপের কথাই ধরা যাক। নারায়ণগঞ্জে গাজী অটো টায়ার্স ও গাজী পাইপে হামলা, লুটপাট ও আগুনের ঘটনা ঘটেছে।

গত ৫ থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত জেলার রূপগঞ্জ উপজেলায় দুটি কারখানাকে লক্ষ্য করে হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। এরপর গত ২৫-২৬ আগস্ট গাজী অটো টায়ারে আবারও আগুন দেওয়া হয়।

গত ২৫ আগস্ট এফবিসিসিআইকে চিঠির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, হামলায় প্রায় এক হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে।

ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা
রাজনৈতিক হামলার শিকার কারখানা। ছবি: সৌরভ হোসেন সিয়াম/স্টার ফাইল ফটো

এতে আরও বলা হয়, 'আগুনের কারণে আমাদের কারখানা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। প্রায় দুই হাজার ৬৫০ কর্মকর্তা-কর্মচারী এখন বেকার। এই কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা খুবই কঠিন।'

অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন বলেও চিঠিতে জানানো হয়েছে।

এতে বলা হয়, 'যদি উৎপাদন আবার শুরু না করতে পারি তাহলে বাজারে স্থানীয়ভাবে উত্পাদিত টায়ার-টিউব ও অন্যান্য পণ্যের ঘাটতি হবে।'

গাজী অটো টায়ারের ব্যবস্থাপক মো. আশরাফুল আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কারখানাটি ধ্বংস হয়ে গেছে। আমরা অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি। এ মাসের বেতন দেওয়া হলেও আগামী মাসে কী হবে বলতে পারছি না।'

সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার বাসিন্দা আশরাফুল আলম তার সাত সদস্যের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা রাজনীতি করি না। আমরা কেন হামলার শিকার হব? আমরা এখানে শুধু কাজ করতে এসেছি।'

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গাজী পাইপের এক কর্মচারী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিপদে পড়েছি। নতুন চাকরি খুঁজতে হবে। এমন অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে চাকরি পাওয়া খুব কঠিন।'

গাজী টায়ারসের সহকারী মহাব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলামের অভিযোগ, 'হামলার সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ডাকা হলেও তারা সহযোগিতা করেনি। পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে ডাকা হলে সেনাদের একটি দল কারখানার গেটের সামনে আসে। কিন্তু ১০ মিনিট পর তারা চলে যায়।'

পুলিশের পক্ষ থেকে এ অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ-আড়াইহাজার সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা কারখানার নিরাপত্তা দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি।'

আমাদের নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, গত ১৯ জুলাই থেকে ২৫ আগস্ট পর্যন্ত ফতুল্লার ফকির গার্মেন্টস, কুতুবপুরের ইউরোটেক্স ও ভারটেক্স, বিসিক শিল্পনগরীর এমবি নিট ফ্যাশন লিমিটেড ও সোনারগাঁওয়ের একটি প্লাস্টিক রিসাইক্লিং কারখানায় ভাঙচুর, লুটপাট ও আগুনের ঘটনা ঘটে।

এমন ঘটনা আরও অনেক আছে।

গত ৪ আগস্ট গাজীপুরে বেঙ্গল পলিমার ওয়্যারস, বেঙ্গল পলিমার ওয়্যারস, বেঙ্গল পলি অ্যান্ড পেপার স্যাক লিমিটেড ও বেঙ্গল ফ্লেক্সিপ্যাক লিমিটেডসহ বেঙ্গল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের সব প্রতিষ্ঠানে দুর্বৃত্তরা হামলা চালিয়েছে।

গত ১৯ আগস্ট এফবিসিসিআইকে চিঠিতে বেঙ্গল গ্রুপ জানায়, হামলায় প্রায় ৪৬২ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

একই দিন আশুলিয়ায় সিনহা টেক্সটাইলসহ বেশ কয়েকটি পোশাক কারখানায় আগুনের ঘটনা ঘটে।

ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা
হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত কারখানা। ছবি: সৌরভ হোসেন সিয়াম/স্টার ফাইল ফটো

এর মধ্যে আরও আছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্পবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো সিনথেটিক। এটি বেক্সিমকো গ্রুপের অন্যতম লাভজনক প্রতিষ্ঠান।

হা-মীম গ্রুপের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, আশুলিয়ায় তাদের গোডাউনে আগুন দেওয়া হলে ৫০-৬০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়।

আশুলিয়ার এনায়েতপুর এলাকায় ১৬ ঝুট (গার্মেন্টস বর্জ্য) গুদামে আগুন দেওয়া হয়। এর মধ্যে ১০টিই ঢাকা-১৯ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলামের।

তার এক আত্মীয় নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ক্ষতির পরিমাণ অন্তত ৫০ কোটি টাকা।'

সাবেক শিল্প প্রতিমন্ত্রী ও ঢাকা-১৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য কামাল আহমেদ মজুমদারের মালিকানাধীন এসএস এগ্রো কমপ্লেক্সেও হামলা হয়েছে।

ধামরাইয়ের বারাকৈর এলাকায় গত ৫ আগস্ট থেকে টানা তিন দিন লুটপাট চালিয়ে প্রায় ৫০ কোটি টাকার পাঁচ শতাধিক গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ, হরিণ, পাখি, হাঁস, মাছ ও অন্যান্য কৃষি যন্ত্রপাতি চুরি করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।

'এ ধরনের হামলা অগ্রহণযোগ্য' উল্লেখ করে মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি কামরান টি রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শিল্প প্রতিষ্ঠান জাতীয় সম্পদ। কারখানার ক্ষতি হলে দেশের ক্ষতি। এটা হওয়া কোনোভাবেই উচিত না। এ ধরনের ঘটনা শত শত মানুষের জীবন ও জীবিকা নষ্ট করে।'

এ ধরনের ঘটনায় বেকারত্ব বাড়বে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, 'এসব ঘটনার কারণে বিদেশি বিনিয়োগও এটি ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।'

তার মতে, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত তারা বিনিয়োগ করতে আসবেন না।

'সরকারকে অবশ্যই কলকারখানা ও শিল্পস্থাপনার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। এটা আমাদের সাংবিধানিক অধিকার। আইনশৃঙ্খলা পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা করতে হবে,' যোগ করেন তিনি।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আশরাফ আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দুর্বৃত্তদের ভাঙচুর থেকে আমাদের শিল্পকে রক্ষা করতে না পারলে ব্যবসা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা সম্ভব নয়।'

কারখানা, মানুষের জানমাল ও সামগ্রিক অর্থনীতি রক্ষায় দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।

এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ভালো প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে লাভ নেই। এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়। আখেরে দেশেরই ক্ষতি। বেকারত্ব বাড়বে।'

বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আগুন-লুটপাট হলে তা ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের জন্যই ক্ষতি। প্রতিষ্ঠানটি ব্যক্তি মালিকানাধীন হলেও তা দেশের সম্পদ। এটি নষ্ট করলে সমস্যার সমাধান হবে না।'

হামলার ফলে বেকারত্ব বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি। বলেন, 'কারখানায় নিরাপত্তা বাড়ানোর বিষয়ে সেনাপ্রধানের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা আশ্বস্ত করেছেন যে নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।'

শিল্প পুলিশের এক পদস্থ কর্মকর্তা ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, তাদের কাছে গত ৪ থেকে ১৫ অগাস্ট পর্যন্ত আগুন ও লুটপাটের তথ্য নেই। কারণ সে সময় তাদের কোনো কার্যক্রম ছিল না। তবে গত ১৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত তিনটি কারখানাতে আগুন ও দুটি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে বলে তারা জানিয়েছেন।

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন সৌরভ হোসেন সিয়াম ও আকলাকুর রহমান আকাশ)

Comments

The Daily Star  | English

Mia, wife concealed assets in tax returns

When Asaduzzaman Mia retired as the longest-serving Dhaka Metropolitan Police commissioner in 2019, by his own admission, he went home with about Tk 1.75 crore in service benefits. But that does not give a true picture of his wealth accumulation. Fact is, the career cop and his family became muc

27m ago