অর্থপাচারে নজরুল ইসলাম মজুমদারের সম্পৃক্ততা পেয়েছে বিএফআইইউ

ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের অভিযোগ তুলেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
এ ছাড়া কয়েকটি ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে ১৬ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি।
অর্থপাচার, সন্দেহজনক লেনদেন ও নগদ লেনদেনের প্রতিবেদন তদন্তের দায়িত্বে থাকা সরকারি সংস্থা বিএফআইইউর তথ্য বলছে—২০০৭ সাল থেকে গত বছরের ২৯ আগস্ট পর্যন্ত এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় নজরুল ইসলাম মজুমদার সেই ব্যাংক থেকে ১৮টি ভুয়া প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে চার হাজার ৭১৭ কোটি টাকা বের করে নেন।
বাকি ১১ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা নেওয়া হয়েছে ২০টি ব্যাংক ও একটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে।
নজরুল ইসলাম মজুমদারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে এক্সিম ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক ও রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকে আমদানি-রপ্তানি লেনদেনের মাধ্যমে অর্থপাচার ও ঋণ অনিয়ম পেয়েছে বিএফআইইউ।
সংস্থাটির প্রতিবেদনে মজুমদারের জামাতা মোজাম্মেল হোসেনের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান মদিনা ডেটস অ্যান্ড নাটসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বাণিজ্য অনিয়মের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
২০২০ সালের জুলাইয়ে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানটি ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ২৫৩টি আমদানিপত্র (এলসি) খুলেছে। এর পরিমাণ ৪৬ দশমিক তিন মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে পাঁচ দশমিক ৬৩ মিলিয়ন ডলারের ২৩টি এলসি বাতিল করা হয়েছে।
বিএফআইইউ প্রতিবেদন আরও বলছে, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিষ্ঠান জেস্ট ফ্রুট থেকে প্রতি কেজি সাড়ে সাত ডলার (৭৭৫ টাকা) দরে ৩২ হাজার কেজি কমলা আমদানি করা হয়েছে।
তবে ওই সময় আন্তর্জাতিক বাজারে এর দর ছিল প্রতি কেজি ১০০ থেকে ২০০ টাকা। স্থানীয় বাজারে দাম ছিল ২৫০ থেকে ৪০০ টাকা। এ থেকে ওভার ইনভয়েসিং ও সম্ভাব্য অর্থপাচারের বিষয়টি বোঝা যায়।
একইভাবে ২০২৩ সালের এপ্রিলে ট্রেড লাইসেন্স পেয়েছে ফ্লেমিংগো এন্টারপ্রাইজ নামের আরেক প্রতিষ্ঠান। এটি মোশাররফ হোসেনের মালিকানাধীন বলে প্রাতিষ্ঠানিক রেকর্ড থেকে জানা যায়। তবে এর ব্যবসায়িক ঠিকানার সঙ্গে নাসা গ্রুপের প্রধান কার্যালয়ের মিল আছে।
২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি ৬৮ দশমিক চার মিলিয়ন ডলারের ৫৯টি আমদানি এলসি খুলেছে।
লেনদেন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বাংলাদেশি নাগরিক মোহাম্মদ আব্দুর রশিদের মালিকানাধীন দুবাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আবদুর রশিদ জেনারেল ট্রেডিংয়ের অনুকূলে তিন দশমিক ৫০ মিলিয়ন ডলারের ১৩টি এলসি ইস্যু করা হয়।
একটি সন্দেহজনক লেনদেনের মধ্যে আছে প্রতি কেজি ৭০ সেন্টে (৭৭ টাকা) সাড়ে ছয় লাখ কেজি খেজুর আমদানি। আন্তর্জাতিক বাজারদর ২০০ টাকা কেজির তুলনায় অনেক কম।
এর ফলে আন্ডার ইনভয়েসিং নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। ফলে বিদেশে টাকা পাচারের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে বলে বিএফআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
নজরুল ইসলাম মজুমদারের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ফিরোজা গার্মেন্টসের রপ্তানি বাণিজ্যে অনিয়ম পেয়েছে বিএফআইইউ।
২০১২ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি এক দশমিক দুই বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি এলসি অর্ডার পেয়েছে। এক দশমিক দুই বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি বিল ফেরত আনা হলেও ১৩৯টি আমদানি এলসি থেকে মোট ১১ দশমিক ৫৫ মিলিয়ন ডলারের তহবিল ফেরত আসেনি।
অর্থপাচার প্রতিরোধ আইন-২০১২ অনুসারে পুনঃপ্রবাসনযোগ্য টাকা ফেরত আনতে ব্যর্থতা অর্থপাচার হিসেবে গণ্য হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মজুমদার ও ফিরোজা গার্মেন্টস রপ্তানির আড়ালে বিদেশে টাকা পাচার করে থাকতে পারে।
ন্যাশনাল ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা শাহজাহান কবিরের সঙ্গে ১৯৯৯ সালে এক্সিম ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা নজরুল ইসলাম মজুমদার ১৮টি ভুয়া প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এক্সিম ব্যাংক থেকে চার হাজার ৭১৭ কোটি টাকা বের করে নিয়েছেন।
বিএফআইইউর প্রতিবেদন অনুসারে, নজরুল ইসলাম মজুমদারের স্ত্রী নাসরিন ইসলাম ব্যাংকটির অন্যতম পরিচালক। শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকটি মাত্র ৪৮৬ কোটি ৪৩ লাখ টাকা সমমূল্যের জামানত থাকা সত্ত্বেও ঋণ অনুমোদন করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, কোনো ব্যাংকের পরিচালক তার নিজ ব্যাংকে শেয়ারের ৫০ শতাংশের বেশি ঋণ নিতে পারবেন না।
সেই বিধিনিষেধ এড়াতে নজরুল ইসলাম মজুমদারসহ বেশ কয়েকজন পরিচালক ভুয়া প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের টাকা তুলে নেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
এ ধরনের দুটি প্রতিষ্ঠান ফ্লেমিংগো এন্টারপ্রাইজ ও মদিনা ডেটস অ্যান্ড নাটস প্রতিষ্ঠার পরপরই মোটা অঙ্কের ঋণ পায়।
এক্সিম ব্যাংক যথাযথ জামানত ছাড়াই প্রতিষ্ঠান খোলার কয়েক মাসের মধ্যে একটি অ্যাকাউন্টে ২৭০ কোটি টাকার ঋণ মঞ্জুর করেছেন। নজরুল ইসলাম মজুমদার ও তার স্ত্রী ২০২২ সালের নভেম্বরে তাদের শেয়ারের একটি অংশ তাদের সন্তান ওয়ালিদ ইবনে ইসলাম ও আনিকা ইসলামকে স্থানান্তর করার পর ছয় শতাংশ শেয়ার তাদের নামে আছে।
নাসা স্পিনার্স গার্মেন্টস, নাসা হাই-টেক ওয়াশ ও নাসা বেসিকসহ নাসা গ্রুপের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে এই টাকা দেওয়া হয়।
এক্সিম ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নাসা গ্রুপের কর্মকর্তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু টাকা জমি কেনায় ব্যবহার করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
এক্সিম ব্যাংক ছাড়াও নজরুল ইসলাম মজুমদার ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো ২০ ব্যাংক ও এক ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ১১ হাজার ১০৪ কোটি ৭১ লাখ টাকা অর্থায়ন ও নন-ফান্ডেড ঋণ সুবিধা পেয়েছে।
এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক থেকে দুই হাজার ৬২০ কোটি টাকা, ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে এক হাজার ৯৩৮ কোটি টাকা, আইএফআইসি থেকে এক হাজার ২৪১ কোটি টাকা, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক থেকে ৭৫৭ কোটি টাকা, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে ২৯৫ কোটি ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে ৮৩৬ কোটি টাকা নেওয়া হয়েছে।
এই ১১ হাজার ১০৪ কেটি ৭১ লাখ টাকা ঋণে বিএফআইইউর প্রতিবেদনে অনিয়মের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ না থাকলেও ব্যাংকিং খাতজুড়ে নজরুল ইসলাম মজুমদারের বিশাল অঙ্কের লেনদেনের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কীভাবে নজরুল ইসলাম মজুমদার এর প্রভাব-প্রতিপত্তিকে কাজে লাগিয়ে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে তার ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যকে ব্যবহার করে লাভবান হয়েছেন।
নজরুল ইসলাম মজুমদার ১৭ বছর ধরে বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের ফোরাম বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের চেয়ারম্যান ছিলেন। এ পদে থেকে তিনি আওয়ামী লীগের ১৫ বছর শাসনামলে অনেক সুবিধা আদায় করেছেন।
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পর বিএফআইইউ নজরুল ইসলাম মজুমদার ও তার পরিবারের ব্যাংক হিসাব জব্দের আদেশ দেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নজরুল ইসলাম মজুমদার ও তার স্ত্রীকে বোর্ড থেকে বাদ দিয়ে এক্সিম ব্যাংকের জন্য পাঁচ সদস্যের নতুন বোর্ড গঠন করে।
এ ছাড়াও, এক্সিম ব্যাংকের সম্পদের মান যাচাইয়ে আন্তর্জাতিক হিসাব প্রতিষ্ঠান আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ং ব্যাংকটির ফরেনসিক অডিট করে।
তদন্তের অংশ হিসেবে এক্সিম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ ফিরোজ হোসেনকে তিন মাসের ছুটিতে পাঠানো হয়।
ভারপ্রাপ্ত এমডি মো. আখতার হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, তিনি সম্প্রতি ব্যাংকে যোগ দেওয়ায় বিএফআইইউর অনুসন্ধান সম্পর্কে জানতেন না।
নাসা গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান রঞ্জন চৌধুরী অর্থপাচার ও আর্থিক অসদাচরণের সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, দাবিগুলো ভিত্তিহীন। এগুলোর তথ্যগত বা আইনি ভিত্তি নেই।
তিনি আরও বলেন, 'নাসা গ্রুপ সবসময় বিএফআইইউর নিয়মকানুন মেনে চলে। প্রয়োজনে যেকোনো তথ্য সরবরাহ করে।'
রঞ্জন চৌধুরী আরও বলেন, 'এখানে কোনো ধরনের অনিয়ম হয়নি। ভুয়া প্রতিষ্ঠানের অভিযোগ ঠিক নয়।'
জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের সময় একটি হত্যা মামলায় গত বছরের অক্টোবরে গ্রেপ্তার হওয়া নজরুল ইসলাম মজুমদার এখন কারাগারে।
বিএফআইইউর প্রতিবেদনটি পরবর্তী ব্যবস্থার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে জমা দেওয়া হয়েছে।
Comments