গায়ক পরিচয়ের আড়ালে সুরকার আইয়ুব বাচ্চু

বেঁচে থাকলে আজ ৬১ বছরে পা রাখতেন প্রখ্যাত গিটারিস্ট ও বাংলা রকগানের কিংবদন্তি আইয়ুব বাচ্চু। ১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রামে জন্মেছিলেন আইয়ুব বাচ্চু।
আইয়ুব বাচ্চু। ছবি: সংগৃহীত

বেঁচে থাকলে আজ ৬১ বছরে পা রাখতেন প্রখ্যাত গিটারিস্ট ও বাংলা রকগানের কিংবদন্তি আইয়ুব বাচ্চু। ১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রামে জন্মেছিলেন আইয়ুব বাচ্চু।

চট্টগ্রামের সেই ছেলেটি গান গেয়ে ও গিটার বাজিয়ে সারা দেশের মানুষের মন জয় করবে, এটা কেউ তখনো ভাবেননি। তবে সে সময় প্রখ্যাত গিটারিস্ট নয়ন মুন্সির গিটার বাজানো শুনেই বাচ্চুর গিটারে আগ্রহ তৈরি হয়। তারপর প্রথমে গিটার ধার করে ও পরে মা'র সোনার গয়না বিক্রির টাকায় গিটার কেনা।

১৯৭৮ সালে আইয়ুব বাচ্চু যোগ দেন 'ফিলিংস' ব্যান্ডে। তারপর ১৯৮০ সালে সোলস। বাচ্চুর হাত দিয়েই এসেছিল 'নদী এসে পথ' গানের সেই বিখ্যাত গিটার সলো। ব্যান্ডটির সে সময়ের ভোকাল তপন চৌধুরী বিটিভির এক ঈদ অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, বাচ্চু গিটারে যখন সুরটা বাজাচ্ছিল, আমি শুনে বললাম- এটা খুব সুন্দর সুর হয়। তারপর নকীব আমার সঙ্গে কি-বোর্ড নিয়ে সুর করতে বসে।

বাচ্চুর ভালোবাসার জায়গা ছিল রকগান। ১৯৮২ সালে নকীব খান ও পিলু খান সোলস থেকে বেরিয়ে রেনেসাঁ গঠন করেন। তারপর ব্যান্ডের মূল কম্পোজার ছিলেন বাচ্চুই।

'এ এমন পরিচয়', 'কলেজের করিডোরে', 'সাগর বেলা এলে'- এমন আরও বিভিন্ন গান তার সুরেই।

চট্টগ্রামে হোটেলে পারফর্ম করছেন বাচ্চু (১৯৭৭/৭৮)। ছবি: সংগৃহীত

তবে, বাচ্চু বড় চমক দেখিয়েছিলেন ১৯৮৪'তে। তপন চৌধুরীর প্রথম সলো অ্যালবাম 'তপন চৌধুরী'র সব গানের সুর-সংগীত করেন তিনি। 'আলো ভেবে যারে আমি' কিংবা 'আমি অনেক ব্যথার শ্রাবণ পেরিয়ে'র মত মেলোডিয়াস সেমি ক্লাসিকাল সুর বাচ্চুর অন্য এক সক্ষমতার কথা জানান দেয়।

তপন চৌধুরীর পরের দুটো অ্যালবামেও সুর ও সংগীতায়োজন করেন তিনি। 'পলাশ ফুটেছে শিমুল ফুটেছে', 'পাথর কালো রাত' গানগুলোর কম্পোজিশন বড় বড় অনেক সেমি ক্লাসিকাল কাজের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার সামর্থ্য রাখে।

বাচ্চুর মূল ভালোবাসা ছিলো রক গান। তবে, তখনই একেবারে রকের দিকে যাননি তিনি। সোলসে থাকাকালীন তার দুটো অ্যালবাম  'রক্তগোলাপ' (১৯৮৬) ও 'ময়না' (১৯৮৮) বের হয়। 'ময়না'র সফট রক ধাঁচের গানগুলোর সাফল্য তাকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে।

১৯৯০-এ সোলস ছেড়ে তিনি এলআরবি গড়ে তোলেন। পূর্ণরূপ লিটল রিভার ব্যান্ড হলেও পরিবর্তন করে রাখেন 'লাভ রানস ব্লাইন্ড'।

১৯৯১-এ এলআরবি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯২-এ তাদের প্রথম এলবাম বাজারে আসে। এখান থেকেই মূলত হার্ডরক শুরু করেন বাচ্চু।

অ্যালবামটি ছিল ডবল অ্যালবাম। সে সময়ে ৭০ টাকা খরচ করে মানুষ কিনেছে। 'ঢাকার সন্ধ্যা' গানটিতে তিনি গিটারের আলাদা নৈপুণ্য দেখান।

তুমুল জনপ্রিয় হয় এলআরবির ডবল অ্যালবাম। এরপর 'সুখ' (১৯৯৩), 'তবুও' (১৯৯৪) এর মতো অ্যালবাম। সুখ অ্যালবামে 'সেই তুমি' বা 'চলো বদলে যাই' গানটি তিনি হার্ড রক হিসেবেই করেন।

'তবুও' অ্যালবামে জায়েদ আমীনের গীতিকবিতা 'বাংলাদেশ'কে গানে রূপ দেন।

তবে, তিনি সুরের প্রচণ্ড নৈপুণ্য দেখান 'কষ্ট' (১৯৯৫), 'স্ক্রু ড্রাইভার' (১৯৯৬- জেমসের সঙ্গে মিক্সড), 'ধুন' (১৯৯৭- ছয়টি ব্যান্ডের মিক্সড), 'সময়' (১৯৯৭), 'বিস্ময় ও আমাদের' (১৯৯৮- ডাবল অ্যালবাম) এর মতো অ্যালবামগুলোতে।

'কষ্ট' অ্যালবামের 'কষ্ট পেতে ভালোবাসি'র মতো রক কম্পোজিশন কিংবা 'কষ্ট কাকে বলে'র মতো মেলো রক অনেকেই শুনেছেন। এই অ্যালবামে থাকা তার একটি আন্ডাররেটেড গান 'ভীষণ ব্যথা'র কথা আলাদা করে বলতেই হয়। ব্লুজ নোট ও র‍্যেগের সমন্বয়ে অনবদ্য একটি কম্পোজিশন দাঁড় করিয়েছিলেন তিনি।

'স্ক্রু ড্রাইভার' এর 'হাসতে দেখো' কিংবা 'নীল বেদনা' তার অমর কম্পোজিশন। হাসতে দেখো গানটা হার্ড রক হলেও গানের মেলোডির জায়গাটাও শক্তিশালী। আর 'নীল বেদনা'য় শুরুটা হয় ব্লুজের মতো। তারপর হাহাকার জাগানিয়া সেই হার্ড রক মিউজিক। আবার শেষে সেই ব্লুজ।

প্রথম অ্যালবাম ‘রক্তগোলাপ’-এর (১৯৮৬) কাভার। ছবি: সংগৃহীত

'সময়' অ্যালবামে 'শেষ' গানটা সাইকেডেলিক রকের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এই অ্যালবামে বাচ্চু সংগীতের নানারকম ফর্ম নিয়ে বিস্তর নিরীক্ষা করেছেন। 'বড়বাবু মাস্টার' এর মতো অর্থপূর্ণ গান করেছেন শুধু একটি গিটারে অল্পকিছু কর্ড ব্যবহার করে। 'সব আলো নিভিয়ে দিয়ে'ও আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজ।

বাচ্চুর সুরকার হিসেবে একটি বৈশিষ্ট্য ছিল গানের শুরুতে কথায় গাওয়ার পূর্বে সেই সুরের সঙ্গে মিল রেখে একটি গিটার ইন্ট্রো৷ আবার শেষে প্রথম প্যারা বা মুখরাটা পুরোটা গাওয়া।

হার্ডরকের বিভিন্ন সুর আবার অন্যভাবেও গেয়েছেন। 'ফেরারি মন' (১৯৯৬) অ্যালবামে 'সেই তুমি', 'এখন অনেক রাত', 'বাংলাদেশ' গানগুলোর লাইভ ভায়োলিন ভার্সন অন্যরকম জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এখানে রক ও মেলোডিকে তিনি এক সূত্রে গেঁথেছেন।

'ধুন' (১৯৯৭) অ্যালবামে তিনি ভিন্ন স্বাদের দুটি গান করেন। 'লোকজন কমে গেছে' গিটারের স্রোতে ভাসা এক অনবদ্য হার্ড রক। আবার 'যে মানুষটি' একটি গিটারে একুস্টিক ধরণে বাজানো সফট মেলোডিয়াস গান।

ডাবল অ্যালবাম 'বিস্ময়' ও 'আমাদের' (১৯৯৮)-এ বিভিন্ন রকম সুর করেছেন তিনি। 'চাই জল', 'সাড়ে তিন হাত মাটি', 'খুব সহজেই', 'জল জোছনা', 'সুইসাইড নোট' গানগুলো তার সুরের শক্তির প্রকাশক।

২০০১ সালের 'মন চাইলে মন পাবে'র টাইটেল গানটিতে তার গিটার বাজানো একেবারে আলাদা, কিছুটা হেলিকপ্টারের পাখা ঝাপটানোর মত। আবার 'আপন কেউ নাই' গানটা সফট মেলোডিয়াস রক হিসেবে তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ। এখানে তার সিগনেচার টাচ হিসেবে শুরুতে আসে গানের কথায় বসানো সুর ধরে বাজানো ইন্ট্রো।

বাচ্চু 'একচালা টিনের ঘর'-এর মতো ফোক ফিউশনও করেছেন। 'নদীর বুকে চাঁদ' (২০০৪) অ্যালবামে তার ফোক অভিমুখিতা আরও পরিষ্কার হয়।

তবে, পরবর্তীতে আবারও রক কম্পোজিশনেই মনোযোগী হতে দেখা যায় তাকে। 'সাউন্ড অব সাইলেন্স'-এর মত ইন্সট্রুমেন্টাল অ্যালবাম করেছিলেন তিনি। বিখ্যাত বিভিন্ন ইংরেজি গান বাজিয়েছিলেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। আবার, 'রিমঝিম বৃষ্টি' অ্যালবামে 'অনিমেষ' গানে বেশ ক্যাজুয়াল ধরণে গিটার বাজিয়েছেন তিনি।

বাচ্চু একসময় ব্যান্ডে কি-বোর্ড ব্যবহার করলেও এস আই টুটুলের এলআরবি ত্যাগের পর আর কি-বোর্ডিস্ট রাখেননি। ওনার গিটারের শক্তিমত্তার আরেকটি উদাহরণ টিভি শো 'আর মিউজিক'-এ হাসানের 'এত কষ্ট কেন ভালোবাসায়' গানে বাজানো৷ গানটার অন্তরা অংশের কি-বোর্ডের কাজগুলো তিনি লাইভ অনুষ্ঠানে গিটারেই চমৎকারভাবে বাজিয়েছিলেন।

১৯৯৩/৯৪ সালে এলআরবির সদস্যরা, (বাম থেকে) আইয়ুব বাচ্চু, এস আই টুটুল, মিল্টন আকবর ও স্বপন। ছবি: সংগৃহীত

অন্য শিল্পীদের জন্যও তিনি গান সুর করেছেন প্রচুর। হাসান আবিদুর রেজা জুয়েলের প্রথম ৫টি অ্যালবামের সুর-সংগীত করেছেন তিনি। 'এ কোন ব্যথায় বুক ভেঙে যায়' কিংবা 'অনন্যা ফিরে দেখো না'র মতো গান আছে এই তালিকায়।

অনল রায়হানের 'নিশ্চুপ মাঝরাত' (ফেইথ ব্যান্ড), নওশের বাবুর 'ভাঙা মন নিয়ে তুমি কেঁদো না', আগুনের 'আমার স্বপ্নগুলো কেন এমন স্বপ্ন হয়', নাসিম আলী খানের 'যতীন স্যারের ক্লাসে' গানগুলোও তার সুরে।

সংগীতশিল্পী হিসেবে আইয়ুব বাচ্চুর তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা ছিল ও আছে। তবে, এতে কিছুটা আড়ালে চলে গেছে তার বৈচিত্র্যময় সুরকার সত্ত্বা। শুধু অডিওতে নয়, বিজ্ঞাপনের জিংগেলেও আলোড়ন তোলা বিভিন্ন সুর করেছেন তিনি। যেমন- ইকোনো কলম কিংবা গ্রিন ডেলটা ইনসুরেন্স।

বাচ্চুর সময়ে রক শিল্পীদের ভেতর তিনি ছিলেন 'ফুল টাইম মিউজিশিয়ান'। তার মৃত্যুর পর ফিডব্যাকের ফোয়াদ নাসের বাবু যেমন বলেছেন, 'তিনি আমাদের জন্য একটি উদাহরণ। আমরা যারা ব্যান্ড করি, তারা যে শুধু গান নিয়েই থাকতে পারি, সম্মানের সঙ্গে জীবন চালাতে পারি- সেটা তিনি দেখিয়েছেন। তিনি আমাদের সময়ের ব্যান্ডশিল্পীদের ভেতর ফুল টাইম মিউজিক করতেন।'

আইয়ুব বাচ্চু শিল্পী হিসেবে যতো ধরণের গান করেছেন, সুরকার হিসেবে সুর করেছেন এর চেয়ে বেশি ধরণের গানে। তিনি মূলত রকগায়ক, কিন্তু সুরের ভুবনে ক্লাসিকাল-রক দুইক্ষেত্রেই সফল৷ তবে তার গান গাওয়া ও গিটার বাজানো নিয়ে তুমুল আলোচনা হলেও শুধুমাত্র একজন সুরকার হিসেবে তাকে নিয়ে আলোচনা সে তুলনায় কমই হয়েছে। বৈচিত্র্যময় একজন সুরকার আইয়ুব বাচ্চুকে জন্মদিনে শ্রদ্ধা।

[email protected]  

Comments

The Daily Star  | English

Mercury hits 42.7°C in Chuadanga, season's highest

Chuadanga today recorded the highest temperature of this season at 42.7 degree Celsius

51m ago