পঙ্কজ উদাস: পপ মিউজিকের যুগে গজলকে জনপ্রিয় করেন যিনি
নব্বই দশকের শেষের দিক। একদিকে বলিউড সিনেমার যতসব মন মাতানো গান, অপরদিকে বোম্বে ভাইকিংস, আরিয়ানস আর ইউফোরিয়ার মতো ব্যান্ডের ইন্ডি-পপ ঘরানার একের পর এক হিট। এদের মাঝে জায়গা করে নিলো স্নিগ্ধ কণ্ঠের গজল।
প্রেমে পড়ার শুরুর দিকে অব্যক্ত কথাগুলো যেন চুপিসারে আশ্রয় নিলো তার গানে, আবার রাতের পর রাত চিঠির অপেক্ষায় কাটিয়ে দেওয়া কোনো প্রবাসীর আর্তনাদও বিশ্রাম নিলো সেখানে। মানুষের সূক্ষ্ণ অনুভূতিগুলো স্পর্শ করা এই গায়ক পঙ্কজ উদাস।
কিংবদন্তী এই গজল গায়ক ভারতীয় মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির পরিবর্তনের যুগে রেখেছিলেন অগ্রণী ভূমিকা। তাকে উৎসর্গ করেই আজকের এই লেখা।
যেভাবে গজল গায়ক হলেন পঙ্কজ
উদাস পরিবারের ছিল তিন সন্তান। মনহর, নির্মল ও পঙ্কজ উদাস। এদের মধ্যে পঙ্কজ উদাস ছিলেন সবার ছোট। পরিবার সংস্কৃতিমনা হওয়ায় গান-বাজনার প্রতি আগ্রহ আর চর্চা দুটোরই কমতি ছিল না। পঙ্কজ যখন ছোট তার বড় ভাইয়েরা তখন প্রতিষ্ঠিত শিল্পী। তাদের সঙ্গে তিনিও কনসার্টে যাওয়া শুরু করলেন। সেখান থেকেই ক্লাসিক্যাল গানের প্রতি তার আগ্রহ জন্মায়।
মুম্বাইয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়াশোনা করেন পঙ্কজ। ক্লাসিক মিউজিককে আরও জানতে ভর্তি হন মুম্বাইয়ের মাস্টার নাভরাং ট্রেনিং সেন্টারে। 'কামনা' সিনেমার মাধ্যমে তিনি গজল গায়ক হিসেবে যাত্রা শুরু করেন। সিনেমাটি ফ্লপ হলেও প্রশংসিত হন পঙ্কজ। ক্লাসিক্যাল মিউজিকের প্রতি তার প্রেম আর উর্দু ভাষার ওপর দখল গজল সংগীতে তার অবস্থান আরও পাকাপোক্ত করে।
হিন্দি গানের দুর্দিনে হাল ধরেন
আশির দশক বলিউডের জন্য খুব একটা ভালো যায়নি। একেরপর এক মুক্তি পেতে থাকে গতানুগতিক গল্পের সিনেমা। সফল সিনেমার সংখ্যাও বিগত দশকের থেকে কমে আসে। সিনেমার এই মন্দার প্রভাব পড়ে ভারতীয় সংগীত শিল্পেও। রাহুল দেব বর্মণের (আর ডি বর্মণ) মতো বিখ্যাত সংগীত পরিচালকরা তখন ঘরে বসা। এমন সময়ে গজল গান হিন্দি সিনেমার গানগুলোকে নতুন দিশা দেয়। এই ধারায় তখন অগ্রণী ভূমিকা রাখেন জগজিৎ সিং এবং তার পাশাপাশি পঙ্কজ উদাস।
১৯৮৬ সালে মহেশ ভাটের সিনেমা 'নাম'-এ গান করেন তিনি। সেই গানটির নাম 'চিটঠি আই হে'। পঙ্কজের ক্যারিয়ারে রাতারাতি খ্যাতি নিয়ে আসে এই গান।
একই সময়ে বেশ কয়টি অ্যালবামেও প্রকাশ করেন তিনি। ১৯৮০ সালে মুক্তি পায় 'আহত' অ্যালবাম। এরপর ১৯৮১, ১৯৮২ ও ১৯৮৩ সালে মুক্তি পায় 'মুক্বারার', 'তারান্নুম' ও 'মাহফিল' নামে আরও তিনটি অ্যালবাম। জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে প্রচুর কনসার্ট করারও সুযোগ পান তিনি। একদিকে কানাডা ও আমেরিকা, অপরদিকে ইংল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কনসার্টের আমন্ত্রণ পান তিনি। লন্ডনের রয়্যাল এলবার্ট হলে ১৯৮৪ সালে তিনি প্রথমবারের মতো পারফর্ম করেন। পরের বছর একই হলে মুক্তি পায় 'নায়াব' নামে তার আরও একটি অ্যালবাম।
নিজস্ব গজল অ্যালবাম ছাড়াও 'সাজান' সিনেমার 'জিয়ে তো জিয়ে' ও 'মহড়া' সিনেমার 'না কাজরে কি ধার' গান গেয়েও জনপ্রিয়তা অর্জন করেন তিনি।
হিন্দি ও উর্দু গজলের পাশাপাশি বাংলা গানও গেয়েছেন পঙ্কজ উদাস। তার জনপ্রিয় গানের মধ্যে 'ভালোবাসা', 'আমি স্বপ্ন দেখে যাই', 'তোমার চোখেতে ধরা' ও 'যদি আরেকটু সময় পেতাম' উল্লেখযোগ্য।
নব্বই দশকের চার্টবাস্টার
১৯৯০ এর দশক শুধু বলিউডের জন্য নয়, গোটা ভারতীয় মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির জন্যই বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি দশক। এসময় বলিউডে যেমন যতীন-ললিত, নবীন শ্রাবণ ও আনু মালিকের মতো সংগীত পরিচালকদের যুগ, একইসঙ্গে প্লেব্যাক মিউজিকের দিকে উদিত নারায়ণ, কুমার শানু, সনু নিগামরা তখন খ্যাতির তুঙ্গে। আবার পপ মিউজিকেরও স্বর্ণালী সময়ও এই দশক। আরিয়ানস, আর ডি বি, বোম্বে ভাইকিংস, কলোনিয়াল কাজিনস ও ইউফোরিয়ার মতো ব্যান্ডগুলো দিচ্ছিল একের পর এক হিট গান।
পুরোনো হিন্দি গানগুলোও ডিসকো ও পপ ধারায় নতুন করে ভিডিওসহ মুক্তি পেতে শুরু করে এই সময়ে। সব মিলিয়ে হিন্দি গানের বাজার সেটা হিন্দি সিনেমার হোক, কিংবা ব্যান্ড মিউজিক ও পুরোনো গানের কাভার অথবা লাকি আলী ও শানের মতো একক অ্যালবাম, বৈচিত্র্যময় এবং ব্যবসা সফল ছিল তখনকার গানের জগৎ।
এমন সময়ে পঙ্কজ উদাসের গানগুলোও টপচার্ট দখল করে নিতে সক্ষম হয়। এমটিভি ও বি ফর ইউ টেলিভিশন চ্যানেলের সাপ্তাহিক শোগুলোতে যেসব জনপ্রিয় গান সম্প্রচার করা হতো সেগুলোর সেরা তিনে কখনো জায়গা নিতো 'ওর আহিস্তা কিজিয়ে বাতে' ও 'চান্দি জেসা রাঙ'।
গুজরাটের জোতপুরে ১৯৫১ সালে এক কৃষক পরিবারে জন্ম নেন পঙ্কজ উদাস। দীর্ঘদিন শারীরিক নানা জটিলতায় অসুস্থ থাকার পর ২৬ ফেব্রুয়ারি মুম্বাইয়ের একটি বেসরকারি হাসপাতালে মারা যান তিনি। প্রায় চার দশকের বিস্তৃত ক্যারিয়ারে ৭০০ শতাধিক গান গেয়েছেন পঙ্কজ উদাস। ২০০৬ সালে পান ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান 'পদ্মশ্রী'। কিংবদন্তী এই গজল শিল্পীর সবগুলো গান এখনো জীবন্ত, ঠিক যেন আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টির ফোটার মতো অথবা শীতের শেষে হালকা মৃদু বাতাসের ন্যায়।
Comments