যেভাবে তামিলনাড়ুর ‘আম্মা’ হয়ে ওঠেন জয়ললিতা
ছোটবেলায় তার স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে ডাক্তার, আইনজীবী অথবা ভারতীয় প্রশাসনিক পরিষেবায় যোগ দেবেন। তবে আর্থিক টানাপোড়েনের কারণে একরকম বাধ্য হয়েই সিনেমায় অভিনয় করতে শুরু করেন। প্রায় দুই যুগ ধরে তামিল, তেলেগু, কন্নড় ও হিন্দি ভাষায় ১৩০ টির মতো ছবিতে অভিনয় করে দর্শকের মন জয় করেন তিনি। সমাজসেবার শপথ নিয়ে রাজনীতিতে আসেন। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় তিনি মাত্র এক টাকা বেতন নিতেন।
তিনি জয়ললিতা জনরাম, তামিলনাড়ুর 'আম্মা'।
অভিনয় জীবনের শুরু
জয়ললিতার জন্ম ১৯৪৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি, কর্ণাটকের মেলুকোটে। জন্মের সময় তার নাম রাখা হয় কোমলভাল্লি। পরে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় জয়ললিতা। তার বাবা জয়রাম ছিলেন একজন আইনজীবী। জয়ললিতা মাত্র দুই বছর বয়সে বাবাকে হারান। বাবার মৃত্যুর পর তার মা বেদাভাল্লি সন্তানদের সাথে ব্যাঙ্গালোরে নিজ বাড়িতে চলে যান। বেদাভাল্লি কন্নড় সিনেমায় কাজ করার প্রস্তাব পেয়েছিলেন। তবে তার ব্রাহ্মণ বাবার এতে সম্মতি ছিল না। পরে তিনি অভিনয়ের জন্য ব্যাঙ্গালোর থেকে চেন্নাইতে চলে যান। অভিনয় জগতে তিনি 'সন্ধ্যা' নামে পরিচিত ছিলেন।
তবে মায়ের অভিনয়ের পেশার প্রতি তেমন আগ্রহ ছিল না জয়ললিতার। ব্যাঙ্গালোরে থাকাকালীন দশম শ্রেণিতে এ সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে গোল্ড মেডেল ও বৃত্তি পেয়েছিলেন তিনি। পড়াশোনার পাশাপাশি নাচ ভালোবাসতেন। ভারত নাট্যম, কত্থক, মনিপুরি, মোহিনীয়াট্টম ইত্যাদি নাচে পারদর্শী ছিলেন তিনি।
জয়ললিতা সাত বছর বয়সে গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে মায়ের সাথে মাদ্রাজ যান। তখন তার মা কন্নড় ছবি 'শ্রী শীলা মাহাতমী'তে কাজ করছিলেন। মায়ের সাথে একদিন স্টুডিওতে গিয়ে দেখেন সেদিন এক ক্ষুদে শিল্পী অসুস্থতার কারণে শুটিং করতে পারছে না। পরে পরিচালক ও প্রযোজকের অনুরোধে দেবী পার্বতীর ছোটবেলার সেই চরিত্রে অভিনয় করেন জয়ললিতা। সেই থেকে অভিনয় জীবন শুরু। আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে দশম শ্রেণিতে বৃত্তি পাওয়ার পর কলেজে না গিয়ে জয়ললিতা তার প্রথম সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ হন।
অভিনয়ের প্রথম দিন থেকেই লাখো দর্শকের মনে জায়গা করে করেন জয়ললিতা। তামিলনাড়ু স্টেট অ্যাওয়ার্ডে পাঁচ বার সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পান তিনি। এছাড়া সেরা অভিনেত্রী হিসেবে তিনবার ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড জেতেন।
এমজেআর ও জয়ললিতা
১৯৬৫ সালে আইকনিক তামিল অভিনেতা মারুথুর গোপাল রামচন্দ্রন ওরফে এমজিআরের সঙ্গে জুটি হয়ে অভিনয় করেন জয়ললিতা। পর্দায় তাদের এই জুটি দর্শকের কাছে এত বেশি জনপ্রিয়তা পায় যে তারা এরপর একসাথে ২৭টিরও বেশি সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন।
অভিনয়ের পাশাপাশি এমজিআর একজন সক্রিয় রাজনীতিবিদ ছিলেন। ১৯৭২ সালে তিনি এআইএডিএমকে নামে রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তার অনুরোধে এআইএডিএমকে দলে যোগ দেন জয়ললিতা। এক সাক্ষাৎকারে জয়ললিতা বলেন, 'আমি রাজনীতিতে এসেছিলাম তার অনুরোধে। আমি ব্যক্তিগত কোনো উচ্চ আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আসিনি।'
জয়ললিতা ১৯৮২ সালে এআইএডিএমকে-তে যোগ দেন এবং দ্রুত দলের উচ্চ পদ পান। ধীরে ধীরে তিনি সকলের কাছে 'আম্মা' হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। ১৯৮৩ সালে দলের অনেক সিনিয়রকে ছাপিয়ে তিনি দলের প্রচার সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৮৪ সালে এমজিআর কিডনি রোগের চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার আগে জয়ললিতাকে রাজ্যসভায় নির্বাচিত করেন। এমজিআর-এর অনুপস্থিতিতে, জয়ললিতা ১৯৮৪ সালে পার্টির পক্ষে প্রচারণা চালান। সেসময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রে এমজিআরের চিকিৎসার ভিডিও ও ছবি দেখিয়ে প্রচারণা চালিয়েছেন। সেবছর তিনি রাজ্যসভায় (ভারতীয় সংসদের উচ্চ কক্ষ) আসন জেতেন।
১৯৮৫ সালে এমজিআর হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর তার স্ত্রী জানকী পার্লামেন্টারি পার্টির নেতার পদ থেকে জয়ললিতাকে বরখাস্ত করেন। ১৯৮৭ সালে এমজিআর মারা যাওয়ার পর শোকসভায় জনসম্মুখেই জয়ললিতাকে অসম্মান করা হয়। জয়ললিতা ও জানকী রামচন্দ্রনের মধ্যে বিবাদ এতটাই বিস্তৃত ছিল যে জয়ললিতাকে এমজিআর-এর শেষকৃত্যে যোগদানে অনুমতিও দেওয়া হয়নি।
১৯৮৯ সালের ২৫ মার্চ ডিএমকে এবং বিরোধী সদস্যরা বিধানসভার ভেতরেই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। সেদিন ট্রেজারি বেঞ্চের এক সদস্য জয়ললিতাকে মারধরের চেষ্টা করেন বলে অভিযোগ ওঠে। হাতাহাতিতে তার শাড়ি ছিঁড়ে যায়। তিনি গণমাধ্যমের সামনে এলোমেলো চুল নিয়ে হাজির হয়েছিলেন এবং নাটকীয়ভাবে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে "মুখ্যমন্ত্রী না হওয়া পর্যন্ত" বিধানসভায় ফিরবেন না। দুই বছর পর তিনি এই প্রতিশ্রুতি পূরণ করেন।
যেভাবে তামিলনাড়ুর 'আম্মা' হয়ে ওঠেন জয়ললিতা
'আমি সোজা চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলি এবং চোখের দিকে তাকিয়েই বলি যে, আপনার সাথে কথা বলে আমার ভালো লাগেনি। নমস্কার।' স্পষ্টবাদিতার জন্য বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন জয়ললিতা জয়রাম। ১৯৯১ সালে নির্বাচনের পর তিনি মাত্র ৪৩ বছর বয়সে তামিলনাড়ুর সবচেয়ে কম বয়সী মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। পরের ১৪ বছরেরও বেশি সময় ধরে ছয় মেয়াদে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
তার সরকার নারী ক্ষমতায়ন এবং শিল্পায়নের জন্য বিশেষভাবে কাজ করে। পুলিশের নিয়োগে নারীদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা বাধ্যতামূলক এবং নারীদের জন্য নির্দিষ্ট পুলিশ স্টেশন ও লাইব্রেরির ব্যবস্থা করে। অধিকাংশ মোবাইল কোম্পানিকে তাদের কারখানা তামিলনাড়ুতে স্থাপন করার জন্য রাজি করায়। জয়ললিতা ২০০৩ সালে তৃতীয়বারের মতো মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর তামিলনাড়ুতে ভারতের প্রথম সর্ব মহিলা পুলিশ কমান্ডো কোম্পানির কমিশন হয়। তিনি প্রদেশটিতে লটারি, গুটকা এবং পান মসলা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। বিরাপ্পান নামে পরিচিত একজন ভারতীয় দস্যুকে (ডাকাত) ধরতে উদ্যোগ নেন।
কৃষি ক্ষেত্রে তার নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগ ভারতজুড়ে প্রশংসিত হয়। অন্যান্য প্রদেশও তার সরকারের নেওয়া মডেল অনুসরণ করে। ২০০৪ সালে সুনামির সময় তার নেওয়া পদক্ষেপ দেখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহও প্রশংসা করেছিলেন। সেসময় গণমাধ্যমে তাকে 'আয়রন লেডি' বলে উল্লেখ করা হয়।
২০১১ সালে তিনি যখন চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় আসেন তখন জনগণের জন্য কম মূল্যের 'আম্মা' ব্র্যান্ডের চাল, লবণ, পানি এমনকি সিমেন্ট পর্যন্ত বাজারজাত করেন। 'আম্মা' নামের একটি ক্যান্টিন স্থাপন করা হয়, যেখানে এক টাকায় খাবার বিক্রি করা হতো। জয়ললিতা সরকার ডিজিটাল শিক্ষাকে উৎসাহিত করতে গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দশম এবং দ্বাদশ শ্রেণি পাশ করেছে এমন শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে ল্যাপটপ বিতরণ করে।
২০১৫ সালে পঞ্চমবারের মতো মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসার পর তিনি কমমূল্যের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে একটি হাসপাতাল তৈরি করেন। ২০১৬ সালে ৬০ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য বিনামূল্যে মাসে ১০ বার বাস ভ্রমণের সুযোগ করে দেন।
২০১৬ সালে পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার পর কুদানকুলাম নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন করেন। একই বছরের ২১ সেপ্টেম্বর তিনি মেট্রোরেল পরিষেবা 'চেন্নাই বিমানবন্দর লিটল মাউন্ট' উদ্বোধন করেন।
এর কিছুদিন পরেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ২০১৬ সালের ৫ ডিসেম্বর কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে মৃত্যুবরণ করেন গুণী এই রাজনীতিবিদ। তাকে নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয় যার নাম 'থালাইভি', সিনেমাটিতে কঙ্গনা রানাওয়াত তার চরিত্রে অভিনয় করেন।
এক সময়ের জনপ্রিয় অভিনেত্রী, একজন রাজনীতিবিদ, একজন মুখ্যমন্ত্রী সমাজের এতটাই গভীরে পৌঁছেছেন যে এখনো সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ অকৃত্রিম ভালোবাসা ও আনুগত্যে তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। বলা হয়ে থাকে, তামিলনাড়ুর ইতিহাসে এখন পর্যন্ত তার মতো জনপ্রিয় নেত্রী আর কেউ হননি।
Comments