সিডরের ১৬ বছর: নিখোঁজদের এখনো খুঁজে ফেরেন স্বজনরা

পটুয়াখালী জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তরের হিসাব অনুসারে, সিডরে পটুয়াখালীতে ৪৬৬ জনের মৃত্যু হয় এবং ২১১ জন এখনো নিখোঁজ।
সিডরের ১৬ বছর: নিখোঁজদের এখনো খুঁজে ফেরেন স্বজনরা
ঘূর্ণিঝড় সিডরে পরিবারের তিন সদস্য হারিয়ে দিশেহারা পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলা কাঞ্চনপুর গ্রামের আবুল হোসেন। স্ত্রী আর ছেলের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি | ছবি: সোহরাব হোসেন/স্টার

১৬ বছর আগে এই দিনে বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডর। ওই ঝড়ে পটুয়াখালীতে স্বজন-হারাদের কান্না এখনো থামেনি।

পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার কাঞ্চনপুর গ্রামের তিনটি বাড়ির ২৯ জন সিডরে মারা যান। তাদের মধ্যে ১৯ জনের মরদেহ পাওয়া গিয়েছিল, আজও ১০ জনের হদিস মেলেনি। বন্ধ হয়নি স্বজনের কান্না। প্রতি বছর এই দিনে কাঞ্চনপুর গ্রামে শোকের ছায়া নেমে আসে।

এই গ্রামের বাসিন্দা সোবাহান হাওলাদার (৮০) জানান, সিডরে তিনি স্ত্রী হালিমা বেগমসহ ছয় স্বজন হারিয়েছেন। কেবল হালিমা বেগমের ছাড়া আর কারও মরদেহ তিনি খুঁজে পাননি। তার নাতি কৈতুরি (৫), শরিফ হোসেন (৭), মিরাজ হোসেন (১২), সোহাগ হোসেন (১০) ও বিউটি বেগম (৬) এখনো নিখোঁজ।

বৃদ্ধ বয়সে এখন একা ঘরে থাকেন সোবাহান। স্ত্রীর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে স্বজনদের স্মরণ করেন তিনি। একসঙ্গে এত জনকে হারিয়ে তিনি দিশেহারা, বাকরুদ্ধ।

সোবাহান হাওলাদারের প্রতিবেশী আবুল হোসেন পাহলোয়ান (৫০) স্ত্রীসহ দুই সন্তানকে হারিয়েছেন। স্ত্রী নুরজাহান বেগম ও পুত্র সাইদুল ইসলামের (১৪) মরদেহ বাড়িতে এনে দাফন করেছেন কিন্তু সাত বছরের মেয়ে হালিমার খোঁজ মেলেনি।

আবুল হোসেন জানান, ওই রাতের কথা মনে হলে এখনো ঘুমাতে পারি না। আমরা পরিবারের চার জন কলাগাছিয়ার চরে মাছ ধরতে গিয়েছিলাম। শুকনো মৌসুমে আমাদের গ্রামের অনেকেই ওই চড়ে গিয়ে অস্থায়ী ঝুপড়ি তৈরি করে শুটকি মাছ তৈরির কাজ করেন। চার-পাঁচ মাস পর মাছ ধরা মৌসুম শেষে ফিরে আসতাম। সিডরের আগে প্রতি বছর সেখানে গেলেও পরে আর যাওয়া হয়নি। কারণ ওই চরে গিয়েই আমার স্বজনদের হারিয়েছি। আর সেখানে যেতে চাই না।

আবুল হোসেনের আরেক প্রতিবেশী জোসনা বেগম (৮৪) তার ছেলে, পুত্রবধূ এবং নাতনিসহ ছয় জনকে নিয়ে ওই চরে গিয়েছিলেন। সাগরের প্রচণ্ড ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে এক বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে কোনো রকমে জীবন নিয়ে ফিরেছেন তিনি।

জোসনা বেগম জানান, আমার স্বজনদের কেউ মারা না গেলেও এলাকার অনেকেই মারা গেছেন। নিজের চোখে এতগুলো মৃত্যু দেখে এখনো আঁতকে উঠি।

গ্রামের আব্দুল খালেক পাহলোয়ান জানান, আমার স্ত্রী গোল সাহেরা এবং সাত বছরের মেয়ে আফিয়া মারা যায়। আমার স্ত্রীর মরদেহ উদ্ধার করা গেলেও আফিয়াকে খুঁজে পাইনি।

আলতাফ হোসেন হাওলাদার জানান, আমার স্ত্রী জাহেদা বেগম ও ছেলে রুবেল সিডরে মারা যায়। তবে রুবেলের মরদেহ খুঁজে পাইনি।

গ্রামের বাসিন্দা স্বপন হাওলাদার জানান, এই এলাকার তিনটি বাড়ির ৪৫  নারী-পুরুষ-শিশু প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে রামনাবাদ নদীর মোহনায় কলাগাছিয়ার চরে গিয়েছিল, যাদের মধ্যে ২৯ জন মারা যায়। ১৯ জনের মরদেহ আমরা উদ্ধার করে বাড়িতে এনে দাফন করি। বাকিদের এখনো খোঁজ পাইনি।

পটুয়াখালী জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তরের হিসাব অনুসারে, সিডরে পটুয়াখালীতে ৪৬৬ জনের মৃত্যু হয় এবং ২১১ জন এখনো নিখোঁজ।

সিডরে বাংলাদেশের ৩১টি জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাগেরহাট ও বরগুনা।

সরকারিভাবে সিডরে নিহতের সংখ্যা বলা হয়েছিল ছয় হাজারের আশপাশে। তবে মরদেন পাওয়া না গেলে কোনো ব্যক্তি আইনের চোখে মৃত হিসেবে গণ্য হন না। সরকারিভাবে ক্ষতিপূরণেরও হকদার হয় না এসব পরিবার।

Comments

The Daily Star  | English

Fire at Mutual Trust Bank in Dholaikhal

Four units are working to bring the fire under control

8m ago