‘গ্যাসের দামবৃদ্ধি আমাদের জন্য আশীর্বাদ’ যা বললেন ৩ বিশেষজ্ঞ

আন্তর্জাতিক বাজারে দামবৃদ্ধির পর সরকার এলএনজি কেনা বন্ধ রাখে। এতে দেশে গ্যাসের সংকট তৈরি হয়। এর মধ্যেই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়। এখন চলছে ভোক্তাপর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া। অন্যদিকে, জ্বালানির দামবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে নিত্যপণ্যের বাজারেও। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনগণের নাভিশ্বাস অবস্থা।
গ্যাস অনুসন্ধান

আন্তর্জাতিক বাজারে দামবৃদ্ধির পর সরকার এলএনজি কেনা বন্ধ রাখে। এতে দেশে গ্যাসের সংকট তৈরি হয়। এর মধ্যেই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়। এখন চলছে ভোক্তাপর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া। অন্যদিকে, জ্বালানির দামবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে নিত্যপণ্যের বাজারেও। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনগণের নাভিশ্বাস অবস্থা।

এসবের মধ্যেই বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ মন্তব্য করলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের দামবৃদ্ধি বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ হয়েছে। এই কারণেই এখন গভীর সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানের অফার আসছে।

গ্যাসের দামবৃদ্ধি আসলেই কি বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ হয়েছে? বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) উপদেষ্টা ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. বদরূল ইমাম এবং নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জ্বালানি বিশেষজ্ঞের সঙ্গে।

তাদের মতে, দামবৃদ্ধি বা কমার সঙ্গে বিদেশি কোম্পানির গ্যাস অনুসন্ধানে আসার কোনো সম্পর্ক নেই।

অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, 'প্রথম কথা হচ্ছে সাগরের গ্যাস অনুসন্ধানে সবার আগে বিনিয়োগকারীদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য মাল্টিক্লাইন্ট সার্ভে করে সেখানে কী ধরনের সম্ভাবনা ও প্রসপেক্ট আছে, একটা প্যারামিটার সেখান থেকে বের করে বিনিয়োগকারীদের সামনে উন্মুক্ত করার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পরেও সেটা করা যায়নি। কারা করাতে চেয়েছিলেন, আর কারা করাতে দেননি, এ বিষয়টি পরিষ্কার হলেই বোঝা যাবে যে, আমরা বিনিয়োগকারীদের আনতে পারিনি নাকি বিনিয়োগকারীরা আসেনি। বলা হচ্ছে, এখন মূল্যবৃদ্ধি দেখে তারা আসছে। মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে বিনিয়োগকারীর সম্পর্ক আমি দেখি না।'

কারা সার্ভে করতে দিলো না বা কেন দিলো না? জানতে চাইলে এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বলেন, 'একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী এটাতে বাধা দিয়েছে। রিপোর্টে আছে, ক্রয় সংক্রান্ত কমিটির কাছে যাওয়ার পর কমিটির সদস্যরা নানা ধরনের মন্তব্য করেছিলেন। নানা অজুহাতে সেটা ডিফার করা হয়েছে।'

'আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের দাম বেশি হলে কোম্পানিগুলো গ্যাস উত্তোলন করে বেশি দামে আন্তর্জাতিক বাজারে বেশি দামে বিক্রি করতে পারবে, সেরকম হওয়ার তো কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ আমাদের রপ্তানি তো বন্ধ। আমরা গ্যাস রপ্তানি করতে পারব না', বলেন তিনি।

আমদানির ওপর নির্ভর করে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা বা জ্বালানি চাহিদা মেটানো এখন আর সম্ভব না বলে মনে করেন শামসুল আলম। 'যে পদ্ধতিতে তারা বেসরকারিখাত থেকে বিনিয়োগ আকর্ষণ করে বেসরকারিখাতের তত্ত্বাবধানে কাজটি করছিল, সেখানে প্রচুর পরিমাণ ব্যবসার নিশ্চয়তা ছিল। ব্যবসার স্বার্থ দেখতে গিয়ে জাতীয় স্বার্থকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা হয়েছিল। এখন এই উদ্যোগের পেছনে যতটা জাতীয় স্বার্থ আছে, তারচেয়ে বেশি আছে সক্ষমতা না থাকার বিষয়টি। স্পট মার্কেটের এলএনজি এনে ১ দশমিক শূন্য ৩ টাকা দামের দেশীয় গ্যাসের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বিক্রি করা সম্ভব হলো না।'

'তারা বলেছিল, গ্যাস পাওয়া যাবে কি না, তার নিশ্চয়তা নেই, গ্যাস নেই। এক সময় বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো বলে গেছে আমরা গ্যাসের ওপর ভাসছি, তখন রপ্তানির চেষ্টা করেছি। এখন আবার সেই বিশেষজ্ঞরাই বলছে যে আমাদের গ্যাস নেই, গ্যাস পাওয়া যাবে কি না, তার নিশ্চয়তা নেই। এই অনিশ্চয়তা নিয়ে যেহেতু বসে থাকা যাবে না, যেহেতু জ্বালানি চাহিদা মেটাতে হবে, তাই আমাদের বিকল্প পরিকল্পনায় যেতে হবে বলে তারা বলেছিল। কিন্তু এখন জানা গেল যে গ্যাস আছে এবং আমরা সেই গ্যাস উত্তোলনের দিকে মনোযোগ দিলাম। তাদের আগের বিবেচনার সঙ্গে নতুন এই সিদ্ধান্ত পর্যালোচনার দাবি রাখে। যদি তারা মনে করে যে এখানে ভুল হয়েছে, তাহলে সেটা হবে আশীর্বাদ। আর যদি ভুল না বুঝে কেবল উত্তপ্ত পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য এই সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে বলব, এই প্রচেষ্টাও সফল হবে না', যোগ করেন তিনি।

বেসরকারিখাতের তেল-গ্যাস আমদানির সুযোগের বিষয়ে ক্যাবের এই উপদেষ্টা বলেন, 'বেসরকারি খাত সম্পর্কে আমাদের অভিজ্ঞতা খুবই নাজুক। তারা কোনো মান-নীতি মেনে ব্যবসা করে না। কাজেই তাদের হাতে এই দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে সরকার দায়মুক্ত হতে পারে না। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার থেকেও জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি সরকার যেমন শতভাগ নিজের কাঁধে রেখে নিশ্চিত করছে, জ্বালানিকেও সেভাবেই রাখতে হবে। জ্বালানিকে ব্যবসার খাত করা, এটাকে মুনাফামুখী করা এবং বেসরকারিখাতকে বেশি লাভ দিয়ে তাদের থেকে বিনিয়োগ আকর্ষণ করা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আবারও একই ভুল সিদ্ধান্ত হবে বেসরকারি খাতে তেল-গ্যাস আমদানি তুলে দেওয়াটা।'

যেসব ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ আগামী বছরের জুনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে, সেগুলোর মেয়াদ আর বাড়ানো হবে না বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী। এ বিষয়ে অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, 'এটা ভালো সিদ্ধান্ত। এর পাশাপাশি, গণশুনানিতে পাওয়া গেছে, বেসরকারিখাতে ফার্নেস ওয়েল আমদানির মাধ্যমে তাদেরকে ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যবসা করতে দেওয়া হচ্ছে। সেই বিষয়টিও সরকারের কাছে ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব করছি।'

দেশে ফার্নেস ওয়েলের চাহিদা মাত্রাতিরিক্ত বেড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'বলা চলে, গোটা বিদ্যুতটাই ফার্নেস ওয়েল নির্ভর। রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ফার্নেস ওয়েলে চলে। গ্যাসের সরবরাহ ২০১৫ সাল থেকে আর বাড়েনি। এর সঙ্গে আমদানিকৃত এলএনজি যোগ করার পরেও ২০১৫ সালের তুলনায় ২০২২ সালে শূন্য দশমিক ৪৯ শতাংশ সরবরাহ কমেছে। কাজেই এই অবস্থায় ফার্নেস ওয়েলের ব্যাপারে আমাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সেইসঙ্গে এই খাতটিকে ব্যবসামুখী, মুনাফামুখী করার প্রবণতা থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে, রাজস্ব আহরণের ব্যাপারটি সরকারকে ভুলে যেতে হবে এবং খরচমূল্যে এই খাতে সেবা নিশ্চিত করতে হবে।'

জ্বালানিখাত পরিচালনায় মন্ত্রণালয় থেকে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার করতে হবে উল্লেখ করে শামসুল আলম বলেন, 'অন্যথায় এই খাতে সুশাসন ফিরবে না, দুর্নীতি ও লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বৃদ্ধির যে অভিযোগ রয়েছে, তা বন্ধ হবে না। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এই বোর্ডের চেয়ারম্যান, মেম্বার, পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনে খুব বেশি উৎসাহ দেখিয়েছে এবং লুণ্ঠনমূলক ব্যয়বৃদ্ধির মূল নিয়ামক এই কর্মকর্তারা। তাদেরকে প্রত্যাহার করে বিশেষায়িত ব্যক্তিদের এসব দায়িত্বে আনতে হবে। সার্বিকভাবে বলতে গেলে, এসব পরিবর্তন না এনে যে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, সেটাতে খানিক উপশম হতে পারে, কিন্তু তা বর্তমান পরিস্থিতির স্থায়ী সমাধান নয়।'

অধ্যাপক ড. বদরূল ইমামের কাছে জানতে চাওয়া হয়, 'বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী আপনার নাম উল্লেখ করে বলেছেন যে ডেইলি স্টারে আপনি লিখেছেন, সরকার সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানে গুরুত্ব দেয়নি। যা ঠিক নয়। তখন কোনো বিদেশি কোম্পানি আসেনি। এখন গ্যাসের দামবৃদ্ধির পর বিদেশি কোম্পানি আসছে।'

বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর এ মন্তব্য বিষয়ে অধ্যাপক ড. বদরূল ইমাম বলেন, 'এগুলো একেবারেই গ্রহণযোগ্য বক্তব্য নয়। গ্যাসের দামবৃদ্ধির সঙ্গে বিদেশি কোম্পানি আসার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি যা বলেছি সত্য তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বলেছি। আপনারা একটু অনুসন্ধান করেন, তাহলেই বুঝবেন তখন কেন বিদেশি কোম্পানি আসেনি এবং কেন এসেও চলে গেছে।'

নাম প্রকাশ না করার শর্তে অপর এক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা বিদেশি কোম্পানি এনেছিলাম, তারা চলে গেছে, কাজ করেনি। কিন্তু, কেন যে গেছে, সেটা তো বলা হয় না। তারা অস্ট্রেলীয় কোম্পানি সান্তোসকে কাজ দিলো। সান্তোস তখন এই রিজিওন থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। চলে যাওয়ার সময় সাধারণত যা করে, সন্তোষও তাই করেছে। সান্তোস অফিলকে কাজ দিতে চায়। এর জন্য সরকারের অনুমোদন দরকার। পেট্রোবাংলা অফিলের বিষয়টি যাচাই-বাছাই করে অনুমোদনের জন্য তা মন্ত্রণালয়ের পাঠায়। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের একজন ডেপুটি সেক্রেটারি বিষয়টি নিয়ে তাদের ঘোরাতে থাকেন। তিনি বললেন, এটা হবে না, ওটা হবে না, এটা করেন, ওটা করেন। এরপর কাজ শেষ না করে দিয়েই তিনি চলে যান ৩ সপ্তাহের ছুটিতে। একটি বিদেশি কোম্পানি তো আর দিনের পর দিন বসে থাকবে না। এক পর্যায়ে তারা ক্ষুব্ধ হয়ে চলে যায়। তাদের সঙ্গে যে আচরণটা করা হলো, তার তো কোনো ব্যাখ্যা হয় না। এখন মন্ত্রী বলছেন, তারা চলে গেছে। কিন্তু, কেন চলে গেছে, সেটা আদৌ তিনি জানেন কি?'

তিনি আরও বলেন, 'বিদেশি কোম্পানি দরকার ছিল সমুদ্রের জন্য, স্থলভাগের জন্য না। আর মিয়ানমারে বিদেশি কোম্পানি গেল, তারা গ্যাস পেল। আমাদের এখানে কেন এলো না? ২০১২ সালে যখন সমুদ্র সীমা নির্ধারিত হলো, তারপরই মিয়ানমার বিদেশি কোম্পানি নিয়োগ করে। ২০১৪-১৫ সাল এর জন্য সবচেয়ে ভালো সময় ছিল। গ্যাসের দামবৃদ্ধির কারণে এখন আসছে বলা হলে, ওই সময় মিয়ানমার পেল কীভাবে? সেই সময় চাইলে মিয়ানমারের মতো বাংলাদেশও পেত। কিন্তু তারা মাল্টিক্লাইন্ট সার্ভে করতে চাইলো। সেটা দরকার। টেন্ডারের মাধ্যমে ২০১৫ সালে একটা ভালো ও যোগ্য কোম্পানিকে কাজটা দেওয়া হলো। তারপর সেই টেন্ডার বাতিল করা হলো। এর নেপথ্যের কারণ হচ্ছে, শক্তিশালী একটি মহল মন্ত্রণালয়ে তাদের প্রভাব খাটিয়ে এই টেন্ডার বাতিল করার জন্য চাপ দেয়। কারণ, তারা যে প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ দেখছিল, সেই প্রতিষ্ঠান কাজটি পায়নি। দ্বিতীয়বার টেন্ডার হলে সেই একই প্রতিষ্ঠান, নরওয়ে-যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ প্রতিষ্ঠান, কাজটি পায়। সেটা ২০১৬ সালে। এবারও নানা টালবাহানা করে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়ক্ষেপণ করা হয়।'

'এরপর সারা পৃথিবীতে গ্যাস অনুসন্ধান কমে গেছে করোনার জন্য। এখন এসে তখনকার কথা টানলে তো হবে না। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন করতে হয়ে, ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আপনারা গ্যাস অনুসন্ধান করেননি কেন? এর কারণ হচ্ছে, ওই শক্তিশালী মহল চায়নি বাংলাদেশ থেকে গ্যাস উত্তোলন হোক। কেননা, গ্যাস উত্তোলন হলে এলএনজি আমদানি করা যাবে না, এলএনজির ব্যবসাটা তারা করতে পারবে না। আমরা বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে এনেছি, তারা চলে গেছে— এটা যেমন সত্য না, তেমনি গ্যাসের দাম বৃদ্ধি আমাদের জন্য আশীর্বাদ— এটাও সত্য না', বলেন তিনি।

Comments