বন্যপ্রাণীর নিরাপত্তায় ট্রেনের গতি ২০ কিমি, চিঠি পৌঁছেনি ১ মাসেও

মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের মধ্য দিয়ে চলাচলকারী সব ট্রেনকে ওই এলাকার বন্যপ্রাণীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২০ কিলোমিটার বেগে চলাচলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ট্রেনের ধাক্কায় মারা যাওয়া একটি হরিণ রেললাইন থেকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত

মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের মধ্য দিয়ে চলাচলকারী সব ট্রেনকে ওই এলাকার বন্যপ্রাণীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২০ কিলোমিটার বেগে চলাচলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এই নির্দেশ দেওয়ার পর প্রায় ১ মাস পেরিয়ে গেছে। তবে স্থানীয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের দাবি, তারা রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে এখনো কোনো চিঠি পায়নি।

এই নির্দেশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় বনের মধ্য দিয়ে যাওয়া রেলপথে ট্রেনের ধাক্কায় বিরল ও বিপন্ন প্রাণী মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে প্রায়শই।

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভেতরে রেললাইন ধরে প্রায়শই পার হয় বিভিন্ন প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণী। ছবি: সংগৃহীত

২ সপ্তাহ আগে কালনী এক্সপ্রেস থেকে জবাই করা একটি হরিণ উদ্ধার করে রেলওয়ে পুলিশ।

বন বিভাগের দাবি, মাংস পেতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হরিণটিকে হত্যা করা হয়েছে।

সিলেট বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী ২০২১ সালের ১৪ নভেম্বর বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণের বিষয়ে বন সংরক্ষককে একটি চিঠি পাঠান। চিঠিতে ওই এলাকায় ট্রেনের সর্বোচ্চ গতি কমিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয়।

একই প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে রেজাউল গত বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি বন, বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষককে আরেকটি চিঠি দেন। চিঠিতে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভেতরে ট্রেনের গতি কমানোর বিষয়ে একটি সংযুক্তি ছিল। এতে ভারতের রাজাজি জাতীয় উদ্যানের মধ্য দিয়ে ট্রেন ভ্রমণের কিছু অভিজ্ঞতাও তুলে ধরেন তিনি।

চিঠিতে বলা হয়েছে, দেরাদুন থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের তীর্থস্থান হরিদ্বার-ঋষিকেশ যাওয়ার পথে রাজাজি ন্যাশনাল পার্কের ভেতরে ট্রেনের গতিসীমা সর্বোচ্চ ২০ কিলোমিটার করা হয়েছে, যেন সেখানকার প্রাণী নিরাপদ থাকে।

বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় থেকে গত ২৫ জানুয়ারি রেলপথ মন্ত্রণালয়ে আরেকটি চিঠি পাঠানো হয়। গত ২৯ জানুয়ারি রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) তৌফিক ইমামের সই করা একটি চিঠি মহাপরিচালকের কাছে পাঠানো হয়। বাংলাদেশ রেলওয়ে ওই এলাকায় চলার সময় সব ট্রেনের গতিসীমা ২০ কিলোমিটারের মধ্যে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন।

রেজাউল করিম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রতি বছর ৭-৮টি বড় প্রাণী ট্রেনের ধাক্কায় মারা যায়। বনের মধ্যে দিয়ে মাত্র সাড়ে ৭ কিলোমিটার রেললাইন আছে। কিন্তু ট্রেন এত দ্রুত চলে, মনে হয় যেন বন কাঁপছে।'

তিনি বলেন, 'আমরা এ বিষয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়ার পর, মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ রেলওয়েকে ২৯ জানুয়ারি এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে চিঠি পাঠায়। নির্দেশনা দেওয়ার ১ মাস পেরিয়ে গেলেও স্থানীয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এখনো তা বাস্তবায়ন করছে না।'

'একটি বিরল প্রজাতির মায়া হরিণ গত ২ সপ্তাহ আগেই ট্রেনের ধাক্কায় মারা গিয়েছিল। এটা রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের অবহেলা ছাড়া আর কিছুই না,' যোগ করেন তিনি।

হরিণটির মৃত্যুর কথা উল্লেখ করে বন, বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সহকারী সংরক্ষক শ্যামল কুমার মিত্র বলেন, 'হরিণের শরীরে ক্ষতচিহ্ন ছিল, যা ট্রেনের ধাক্কায় তৈরি হয়েছে। ট্রেনের গতি কম থাকলে হরিণটি বেঁচে যেতো।'

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভেতরে রেললাইনে প্রায়শই বসে থাকতে দেখা যায় বানরসহ নানা প্রজাতির বন্যপ্রাণীকে। ছবি: সংগৃহীত

তবে শ্রীমঙ্গলে বাংলাদেশ রেলওয়ের সিনিয়র উপ-সহকারী প্রকৌশলী ফিরোজ গুলজার বলেন, 'আমরা এখনো রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে ট্রেনের গতি কমানোর বিষয়ে কোনো চিঠি পাইনি। আমাদের স্থানীয় অফিস থেকেও এ ধরনের কোনো চিঠি আসেনি।'

তিনি বলেন, 'অনুমোদন পাওয়ার পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে নতুন ইঞ্জিন দিয়ে পরীক্ষা চালানো হবে এবং গতিসীমা কমানো হবে। চিঠি পেলেই কেবল সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।'

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে গত ৫ বছরে ট্রেন দুর্ঘটনায় অন্তত ৩৫টি বন্যপ্রাণী মারা গেছে এবং প্রচুর প্রাণী আহত হয়েছে বলে জানা গেছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের নথি থেকে।

জাতীয় উদ্যানটি ১৬৭ প্রজাতির গাছ, ৫৯ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী এবং ২২ প্রজাতির উভচর প্রাণীর আবাসস্থল।

বনের ভেতরে ট্রেনের গতি ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটারে নামিয়ে আনতে সরকারকে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে গত শুক্রবার কমলগঞ্জে মানববন্ধন করেছেন একদল পরিবেশকর্মী।

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন স্ট্যান্ড ফর আওয়ার ইনডেনজারড ওয়াইল্ডলাইফের ফাউন্ডার অ্যাডমিন সোহেল শ্যাম বলেন, 'শ্রীমঙ্গল স্টেশন মাস্টার বলছেন, লাউয়াছড়া বনের ভেতর ২০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চালানোর নির্দেশনা তারা পাননি। এটা হাস্যকর বিষয়। ১ মাসেও একটা চিঠি আসে না, এটাকে হাস্যকর ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।'

Comments